Tuesday, May 21, 2013

‘সাদাত হাসান মান্টো সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কথা বলতেই হবে। কেননা দেশ ভাগ মান্টোর সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন সাহসী ও শাণিত লেখক। সাহিত্য মায়ার জগতে নিয়ে যায় পাঠককে। কিন্তু মান্টো সেই মায়ার জগৎ থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসেন মানুষকে। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছেন, পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের ক্ষমতাসীনদের ব্যঙ্গ করেছেন। যেমন তার “টোবা টেক সিং” গল্প তার প্রধান উদাহরণ।’আমরা সে ভাবে তাঁকে পড়লামই না অথচ সাদাত হাসান মান্টো কেবল দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার নন, এই উপমহাদেশের জীবনে তিনি আজও ভয়ানক ভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর জন্মের শতবর্ষ চলে গেল, মোটামুটি নিঃশব্দেই। গৌতম রায়

'সাদাত হাসান মান্টো সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাজনের কথা বলতেই হবে। কেননা দেশ ভাগ মান্টোর সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। তিনি ছিলেন সাহসী ও শাণিত লেখক। সাহিত্য মায়ার জগতে নিয়ে যায় পাঠককে। কিন্তু মান্টো সেই মায়ার জগৎ থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসেন মানুষকে। তিনি সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছেন, পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের ক্ষমতাসীনদের ব্যঙ্গ করেছেন। যেমন তার "টোবা টেক সিং" গল্প তার প্রধান উদাহরণ।'
জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলিআমি কেন লিখিমূল : সাদাত হাসান মান্টো 
অনুবাদ : জাফর আলম
আমি কেন লিখি? এটা এমন প্রশ্ন, যেমন আমি কেন খাই_কেন তৃষ্ণা মিটাই। যদি এ দৃষ্টিকোণ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়, তাহলে খাওয়া-দাওয়া আর তৃষ্ণা মিটানোর জন্য টাকা ব্যয় করতে হবে। যদি আমি এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য গভীর থেকে গভীরতরে প্রবেশ করি, তখন বুঝতে পারি, আমি ভুল। কারণ টাকার জন্য আমাকে লিখতে হয়।
আহার যদি সংগ্রহ করতে না পারি, তবে আমার দৈহিক অবস্থা এমন থাকবে না_কলমও ধরতে অক্ষম হব, না খেয়ে উপোস করে চিন্তা-চেতনা চালু রাখা যেতে পারে; কিন্তু হাত তো সবল রাখা প্রয়োজন। যদি হাত না চলে, তাহলে মুখে কথা বলা চালু থাকুক। মানুষ ভুখাপেটে কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না, এটাই হলো মানুষের এক ট্র্যাজেডি।
শিল্পকলাকে মানুষ অনেক উচ্চে স্থান দিয়েছে। এর যে পতাকা তা স্বর্গে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু এ কথা অবিস্মরণীয়ভাবে সত্য যে প্রতিটি শ্রেষ্ঠ এবং মহান জিনিসই এক টুকরো রুটির জন্য উদগ্রীব।
আমি কিছু বলতে চাই, তাই আমি লিখি। আমি কিছু রোজগারের জন্য লিখে থাকি এবং রোজগার করি_তাই অনেক কথা বলতে পারি।
রুটি ও শিল্পকলার যে সম্পর্ক তা আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো উপায় নেই। খোদা তায়ালা এই দুয়ের সম্পর্ক এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তিনি স্বয়ং নিজেকে সবই বস্তনিরপেক্ষ বলেছেন অথচ এটা সম্পূর্ণ সত্য নয়। এই নিরপেক্ষতা ও নির্লিপ্ততা সঠিক নয়। এর জন্য ইবাদত অথবা প্রার্থনা প্রয়োজন। আর এই আরাধনা খুবই কোমল ও স্পর্শকাতর রুটির মতো। অতএব, বলতে পারেন, এটা যেন ঘিয়ে ভাজা রুটি আর যে রুটি দিয়ে তিনি উদরপূর্তি করেন।
আমার প্রতিবেশী কোনো মহিলা যদি প্রতিদিন তাঁর স্বামীর হাতে মার খেয়ে আবার স্বামীর জুতা পরিষ্কার করেন তার জন্য আমার হৃদয়ে কোনো দয়া বা অনুকম্পা থাকতে পারে না। কিন্তু আমার প্রতিবেশী যে মহিলা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করেন ও হুমকি দিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যান। আর দুই ঘণ্টার মতো সময় স্বামীকে অস্থির ও উদ্বিগ্ন দেখতে পাই। তখন তাঁদের দুজনের জন্যই আমার মনে বিচিত্র ধরনের অনুভূতি ও বেদনার সৃষ্টি হয়। যদি দুজন যুবক-যুবতীর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠে, আমি তাঁদের সর্দি হয়েছে বলে মনে করি না। কিন্তু ওই যুবককে আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে যেন তার জন্য হাজারো মেয়ে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। আসলে যে বাংলার দুর্ভিক্ষ মানুষের মতো ভালোবাসার কাঙাল। এই প্রেমিক তার ভালোবাসার রঙিন কথার ফুলঝুরির মধ্যে গুমরে উঠা কান্নাকে ধরে রাখে, তা আমার হৃদয়ের কান দিয়ে শুনব আর অন্যকেও শোনাব।
চাকায় গম পেষাইকারী যে মহিলা দিনরাত পরিশ্রম করেন ও রাতে আরামে ঘুমান তাঁরা আমার কাহিনীর হিরোইন হতে পারেন না। আমার গল্পের নায়িকা হচ্ছে পতিতালয়ের বেশ্যা, যে সারারাত জেগে থাকে আর দিনে ঘুমায়। আর ঘুমের মধ্যে কখনো ভয়ানক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে, যেন সে বুড়ি হয়ে গেছে আর বুড়ো বয়সের দিনগুলো যেন তার ঘরের দরজায় টোকা মারছে। তার ভারী চোখের পাতার ওপর অনেক বছরের ঘুম জমাট বেঁধে আছে। আর তারাই হলো আমার গল্পের বিষয়বস্তু। তার অসুস্থতা আর খিটখিটে মেজাজ, ওর অশ্লীল গালিগালাজ_সব কিছু আমাকে মুগ্ধ করে। তাই আমি তাদের নিয়ে লিখি। ঘরোয়া মেয়েদের আলসেমি ও তাদের ন্যাকামি, সুন্দর স্বাস্থ্য আমার পছন্দ নয়।
সাদাত হাসান মান্টো লিখেন কারণ তিনি সৃষ্টিকর্তার মতো মস্তবড় গল্পকার কবি নন। তাঁর ভালোবাসা আর মমতা তাঁকে লেখার জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়।
আমার জানা আছে, উর্দু সাহিত্যে আমার ভীষণ খ্যাতি আর সুনাম আছে। যদি জীবনে এই আনন্দ ও উৎফুল্লতা না থাকে, তবে জীবন মূল্যহীন হয়ে পড়ত। আমার দেশ_পাকিস্তান। যেখানে আমি থাকি, যেখানে আমি আমার দাঁড়ানোর স্থান তা আজও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। সেজন্য আমার রক্ত সর্বদা চঞ্চল থাকে। আমি কখনো পাগলা গারদে অথবা হাসপাতালে দিন কাটাই।
আমাকে সর্বদা প্রশ্ন করা হয়, আমি কেন মদ পান করা ছাড়তে পারি না। আমি আমার জীবনের তিন-চতুর্থাংশ খারাপ সংসর্গে কাটিয়ে দিয়েছি। আমার এখন এমন অবস্থা যে 'খারাপ সংসর্গ' থেকে দূরে থাকা শব্দটি আমার অভিধান থেকে উধাও হয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস, খারাপ সংসর্গ বাদ দিয়ে আমি যদি এখন দিন কাটাই, তবে আমার জীবন হয়ে উঠবে জেলখানার বন্দির মতো, আর যদি খারাপ সংসর্গ কেটে যায়, তাহলে তাও হবে জেলের চেয়ে অতিরিক্ত কিছু নয়। তাই কোনো না কোনোভাবে যদি আমি মোজার সুতার একটা দিক টানতে টানতে বেঁচে যাই, তা হবে আমার জন্য মঙ্গলকর।
[মান্টোর জন্ম ১১ মে, ১৯১২ ভারতের লুধিয়ানা জেলার সোমরালে। মৃত্যু ১৮ জানুয়ারি, ১৯৫৫ সালে লাহোরে। জন্ম তারিখ অনুযায়ী ১১ মে, ১৯১২ মান্টোর জন্মশততমবার্ষিকী। 'আমি কেন লিখি' লেখাটি অনুবাদকের মান্টোর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।]

খুল দো, ঠাণ্ডা গোস্ত কিংবা খুদা কি কসম
আন্দালিব রাশদী
দুপুর দুটোয় অমৃতসর থেকে স্পেশাল ট্রেন ছেড়ে লাহোর মুঘলপুরা পৌঁছল আট ঘণ্টা পর। রাস্তায় ট্রেন আটকে অনেককে হত্যা করা হলো, আহত অনেকে নিরুদ্দিষ্টের সংখ্যা অনেক বেশি। খোলা মাঠে ক্রন্দরত নারী শিশু ও আহত মানুষের মাঝখানে সিরাজুদ্দিনের জ্ঞান ফিরল পরদিন সকাল দশটায়। তারও অনেকক্ষণ পর তিনি চিৎকার শুরু করলেন, সখিনা, সখিনা। হতবুদ্ধি দশা কিছুটা কাটতে জনতার কাছ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তিনি বসে বসে মনে করার চেষ্টা করলেনÑকোথায় স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে তার শেষ দেখা। সখিনার মার কথা মনে পড়ল। পেটে ছুরি চালানোর পর নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে। তার চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করার আগ মুহূর্তে বলেছে, আমি এখানেই পড়ে থাকি। তুমি এক্ষণ মেয়েটাকে নিয়ে চলে যাও।
মেয়ের হাত ধরে সিরাজুদ্দিন দৌড়াচ্ছেন। মেয়ের ওড়না পড়ে গেল। তুলতে গেলে মেয়ে বলল থাক বাবা। তারপরও এক হাতে ওড়না টেনে ধরে। তাহলে মেয়েটা নিরুদ্দিষ্ট হলো কখন? মেয়ে কি তার সঙ্গে অমৃতসর স্টেশন পর্যন্ত আসতে পারেনি? কিংবা ট্রেন থামিয়ে দাঙ্গাবাজরা কি তাকে তুলে নিয়ে গেছে? 
সিরাজুদ্দিন মনে করতে পারেন না। তিনি কাঁদতে চান, কান্না আসে না। এর মধ্যে অস্ত্রবাহী আট যুবকের একটি দল ওপারে ফেলে আসা শিশু ও নারী ফিরিয়ে আনার কাজ করছে বলে জানায়। 
সিরাজুদ্দিন মেয়ের বর্ণনা দেন। 'মেয়েটি কী যে সুন্দর! না না সে দেখতে মোটেও আমার মতো নয়, তার মায়ের মতো। বয়স প্রায় সতের। বড় চোখ, কালো চুল, বাম গালে একটা কালো তিন। আমার মেয়ে খুঁজে বের করে আনো। আল্লাহ তোমাদের রহম করবেন।' 
যুবকরা বলল, মেয়ে বেঁচে থাকলে নিয়ে আসব। 
আবার যখন যুবকরা অমৃতসর যায়, রাস্তার পাশে আতঙ্কিত মেয়েটিকে দেখতে পায় গাড়ির শব্দ শুনে মেয়েটি ছুটে পালাতে থাকে। তারা মেয়েটিকে ধরে ফেলে, বাম গালে তিল দেখতে পায়, তাদের অনেক প্রচেষ্টার পর মেয়েটি স্বীকার করে সেই সখিনা। 
যুবকরা মেয়েটির ব্যাপারে সদয় হয়। তাকে খাবার দেয়। ট্রাকে উঠিয়ে নেয়। ওড়নাহীন সখিনা দু'হাত আড়াআড়ি ধরে স্তনযুগল ঢেকে রাখে।
তারপর অনেকদিন যায়। সিরাজুদ্দিন মেয়ের খবর আর পায় না। যুবকরা সেই পুরনো আশ্বাসই দেয়, যদি বেঁচে থাকে নিয়ে আসব। সেই সন্ধ্যায় সিরাজুদ্দিনের চোখে পড়ে চারজন মানুষ এক অজ্ঞান তরুণীকে ক্যাম্প হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। তিনিও পেছন পেছন যান। কিছুক্ষণ হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, আবার ভেতরে যান। স্ট্রেচারে শায়িত কেউ একজন। কেউ একজন আলোর সুইচ টিপতেই তার চোখে পড়ল বাম গালে তিল। তিনি চিৎকার করে উঠেন, সখিনা।
যে ডাক্তার সুইচ টিপে ছিলেন, বুড়ো সিরাজুদ্দিনের দিকে তাকান।
আমি এই মেয়ের বাবা।
ডাক্তার মেয়েটিকে পরীক্ষা করলেন, জানলাটা দেখিয়ে বুড়োকে বললেন, খুলে দাওÑখুল দো।
তখন স্ট্রেচারে শোয়া মেয়েটি নড়ে উঠল। এই অজ্ঞানাবস্থাতেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার হাত পড়ল সালোয়ারের ফিতেয়। যন্ত্রণাকাতরতার মধ্যই সে ফিতে খুলে সালওয়ার নামিয়ে দিল, বেরিয়ে এল তার ঊরুদেশ।
সিরাজুদ্দিন আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন, বেঁচে আছে। আমার মেয়ে বেঁচে আছে।

২.
অনেকদিন পর ভরা যৌবনবতী কুলবন্ত কাউরের হোটেল কক্ষে ঢুকল ঈশ্বর সিং, তখন রাত বারটা, শহর নিঝুম। কুলবন্ত তেজী নারী, থলথলে নিতম্ব, উদ্ধত স্তন। ঈশ্বর সিং-এর পাগড়ি প্যাঁচ শিথিল হয়ে আসছে, হাতে কম্পমান কৃপাণ। যে কেউ বলবে তারা পরস্পরের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু ঈশ্বর সিং এতদিন কোথায় ছিল? কুলবন্ত কাউরের প্রশ্নের জবাবে জানায়, জানি না।
কুলবন্ত বলে, এটা পুরুষ মানুষের জবাব হতে পারে না।
তারপর কুলবন্তের শরীরে চাঞ্চল্য দেখা দেয়। কুলবন্ত বলে, নিশ্চয়ই অনেক লুটপাট করেছ।
কিছুদিন আগেই লুটের স্বর্ণালঙ্কার কুলন্তের গায়ে চাপিয়ে হঠাৎ বেরিয়ে যায়। তারপর আর খবর নেই।
মধ্যরাতে ঈশ্বর সিং কুলন্তকে দলিতমথিত করে জাগিয়ে তুলল, কিন্তু জাগরণ হলো না তার নিজেরই। নিজেকে শারীরিকভাবে সক্রিয় করতে যত পন্থা তার জানা ছিল, সব চেষ্টা একে একে ব্যর্থ হল। তার ব্যর্থতা ক্ষিপ্ত করে তুলল কুলবন্ত কাউরকে।
ঈশ্বর সিং যখন দেখল তার উত্থিত হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই, নিশ্চুপ শুয়ে রইল বিছানায়। অতৃপ্ত কুলবন্ত চেঁচিয়ে উঠল, কোন হারামজাদিকে সব দিয়ে এসেছিস? কসম, আমিও সর্দার লেহাল সিংয়ের বেটি, মিথ্যে বললে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব। বল কে সে নারী যে তোর সকল জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছে?
এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত কুলবন্ত ঈশ্বর সিংয়ের কৃপাণ খুলে তাকে আঘাত করল, ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল। অতৃপ্ত নারী, যত প্রিয়জনই হোক, ভয়াবহ হয়ে উঠে।
কুলবন্ত ঈশ্বরের চুলের মুঠি ধরে আছড়াতে থাকে। একজন নারী নিশ্চয়ই তার আর ঈশ্বরের মাঝখানে ঢুকে পড়েছে।
ঈশ্বর সিং নিরুত্তর।
কুলবন্ত জিজ্ঞেস, বলছিস না কেন? সে কি তোর মা?
এই ভয়াবহ রূঢ়তার মধ্যে ঈশ্বর সিং মুখ খুলে, কুলবন্ত এই কৃপাণ দিয়ে আমি ছ'জনকে হত্যা করি।
খুন আর লুটতরাজের কাহিনীর দরকার নেই তার। সে শুধু নিশ্চিত হতে চায় কোন নারী ঈশ্বর সিংকে নিঃশেষ করেছে তার পরিচয়। কৃপাণের আঘাতে রক্তপাত হচ্ছে তারও। ফিনকি দিয়ে গোঁফের উপর উপর ছিটকে পড়া রক্ত ফুঁ দিয়ে সরিয়ে ঈশ্বর সিং বলে, ছ'জনকে খুন করেছি আর খুব সুন্দর একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছি।
ঈশ্বর সিং বলে, কুলবন্ত আমি তাকেও খুন করতাম কিন্তু একবার মনে মনে হল তোকে তো প্রতিদিনই পাই। এমন সুন্দর একটি মেয়েকে একবারও ভোগ করব না?
ঈশ্বর সিং সেই সুন্দরীকে কাঁধে নিয়ে খালের ধারে একটি ঝোপের আড়ালে শুইয়ে দিল। তারপর শুরু করল প্রাক শৃঙ্গার পর্ব। তারপর যখন ব্যাপারটা ঘটতে যাবে ঈশ্বর সিংয়ের বর্ণনা হঠাৎ নিষ্প্রাণ হয়ে গেল।
কুলবন্ত জিজ্ঞেস করল, তারপর কি হল?
ঈশ্বর সিং বলল, টের পেলাম এটা একটা মৃতদেহ। আগেই সে ঠা-া হয়ে গেছে। পুরোপুরিই ঠা-া গোস্ত।
কুলবন্ত যখন ঈশ্বর সিংয়ের হাতে হাত রাখে অনুভব করে হাতটাও ঠা-ায় জমে গেছে।

৩.
দেশ ভাগ হয়ে গেছে। হাজার হাজার মুসলমান আশ্রয়ের খোঁজে পাকিস্তান যাচ্ছে, হাজার হাজার হিন্দু ভারতে আসছে। অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে তিল ধারণের ঠাঁই নেই, তবুও মানুষ আসছে। এর মধ্যেই ঢুকে পড়ছে। খাদ্য থেকে শুরু করে ঔষধÑহাহাকার সকল কিছুর।
১৯৪৮ সাল শুরু হল। অপহৃত নারীদের উদ্ধার করার জন্য হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হল। তারা দল বেঁধে পাকিস্তান-ভারত আসা যাওয়া করছে, উদ্ধার করেও নিয়ে আসছে।
যারা তাদের মেয়েদের অপহৃত ও ধর্ষিত হতে দিয়েছে তারা এখন তাদের ফেরত চাচ্ছে কোন পাপস্খলনের জন্য। আঙ্গুলে লেগে থাকা রক্ত লেহন করে ফেললেই কি খুনের চিহ্ন মুছে যায়?
একজন শরণার্থী লিয়াজোঁ অফিসার জানিয়েছে। শাহরানপুরে অপহৃত দুটি মুসলমান মেয়ে পাকিস্তানে তাদের পিতা-মাতার কাছে ফিরে যেতে অস্বীকার করেছে। জলন্ধরে একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে পরিবারের সদস্যরা এমনভাবে তাকে বিদায় জানিয়েছে যেন একজন গৃহবধূকে দূরের যাত্রায় শুভকামনা করছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে শুধু এই আশঙ্কায় বেশ ক'টি মেয়ে ফেরার পথে আত্মহত্যা করেছে। মানসিক হাসপাতালে ঢুকেছে অনেকেই।
যখনই অপহৃত মেয়েদের কথা ভাবি আমার সামনে ভেসে ওঠে তাদের স্ফিত উদর। ভেতরের সন্তানের দায় কে নেবেÑপাকিস্তান না ভারত? ঈশ্বরের নির্যাতিতের খাতায় যদি কোন খালি পৃষ্ঠা থেকে থাকে সেখানে কি তাদের কারও নাম তালিকাভুক্ত হবে?
লিয়াজোঁ অফিসার বলল, শতবার তাকে ভারতে যাওয়া আসা করতে হয়েছে। এক বিধ্বস্ত মহিলার সাথে তার বহুবার দেখা হয়েছে ভারতে। প্রথমবার দেখা হয় জলন্ধরের বস্তিতে। চোখ দেখে মনে হয়েছে কাকে যেন খুঁজছে। স্বেচ্ছাসেবকদের একজন বলেছে, পাতিয়ালায় দাঙ্গার সময় তার একমাত্র মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে। মেয়েটা খুন হয়ে থাকতে পারে এটা কোন মতেই সে বিশ্বাস করছে না। মাসের পর মাস ধরে মেয়েকে খুঁজে চলেছে।
দ্বিতীয়বার দেখা শাহরানপুরে, বাসস্ট্যান্ডে মেয়েকে খুঁজছে। ঠোঁট ফেটে গেছে, চুলে জট লেগেছে। লিয়াজোঁ অফিসার তাকে বলল, এভাবে খুঁজে কোন লাভ হবে না, তোমার মেয়েকে হয়ত মেরেই ফেলেছে।
খুন? না, কেউ আমার মেয়েকে খুন করতে পারে না।
তৃতীয়বার দেখার পর লিয়াজোঁ অফিসার আবারও বলে, এবার থাম। মেয়ে খুন হয়ে গেছে।
তার কথার পাত্তা না দিয়ে মহিলা বলল, মিথ্যুক। কেউ আমার মেয়েকে খুন করতে পারে না।
কেন?
কারণ সে অনেক সুন্দর। এত সুন্দর মেয়েকে কেউ খুন করতে পারে না। এত সুন্দর মেয়েকে কেউ আঘাতও করতে পারে না।
লোকজন লিয়াজোঁ অফিসারকে বলে, তাকে পাকিস্তানে নিয়ে কোন মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দাও। সে এখন পুরো পাগল।
আরও কয়েকবার তার সাথে দেখা হয়। শেষবার দেখা হয় অমৃতসরে। পাকিস্তানে নিয়ে আসার প্রস্তাবে লিয়াজোঁ অফিসার সাড়া দেয়নি। এখানে তো তার বেঁচে থাকার অন্তত একটি কারণ রয়েছেÑমেয়েকে খুঁজছে। কিন্তু পাকিস্তানে গিয়ে কি করবে?
শেষবার অমৃতসরের ফরিদ চকে। বুড়ি আধেক অন্ধ হয়ে গেছে। একটি অপহৃত মুসলমান মেয়েকে উদ্ধারের চেষ্টা তখন চলছে।
লিয়াজোঁ অফিসারের চোখে পড়ে একটি দম্পতিÑযুবক সুন্দর ও হ্যান্ডসাম, তার স্ত্রীর মুখ শাদা চাদরে অংশিক ঢাকা। যুবকটি শিখ। 
বৃদ্ধাকে অতিক্রম করার সময় যুবক হঠাৎ থামল, দু এক পা পিছিয়ে এল। চাঁদর সরে গেলে লিয়াজোঁ অফিসার দেখল মেয়েটি সত্যিই সুন্দর।
যুবক মেয়েটিকে বলল, তোমার মা।
মেয়েটি একদ-ের জন্য পেছনে তাকিয়ে চাদরে মুখে ঢেকে যুবকের হাত ধরে বলল, চল তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাই।
মহিলা চিৎকার করে উঠল, ভাগবরী, ভাগবরী।
ভাগবরী মানে বাগ্যবতী।
লিয়াজোঁ অফিসার দ্রুত তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, কাকে দেখেছ?
উন্মাদিনী বলল, আমার মেয়ে ভাগবরীকে।
তাঁর চোখ আলোকে উদ্ভাসিত।
লিয়াজোঁ অফিসার বলল, মিথ্যে কথা। তোমার মেয়ে মৃত।
না, তুমি মিথ্যে বলছ।
লিয়াজোঁ অফিসার তখন বলল, খোদার কসম, খোদাকি কসম তোমার মেয়ে মৃত।
বৃদ্ধা তখনই রাস্তায় পড়ে গেল। তখনই তার দমও বেরিয়ে গেল।

৪.
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর উর্দু কথা সাহিত্যে একই সঙ্গে পরম আদৃত ও চরম ঘৃণিত ব্যক্তিত্ব সাদাত হাসান মান্টো। আদৃত ও ঘৃণিত যাই হোক, তিনি কখনও উপেক্ষিত হননি, অনুল্লেখিত থাকেননি।
দাঙ্গার এমনই রক্তাক্ত চিত্র এঁকেছেন সাদাত হাসান মান্টো। 'খুল দো' গল্পটিকে সিরাজুদ্দিনের মেয়ে সখিনা ধর্ষিত হতে হতে এমনি প্যারানয়েড হয়ে পড়েছিল যে ডাক্তার যখন জানালা খোলার জন্য খুল দো বলল, তার মনে হল সালোয়ার খোলার নির্দেশ এসেছে।
'ঠা-া গোস্ত' দাঙ্গা ও মনস্তত্ত্বের একটি অসাধারণ চিত্রায়ন।
'খুদা কি কসম' তো দাঙ্গার একটি জলজ্যান্ত ডকুমেন্টারি।
স্মরণীয় অনেক গল্প রেখে গেছেন এই বিতর্কিত গল্পকার। অশ্লীলতার অভিযোগে আদালতে ছ'বার মামলা মোকাবেলা করেছেন। ১৯৪৮-এর আগের সুদর্শন চৌকস মান্টো লাহোরে এসে দারিদ্র্য ঠেকাতে পারেননি। ভগ্ন স্বাস্থ্য ও অর্থকষ্ট তার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। ১৯৫৫ সালে মাত্র ৪২ বছর বয়সে মান্টোর মৃত্যু হয়। 
অবিশ্বাস্যই মনে হবেÑএরই মধ্যে মান্টো ২২টি ছোট গল্প গ্রন্থ রচনা করেছেন। উপন্যাস, নাটক তো রয়েছেই।
১১ মে সাদাত হাসান মান্টোর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে ভারতে ও পাকিস্তানে। বাংলাদেশেও সা'দাত হাসান মান্টো বহুল পঠিত। জন্মশতবর্ষে এই মানবতাবাদী গল্পকারের জন্য অশেষ শ্রদ্ধা।

রিটিশ শাসিত ভারতে ১৯৩৬-১৯৫৬ পর্বে একটা সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আমরা বাঙালিরা তাকে 'প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘ' নামে জানি। এই আন্দোলনকে প্রায়ই সরলভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটা শাখা সংগঠনের আন্দোলন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এই সাহিত্য-আন্দোলনের পরিচয় এত সরল ছিল না। সেই সাহিত্য-আন্দোলনের ঘূর্ণাবর্তে যে লেখক-সাহিত্যিকরা এসে পড়েছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সাদাত হাসান মান্টো। ভারত বিভাজনের আগে প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে কখনোই 'পার্টির লোক' বলে শনাক্ত করা যাবে না।
উর্দু সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ছোটোগল্প লেখক সাদাত হাসান মান্টো ১৯১২ সালের ১১ মে জন্মেছিলেন পাঞ্জাবের লুধিয়ানা জেলার সামরালায়, মধ্যবিত্ত এক কাশ্মীরি পরিবারে। তখন সময়টা ছিল খুবই অস্থির। জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যার সময় তাঁর বয়স ছিল সাত। ওই পটভূমিতে তখনই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম গল্প 'তামাশা', অবশ্য পুলিশের ভয়ে ছদ্মনামে।
তাঁর ইস্কুল-কলেজের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে মান্টো নিজেই লিখেছেন : 'সেই অস্থিরচিত্ত মানুষটি, যার নাম সাদাত হাসান, এর পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য প্রায় খেপে উঠল, ব্যাচিলর ডিগ্রির জন্য এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (এফ এ পরীক্ষায়) ফেল করল দু-বার এবং থার্ড ডিভিসনে পাস করল।
শুনে আপনারা আশ্চর্য হবেন যে, সে তার উর্দু পেপারে সব সময়ে ফেল করেছে। এখন যখন মানুষজন বলাবলি করে যে, সে একজন মহৎ উর্দু লেখক, আমি শুধু হাসি, কারণ, এমনকী এখনও সে উর্দু ভাষাটা জানে না।'
তাঁর যখন ২১ বছর বয়স, তখন অমৃতসরের আবদুল বারি আলিগ-এর উৎসাহে মান্টো অনুবাদ-সাহিত্যের কাজে হাত দেন। ১৯৩৬ সালে বোম্বাইয়ে থাকাকালীন তিনি হিন্দি ফিল্মের চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। ১৯৪১ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকরি নিয়ে দিল্লিতে আসেন এবং উর্দু চ্যানেলের জন্য লেখার কাজ করেন। ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি লাহোরবাসী। সেখানে মাত্র সাত বছর বেঁচেছিলেন তিনি। এই সামান্য সময়ে তিনি তাঁর লেখক-জীবনের সর্বোত্তম ফসল ফলিয়েছেন : 'ঠান্ডা গোস্ত', 'খোল দো', 'টোবা টেক সিং' এবং আরও অনেক নানা ধরনের লেখা। লিভারের সিরোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৫৫ সালের ১৮ জানুয়ারি এক প্রচণ্ড শীতের দিনে তাঁর মৃত্যু হয়। এই স্বল্প জীবৎকালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভারত-পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্প লেখক।

সূত্র : সাদাত হাসান মান্টো : কী এবং কেন, ভূমেন্দ্র গুহ, নন্দন, জানুয়ারি ২০১২ সংখ্যা

আমরা সে ভাবে তাঁকে পড়লামই না
সাদাত হাসান মান্টো-কে উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কথাকার বললে এত দিনে মনে হয় কেউ আর আপত্তি করবে না। দেশভাগের যন্ত্রণা, ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার, দাঙ্গার আতঙ্ক, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বিদ্বেষ এত নিপুণ দরদে আর কে-ই বা চিত্রিত করেছেন? দুর্ভাগ্য আমাদের, মান্টোর অধিকাংশ রচনাই উর্দুতে, আর সেকুলার ভারত শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের এই জাতীয় ভাষার চর্চাকে সর্বতোভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। তাই ইংরাজি অনুবাদে, ইংরাজি-শিক্ষিত সাহিত্যপাঠকের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে মান্টো সে ভাবে চর্চিত হলেন না।
পাকিস্তানে যখন ইদের বর্ণাঢ্য উৎসবের মধ্যেই সংখ্যালঘু হিন্দুদের মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়, পরিবারের মেয়েদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে নেয় ক্ষমতাবানরা, ট্রেনে চেপে ভারতে পালানোর সময় জানলা দিয়ে তাদের প্রতিবেশীরা হাত নাড়ে শেষ বার জীবিত দেখতে পাওয়া স্বজনদের উদ্দেশে, মান্টোর কথা মনে পড়ে। তার পাসপোর্ট করাতে না-পারায় তিন দিনের নবজাতককে প্রতিবেশীর কাছে বরাবরের জন্য রেখে দিয়ে এক হিন্দু মা যখন সাশ্রুনয়নে প্রয়াগের কুম্ভ মেলা দেখার পর্যটক-ভিসা নিয়ে রাজস্থান সীমান্ত পেরিয়ে বাকি সন্তানদের বাঁচাতে এ দেশে থেকে যেতে চান, স্বাধীনতা ও দেশভাগের মান্টো-কৃত বিশ্লেষণ বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ভাগলপুরে দাঙ্গায় নিহতদের শব মাটি-চাপা দিয়ে যখন তার উপর কচি-সবুজ ধানের চারা রোপণ করা হয়, 'জয়শ্রীরাম' বলতে অস্বীকৃত ইমামের ধড়মুণ্ড আলাদা করে সুরাতে যখন তাঁর আজীবন বোরখাবৃত স্ত্রীকে নগ্ন করে গণধর্ষণ করার চলচ্চিত্র ভিডিও-বন্দি করে যৌথ উপভোগ করা হয়, বা গুজরাতে জীবন্ত সংখ্যালঘু পোড়ানোর সময় 'হর-হর-মহাদেব' ধ্বনি ওঠে, সেই পৈশাচিকতাকে পোকায়-কাটা স্বাধীনতায় বিভক্ত উপমহাদেশে বড়ই মান্টো-প্রতিম মনে হয়। হ্যাঁ, সাদাত হাসান মান্টোর— কেবল 'টোবা টেক সিং' নয়— আরও অনেক গল্পের মতোই শ্লেষপূর্ণ ও পরিহাসময়।
জালিয়ানওয়ালাবাগের শহর অমৃতসরে মান্টোর জন্ম (১১মে, ১৯১২) ও বড় হওয়া। ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিবাদীদের দলে ভিড়তেও রাজনীতিসচেতন এই নবীন কিশোরের সময় লাগেনি। কিন্তু প্রগতি লেখক সংঘের ছকে-বাঁধা সাহিত্য, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নৃশংসতা ফুটিয়ে তোলার ছাঁচে-ঢালা রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি এই কথাকার। সমাজের নিচুতলা অর্থাৎ পানওয়ালা, দোকানদার, ড্রাইভার, ধোপা, দালাল, বেশ্যা ও অসংগঠিত শ্রমজীবীদের পাশাপাশি ওপরতলার গ্লানি ও পাপ, রিরংসা ও নিঃস্বার্থতার মিশ্র জীবনই তাঁকে আকৃষ্ট করে বেশি। তাঁর 'গন্ধ' গল্পটিতে যেমন বিত্তবান তরুণ রণধীর এক বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় ভিজে-কাপড়ের মজদুরনিকে তার বিলাসবহুল ঘরে আশ্রয় দিয়ে কালক্রমে সম্ভোগে লিপ্ত হয়। এই যৌনতায় সবচেয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তার ঘামে-ভেজা শরীরের দুর্গন্ধ, যা রণধীর নিজের সর্ব শরীর ও চেতনা দিয়ে আকণ্ঠ পান করে। গল্পের শেষে জেলাশাসকের গ্র্যাজুয়েট কন্যার সঙ্গে বাসররাত্রির আসঙ্গেও রণধীর সেই গন্ধের অনুপস্থিতিতে কামার্ত হয়ে উঠতে ব্যর্থ। চল্লিশের দশকের অবিভক্ত ভারতের আইনে মান্টোকে অশ্লীলতার দায়ে তলব করে লাহোরের আদালত।
'ঠাণ্ডা গোস্ত' গল্পে দেখি, দেশভাগের সময়কার দাঙ্গায় মুসলমানের রক্তে হাত রাঙানো শিখ যুবক ঈশ্বর সিংহ ঘরে ফিরে কিছুতেই প্রেমিকার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছে না। প্রেমিকার সন্দেহ, তার মরদ নিশ্চয় অন্য নারীসঙ্গে মজেছে। ঈর্ষার জ্বালায় ঈশ্বরের কৃপাণ কোষমুক্ত করে সে ক্ষতবিক্ষত করে তাকে। মুমূর্ষু ঈশ্বর স্বীকার করে, সে এক অচেতন মুসলিম বালিকাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ক্রমশ বুঝতে পারে আসলে সে বালিকাটির শবের সঙ্গে... আখ্যানের তীব্র সংবেদনশীলতা বোঝেনি পাকিস্তান। 'আমরা মুসলমানরা এতই আত্মমর্যাদারহিত যে আমাদের মৃত কন্যাদেরও শিখরা ধর্ষণ করে যায়?'—এমন প্রশ্ন তুলে লাহোর আদালতে মামলাও ঠুকে দেয় পাক আমলাতন্ত্র।
মান্টো তাঁর সাধের মুম্বই ছেড়ে কেন পাকিস্তানে চলে গেলেন, তা নিয়ে জল্পনা আজও শেষ হয়নি। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত এ শহরেই তাঁর বোহেমিয়ান দিনযাপন, চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে দহরম-মহরম, ফিল্মের চিত্রনাট্য রচনা থেকে পতিত, পাপী-তাপী, মাতাল-বেশ্যাদের ডেরায় ঘুরে বেড়ানো। তবে কেন তিনি ভারত ছাড়লেন? কারণ মুম্বই, বস্তুত সমগ্র উত্তর ভারতই, আর তত দিনে তত সেকুলার নেই, তার ধর্মনিরপেক্ষতার সাংবিধানিক শপথের আড়াল থেকে উঁকি মারছে মুসলিমদের একঘরে করার, কাজ না দেওয়ার, ভাতে-পানিতে মারার, হুমকি দিয়ে তাড়ানোর প্রচ্ছন্ন চক্রান্ত। পাকিস্তানে গিয়েও কিন্তু মান্টো লিখছেন 'দ্বিজাতিতত্ত্ব'র মতো গল্প, যাতে প্রতিবেশী হিন্দু বালিকা শারদার প্রেমে পড়া মুসলিম কিশোর মুখ্তার 'প্রেমের ধর্মের কাছে আর সব ধর্মই তুচ্ছ' ঘোষণা করেও বিয়ের জন্য প্রেমিকাকে ইসলাম গ্রহণে চাপ দেয়। শারদা যখন পাল্টা তাকে হিন্দু হতে বলে, তখনই মুখ্তার ইসলামের উৎকর্ষ আর পৌত্তলিক ও গোময়পায়ী হিন্দুত্বের অপকর্ষ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে 'বুকের মধ্যে ইসলাম গুঁজে নিয়ে' শারদার বন্ধ দরজা থেকে ফিরে আসে। কিংবা মনে করুন আর এক হাড়-হিম-করা গল্প 'ফিরে আসা', যাতে দাঙ্গায় স্ত্রী-হারানো সিরাজুদ্দিন পরমাসুন্দরী কন্যা সাকিনাকে উদ্ধার করতে মুসলিম স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়োগ করেন। কিছু দিন পর স্ট্রেচারে-শোয়া অচেতন মেয়েকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে যেতে দেখে ফিরে-পাওয়ার আনন্দে সিরাজুদ্দিন পিছু-পিছু ঢোকেন। ডাক্তার তাঁকে ঘরে আলো আসার জানলা দেখিয়ে বলেন, 'খুলে দাও'। অর্ধচেতন সাকিনা তৎক্ষণাৎ নিজের সালোয়ারের দড়ি আল্গা করে নামিয়ে দু'পা ফাঁক করে দেয়। এত অসংখ্য বার সে বিধর্মী হিন্দু ও স্বধর্মী মুসলিমদের দ্বারা ধর্ষিত, যে 'খুলে দাও' উচ্চারণে সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় তার হাত সালোয়ারের দড়িতে চলে যায়।
এমন গল্পকারকে পাকিস্তানই বা কী করে হজম করবে? ১৯৫০ সালে মান্টো স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপে লেখেন, 'এক দিন হয়তো পাকিস্তানের সরকার আমার কফিনে একটা মেডেলও পরিয়ে দেবে। সেটাই হবে আমার চরম অপমান।' পাকিস্তানের জন্মের ৬৫ বছর উপলক্ষে গত অগস্টে পাক সরকার ঠিক সেটাই করেছে। সাদাত হাসান মান্টোকে তারা 'নিশান-এ-ইমতিয়াজ' উপাধিতে ভূষিত করেছে, যিনি তাঁর 'এপিটাফ'-এ লিখে গিয়েছিলেন, 'এই সমাধিতে টন-টন মাটির তলায় শুয়ে আছে সেই ছোটগল্পকার, যে ভাবছে, খোদা, নাকি সে নিজে, কে বেশি ভাল গল্পকার!' মৌলবাদীদের হামলার ভয়ে মান্টোর পরিবার তাঁর সমাধিতে এটা খোদাই করার সাহস পায়নি।
http://www.anandabazar.com/21edit3.html

সাদাত হাসান মান্টো এখনও ভাবায়

আ হ মে দ তে পা ন্ত র
সাদত হাসান মান্টো। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ক্ষণজন্মা গল্পকার, চিত্রনাট্যকার, অনুবাদক এবং একইসঙ্গে সংলাপ রচয়িতা। বিংশ শতকে এমন ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর শক্তিশালী লেখকদের অগ্রজ প্রতিনিধি বলা হয় তাকে। যদিও এ আলোচনা যতটা ভারতে, ঠিক ততখানি পাকিস্তানে নয়। হালে তাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে তরুণ প্রজন্ম। 
মানবসচেতন অসাম্প্রদায়িক লেখক সাদত হাসান মান্টো ১৯১২ সালের ১১ মে ব্রিটিশ শাসিত পাঞ্জাবের (বর্তমান পাকিস্তান) লুধানিয়া জেলার সামরালা শহরে শিক্ষিত কাশ্মীরি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সাদত হাসান মান্টো মূলত মানবতাবাদী ইতিহাসআশ্রিত ছোট গল্পকার। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড তার সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলেছে। এজন্য তাকে ব্রিটিশ সাহিত্যিক ডি. এইচ. লরেন্সের সঙ্গে তুলনা করা হতো। মান্টোর মতো লরেন্সও অল্প বয়সে মারা যান। দ্য হিন্দু'র আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, 'মান্টোকে আজও ভারতীয়রা স্মরণ করে; কারণ তার লেখায় ভারত-পাকিস্তানের মর্মান্তিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে যেমন এর কুিসত চেহারা ফুটে উঠেছে, তেমনি সাম্প্রদায়িকতার নগ্নতা দেখতে পাই ১৯৮৪ সালে দিল্লিতে দাঙ্গা কিংবা ২০০২ সালে গুজরাটে অসংখ্য মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে।' আলোচনায় তারা আরও বলেন, 'মান্টো হচ্ছেন সত্যিকারের চিত্রনাট্যশিল্পী।'
মান্টো একাধারে উর্দু ছোট গল্পকার, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতা ছিলেন। ভারতের বলিউডের আধুনিক চিত্রনাট্যের জনক বলা হয় তাকে। মান্টো ১৯৩১ সালে অমৃতসরে হিন্দুসভা কলেজে পড়ার সময় 'তামাশা' গল্প লেখেন। গল্পটি ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে রচিত।
পণ্ডিত আবদুল বারী আলিগের পরামর্শে মান্টো তার জীবনের প্রথমে ভিক্টর হুগোর 'দ্য লাস্ট ডেইজ অব এ কনডেম্ড ম্যান' (একজন কয়েদির গল্প)-এর উর্দু অনুবাদ লেখেন। এরপর তিনি লুধানিয়া থেকে প্রকাশিত উর্দু 'মাসোয়াট' পত্রিকায় চাকরি নেন। এরপর তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। অনুবাদে তার প্রতিভা দেখে পণ্ডিত আবদুল বারী আলিগ তাকে উত্সাহিত করেন রুশ এবং ফ্রান্স-সাহিত্য বেশি করে পড়ার ব্যাপারে। এদের মধ্যে লর্ড লিটন, ম্যাক্সিম গোর্কি, নাট্যকার চেখভ, রুশ গল্পকার পুশকিন, অস্কারওয়াইল্ড, ইতালির বিশ্বখ্যাত গল্পকার মঁপাসা উর্দু ভাষায় অনুবাদ করে নিজের ভিত মজবুত করেন। মান্টো তখন ২১ বছরের তরুণ। পরে নিজের ভিতের ওপর শুরু করেন স্বকীয় লেখা, যা তাকে ভারতীয় উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ লেখকদের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। 
এরপর মান্টো গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি নেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেখানে তিনি পরে শিক্ষকতাও করেন। সাহিত্যকর্মে আরও বেশি মনোনিবেশ করার জন্য তিনি ভারতীয় প্রগতিশীল লেখক সংঘের সদস্যপদ লাভ করেন। সেখানে তিনি নতুন করে আবিষ্কার করেন এবং লেখেন, 'ইনকিলাব পছন্দ' যা ১৯৩৫ সালের মার্চ মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এরপর অবশ্য মান্টোকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। কারণ ১৯৩৬ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে প্রথম প্রকাশ হয় উর্দু গল্পগ্রন্থ 'আটিশ পারে'। এরপর মান্টো আলীগড় ছেড়ে পাড়ি জমান লাহোরে, পরে বোম্বে।
চলচ্চিত্রের প্রতি ছিল তার অসামান্য ঝোঁক। সেই ঝোঁক থেকে ১৯৩৬ সালে মূলত তার মুম্বাই শহরে আসা। কয়েক বছর তিনি মুম্বাইয়ে কাটান। সেখানে তিনি 'মুসাফির' নামে একটি মাসিক চলচ্চিত্র ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। একইসঙ্গে তিনি শুরু করেন চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার কাজ।
১৯৩৬ সালে হিন্দি ছবি 'কিষান কানাইয়া' এবং ১৯৩৯ সালে 'আপনি নাগরিয়া'র চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সেইসঙ্গে অর্থের সমাগমও ঘটে। ১৯৩৯ সালের ২৬ এপ্রিল বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সাফিয়া। মান্টো তিন কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন।
আজকের মান্টো দু'ভাবে আলোচনায় আসেন। প্রথমে উর্দু ছোট গল্পকার। দ্বিতীয় ভাগে চিত্রনাট্যকার এবং সংলাপ রচয়িতা। এই ভাগে তিনি মুম্বাই তথা ভারতবর্ষে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি যখন ভারত ত্যাগ করেন, তখন অনেকেই তাকে পাকিস্তানে ফিরতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন অশোক কুমার, নূরজাহান নাসিমসহ অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। এছাড়া বিখ্যাত লেখিকা ইসমত চুগতাইও ছিলেন তার অন্যতম শুভাকাঙ্ক্ষী। জানা যায়, চুগতাইয়ের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। সে সময় তাদের সম্পর্ক বেশ আলোচনার খোরাক জুগিয়েছিল। অবশ্য শেষপর্যন্ত মান্টোর নীরবতা ও চলে যাওয়ায় সেই আলোচনায় যবনিকাপাত ঘটে। দেশে ফেরার পর তিনি লেখেন তার বহুল বিতর্কিত 'খুল দো' এবং 'ঠাণ্ডা গোশত' নামে দু'টি আক্রমণাত্মক গল্প। ওই সময় দেশজুড়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে এ নিয়ে। 
দেশ ভাগ হলে মান্টো সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানে লাহোরে ফেরার। ১৯৪৮ সালে বন্ধুদের অনুরোধ সম্মানের সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে জন্মভূমে ফেরেন।
এখানে শুরু হলো মান্টোর তৃতীয় এবং শেষ অধ্যায়। তিনি ভেবেছিলেন, দেশ ভাগ হলে সাম্প্রদায়িক চেতনা ও শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু খ্যাতি-যশ মুম্বাই ফেলে মান্টো পাকিস্তানে মারাত্মক অর্থকষ্টে পড়েন। দেশে তখন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এমন উপলব্ধি থেকে তিনি রচনা করেন রাজনৈতিক প্রহসনমূলক গল্প 'তোবা টেক সিংহ'। এটা নিয়ে একটা গল্প চালু আছে। জানা গেছে, তার চরম অর্থসঙ্কটে একবার লাহোরের বিখ্যাত ওয়াএমসিএ হলে এক অনুষ্ঠানে তার লেখা প্রহসন 'তোবা টেক সিংহ' পাঠ করছিলেন। তার বক্তব্য উপস্থাপনে হলে পিনপতন নীরবতায় অনেক শ্রোতা-দর্শকের চোখে পানি দেখা গেছে। পরে তোবা টেক সিংহ নিয়ে অপর পাকিস্তানি নারী আফিয়া নাথানিয়েল ২০০৫ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
এ সময় অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যাপক ও অনেকটা এলোমেলোভাবে লেখালেখি শুরু করেন, যা তারে খ্যাতিতে কিছুটা কালিমা দেয়। শেষদিকে তিনি কখনোই কারও থেকে নিজের সমালোচনা শুনতে পারতেন না। এজন্য পরে সবাই তাকে এড়িয়ে গেছে। 
মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তার মৃত্যুতে একদিকে যেমন পাকিস্তান একজন মানবতাবাদী লেখককে হারায়, তেমনি আজও ভারত মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে এমন একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মান্টোকে। কারণ তার উল্লেখযোগ্য কর্মময় জীবন কেটেছে মুম্বাইয়ে। তাই তো মান্টোকে নিয়ে ভারতভিত্তিক 'দ্য হিন্দু'তে দেখা যায় সাম্যের জয়গান। সেখানে দাবি করা হয়, 'সবচেয়ে ভালো হতো যদি দুই দেশে মান্টোর জন্মশতবর্ষ পালিত হতো।'

ভাগ – সাদাত হাসান মান্টো

তর্জমা: সামসুদ্দোজা সাজেন

সবচেয়ে বড় সিন্দুকটাই সে বাছাই করেছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কাঠের সিন্দুকটা নাড়াতে পারল না। আরেকজন অনেক খোঁজাখুজির পর মূল্যবান কিছু না পেয়ে প্রথম ব্যক্তির নিকট এসে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার কোন সাহায্য লাগবে?'

প্রথম ব্যক্তি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে সাহায্যকারী লোকটি পেশীবহুল হাত দিয়ে ভয়ংকর ভারি সিন্দুকটি চওড়া কাঁধে তুলে নিল। রাস্তায় উঠতে উঠতেই বহনকারীর মনে হল সিন্দুকের ভারে  তার কোমর নইলে পা দুটো ভেঙ্গে যাবে। তারপরও ভাগের আশায় সে বয়ে নিয়ে চলল।

সিন্দুক দখল করা লোকটি গায়ে গতরে তেমন বলশালি ছিল না। তারপরও মালিকানা জাহিরের জন্য সে শক্ত করে একটি অংশ আঁকড়ে থাকল। তারা ধীরে ধীরে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে চলল।

নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে বহনকারী সিন্দুক নামিয়ে রাখল। কঠোর শ্রম স্বীকারকারী লোকটি এবার জানতে চাইল, 'আমার ভাগ কতটুকু?'

'চার আনা,' জবাব এল।

'ন্যায্য হল না!'

'না? মনে রেখ আমিই পেয়েছিলেম সিন্দুকটা।'

'সেটা ঠিক, কিন্তু আমিই তো পিঠে করে এতটা পথ বয়ে নিয়ে এলাম।'

'আচ্ছা, অর্ধেক অর্ধেক।'

'এই বার হল। চল দেখি ভিতরে কি আছে।'

সিন্দুক খুলতেই তরবারি হাতে এক লোক বেরিয়ে এল, তরবারির ঘায়ে দুই অংশীদারকে চার টুকরা করে ফেলল।

http://shorbojon.wordpress.com/tag/%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A4-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%8B/


পাকিস্তানঃ দেশ বিভাগ আমলের লেখক সাদাত হাসান মান্টো আজও বিদ্যমান

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Census 2010

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors