বাংলা নামের ভ‚খণ্ডে আমরা বসবাস করি, তাই আমাদের দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নাগরিক বলেই আমরা বাংলাদেশি। বাংলা ভাষায় কথা বলি, তাই আমরা বাঙালি। পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মতো আমাদেরও কোনো না কোনো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এসব কাজই আমাদের পেশা। পৃথিবীর সব দেশের মানুষের কিছু সাধারণ পেশা থাকে। যেমন কৃষিকাজ, রান্নাবান্না, ঘর তৈরি, সমাজ ও রাষ্ট্র শাসন ইত্যাদি। তাদের মতো আমাদেরও কিছু সাধারণ পেশা আছে, যেগুলো প্রাচীনকাল থেকে আমরা পালন করে আসছি। এ ছাড়া ধর্ম, জাতি, বর্ণ, সামাজিক সংস্কার, লোকাচরণ, ভৌগোলিক পরিবেশ প্রভৃতি কারণে আমাদের কিছু বিশেষ পেশার পরিচয় পাওয়া যায়। সময় ও প্রয়োজনের বিবর্তনে পেশার ধরনও বদলে যায়। প্রাচীনকালের অনেক পেশাই এখন বিলুপ্ত, আবার আধুনিককালে এমন কিছু পেশা যুক্ত হয়েছে, যেগুলো আগে কখনই ছিল না। প্রতিটি পেশার সঙ্গে অর্থনীতির রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। সব সময় মানুষ তাই-ই করে যা করে সে জীবন চালাতে পারে এবং যেটা সে করতে সক্ষম।
অতীতে বাংলার পেশার অনেকটাই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্ণ ও জাতিকেন্দ্রিক। অনেকেরই নামের শেষে পদবি দেখে বলে দেয়া যেত যে সে আসলে কী করে। যেমন নামের শেষে পাল থাকলে বুঝতে হতো সে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বানায় বা কুমার, শীল থাকলে সে নরসুন্দর বা নাপিতের কাজ করে। প্রাচীনকালে হিন্দু সমাজে ছিল দুটি বর্ণ- উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ। ব্রাহ্মণরা ছিল উচ্চবর্ণ ও শূদ্ররা ছিল নিম্নবর্ণ। শূদ্ররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। উচ্চবর্ণের লোকেরা উঁচু ধরনের কাজ করত, নিম্নবর্ণের জন্য ছিল নীচু কাজ বা উঁচু শ্রেণীর মানুষদের সেবা দান। ব্রাহ্মণরা কখনো হাল ধরত না, জমি চাষ করত না। অথচ তাদের প্রচুর জমি থাকত। সেসব জমি নিম্নবর্ণের লোকদের দিয়ে চাষ করাত। খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রচিত 'বৃহদ্ধর্মপুরাণ' ও 'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ' গ্রন্থ দুটিতেও বাংলার হিন্দু সমাজে দুটি বর্ণের কথা বলা হয়েছে। সেখানে ক্ষত্রিয় বা শূদ্রের অবস্থান ছিল না। এই দুটি বর্ণ আসে অনেক পরে। প্রাচীন বাংলার মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ। শিকারও ছিল অন্যতম পেশা। নৌকা বানানো ও নৌকা চালনাও সেকালে ছিল একটি উল্লেখযোগ্য পেশা। ধাতু দিয়ে বিভিন্ন অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি বানানোও প্রাচীন বাংলার পেশা ছিল।
বাংলার পেশাজীবীদের সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে সেসব কালের সমাজ কাঠামো সম্পর্কে একটু ধারণা থাকা দরকার। মধ্যযুগে এ দেশে থাকা হিন্দুপ্রধান সমাজে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে মুসলমানদের প্রাধান্য ও ইংরেজ, মুঘল, পর্তুগিজ, মাড়োয়ারি প্রভৃতি জাতির সংমিশ্রণ। শুরু হয় বর্ণসঙ্কর। পেশার ওপরও সেসব জাতির ক্রিয়াকর্ম প্রভাব ফেলে। অষ্টাদশ শতাব্দীতেও হিন্দু সমাজের বর্ণবিন্যাস ছিল মোটামুটি একই রকম। পরে ব্রিটিশদের আগমন ও প্রভাবে হিন্দুদের কর্মের ধরন অনুসারে চতুর্বর্ণ প্রথার উদ্ভব ঘটে। বর্ণ চারটি হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণরা রাজ্যশাসন, পুজো ও ধর্মীয় কাজ, ক্ষত্রিয়রা যোদ্ধার কাজ, বৈশ্যরা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ এবং শূদ্ররা শ্রমভিত্তিক বিভিন্ন নিম্নশ্রেণীর পেশায় জড়িত ছিল। শূদ্ররা বরাবরই নিম্নবর্ণের। শূদ্র সমাজকে তাদের পেশার ধরন অনুসারে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। উত্তম সঙ্কর বা জলচল শূদ্র, মধ্যম সঙ্কর বা জলঅচল শূদ্র এবং অধম সঙ্কর বা অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য শূদ্র। পেশা অনুযায়ী উত্তম সঙ্কর শূদ্রদের মধ্যে পড়ে বৈদ্য বা চিকিৎসক, কায়স্থ ও নবশাখরা। এই নবশাখরা হলো গোপ, মালী, তাম্বুলী, তাঁতি, শাঁখারি, কাঁসারি, কুম্ভকার বা কামার, কর্মকার ও নাপিত। এরা সবাই ব্যবসায়ী ও কারিগর শ্রেণীর। ব্রাহ্মণরা এসব শ্রেণীর লোকদের বাড়িতে পুজো করলে, পারিবারিক ক্রিয়াকর্মে যোগ দিলে বা খাবার গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণদের জাত যেত না। এদের বাড়ির জল ব্রাহ্মণরা যেহেতু গ্রহণ করতে পারে সেজন্য এদের বলা হতো জলচল শূদ্র। আর যে শ্রেণীর বাড়ির জল ব্রাহ্মণরা স্পর্শ করত না তাদের বলা হতো জলঅচল শূদ্র। এরা হলো মধ্যম সঙ্কর শূদ্র। এ শ্রেণীর শূদ্রের মধ্যে ছিল কৈবর্ত, মাহিষ্য, আশুরি, সুবর্ণ বণিক, সাহা-সুড়ি, গন্ধবণিক, বারুই বা বারুজীবী, ময়রা বা মোদক, তেলি, কুলু, জেলে, ধোপা প্রভৃতি। এ শ্রেণী মানুষের পেশা ছিল শ্রম ও ব্যবসাভিত্তিক। নীচু শ্রেণীর ব্রাহ্মণরা এদের বাড়িতে পৌরোহিত্য করতে পারতেন। কিন্তু এদের হাতে জল খেতেন না। হিন্দু সমাজ কাঠামোর একবারে নিচে অবস্থান ছিল অধম সঙ্কর বা অন্ত্যজ গোষ্ঠীর। এ শ্রেণীর মধ্যে পেশা অনুযায়ী পড়ে যুগী, চণ্ডাল, নমঃশূদ্র, পোদ চামার, মুচি, হাড়ি, ডোম, বাউরি, বাগদি প্রভৃতি জাতির লোক। বংশানুক্রমিকভাবে এই তিন শ্রেণীর পেশা চললেও সময় সময় তার কিছু ব্যত্যয় লক্ষ করা যায়। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৈদ্য ও কায়স্থরা বাংলার হিন্দু সমাজে একটি আলাদা স্তর তৈরি করতে সমর্থ হয়, স্ববর্ণ থেকে এরা কিছুটা দূরে সরে আসে। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের পেশা পরিবর্তন এরপর থেকে প্রায়ই ঘটতে থাকে। বর্তমানে হিন্দুদের সেই পেশাভিত্তিক সমাজ কাঠামো ও জাতিভেদ অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু পেশা ছাড়া তাদের বংশানুক্রমিক পেশা এখন অন্যরাও বেছে নিয়েছে। এমনকি অনেক মুসলিমও এখন হিন্দুদের বৃত্তি গ্রহণ করেছে। শীল পদবিধারী নাপিতরাই এখন আর শুধু ক্ষৌরকর্ম করে না, অন্যরাও তা করে।
মধ্যযুগে নবাবী শাসন ও মুঘলদের বাংলায় আগমন বাংলার পেশায় বিশেষ প্রভাব ফেলে। বাংলার মুসলমান নবাবরা ব্রাহ্মণদের সহজ শর্তে জমিদারি বন্দোবস্ত দিতেন। এমনকি রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে অন্য জমিদারদের মতো তাদের সঙ্গে বিশেষ কড়াকড়ি আরোপ করতেন না। এর ফলে নবাবী আমলে ব্রাহ্মণদের একটি শাখা জমিদারি পেশায় চলে আসে। নাটোরের বিখ্যাত ব্রাহ্মণ জমিদার বংশ (রামজীবন, রামাকান্ত ও রানীভবানী), মুক্তাগাছার শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরী, পুঠিয়ার জমিদার ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেক জমিদারের অধীনে ছিল গাঁতিদার বা জোতদার। তারা ছোট ভূস্বামী। জমি পত্তন নিয়ে চাষাবাদ ছিল তাদের অন্যতম কাজ। এমনকি অনেক ব্রাহ্মণ তখন জমিদারদের ম্যানেজার হিসেবেও নিযুক্ত হতেন। মুর্শিদ কুলি খাঁ থেকে সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত নবাবী আমলে রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনে যারা কাজ করত তাদের বেশিরভাগই ছিল হিন্দু কায়স্থ। মধ্যযুগে বাংলার পেশা সম্পর্কে বিভিন্ন মঙ্গল সাহিত্যে চমৎকার কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর লিখিত অন্নদামঙ্গল কাব্যে তৎকালীন সমাজে বাংলার হিন্দুদের বর্ণপ্রথা ও পেশা বা কাজ নিয়ে এক সুন্দর বর্ণনা রয়েছে-
'ব্রাহ্মণমণ্ডলে দেখে বেদ অধ্যয়ন।
ব্যাকরণ অলঙ্কার স্মৃতি দরশন।।
ঘরে ঘরে দেবালয় শক্সখ ঘণ্টারব।
শিবপুজো চণ্ডীপাঠ যজ্ঞ মহোৎসব।
বৈদ্য দেখে নাড়ি ধরি কহে ব্যাধিভেদ।
চিকিৎসা করয়ে তারে কাব্য আয়ুর্ব্বেদ।
কায়স্থ বিবিধ জাতি দেখে রোজগারি।
বেনে মণি গন্ধসোনা কাঁসারি শাঁখারি।।
গোয়ালা তামুলী তিলী তাঁতী মালাকার।
নাপিত বারুই কুরী কামার কুমার।।
আগরি প্রভৃতি আর নাগরী যতেক।
যুগী চাসাধোবা চাসাকৈবর্ত্য অনেক।।
সেকরা ছুতার নুড়ি ধোবা জেলে শুঁড়ি।
চাঁড়াল বাগদি হাড়ি ডোম মুচি শুঁড়ি।।
কুরমী কোরঙ্গা পোদ কপালী তিয়র।
কোল কালু ব্যাধ বেদে মাল বাজিকর।।
বাইতি পটুয়া কান কসবি যতেক।
ভাবক ভক্তিরা ভাঁড় নর্তক অনেক।।'
উপরোক্ত এই ছোট্ট একটি বর্ণনার মধ্যেই মধ্যযুগে কবির ভাষাতে ৪৮টি
পেশার মানুষ উঠে এসেছে। তেমনি কোন পেশার লোকের কী কাজ তারও সংক্ষেপে উল্লেখ রয়েছে।
১৮৩৭ সালে ভারত থেকে রেভারেন্ড উইলিয়াম টুইনিং লিখিত ÔSeventy-two Specimens of Castes in India' নামে ক্রিস্টিয়ান মিশনারিদের জন্য একটি বই প্রকাশিত হয়। সে বইয়ে লেখক তার ২৫ বছরে ভারতবর্ষে দেখা ৭২টি বিভিন্ন জাতি ও পেশার লোকদের এক চমৎকার চিত্র তুলে ধরেন। পেশাভিত্তিক সে জাতিপ্রথায় তিনি ব্রাহ্মণ, পুরোহিত, পূজারী, মুসলিম সাধক, মৌলভী-মাওলানা, মোয়াজ্জিন, রাজা-বাদশা, জমিদার, জোতদার, সেরি ব্রাহ্মণ, বণিক বা সওদাগর, সংগীত শিল্প, গোহালা, ধোপা, মুচি, দর্জি, সৈনিক, লেখক, স্বর্ণকার, কামার, কুমার, কোচোয়ান, মালি প্রভৃতি পেশাজীবীদের উল্লেখ করেন। এসব পেশাজীবী শুধু হিন্দুই ছিল না, ছিল মুসলিম, মাড়োয়ারি ও শিখরাও।
খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার মুসলমান সমাজের গড়ন ছিল হিন্দুদের চেয়ে ভিন্ন। সমকালীন বাংলার মুসলমান সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করা হতো- আশরাফ, আজলফ বা আতরাফ ও আরজল। আশরাফ উচ্চ শ্রেণী, আতরাফ সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, বৃত্তিধারী মানুষ, কারিগর, শিল্পী, দোকানদার, জোলা, তাঁতি ইত্যাদি। আরজাল পতিত শ্রেণী। এ শ্রেণীর পেশাজীবীরা হলো বেদে, চামার, বাজিকর প্রভৃতি। ধর্মের ও সমাজের সঙ্গে এদের তেমন যোগাযোগ ছিল না। তৎকালীন মুসলমান সমাজে আশরাফ ছিল শতকরা ২০ ভাগ, আতরাফ ছিল শতকরা ৭৫ ভাগ ও আজলাফ ছিল শতকরা ৫ ভাগ।
আধুনিক যুগে এসে বাংলার পেশায় অনেক পরিবর্তন এলেও কৃষি এখনো প্রধান পেশা, দেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া আরো যেসব পেশা বর্তমানে লক্ষ করা যাচ্ছে সেগুলো হলো শ্রমিক, দিনমজুর, কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, ধোপা, নাপিত, তেলি বা কুলু, মাঝি, বেদে, সাপুড়ে, মান্তা, পাহারাদার, চৌকিদার, চাকুরে, ডোম, কাঠমিস্ত্রি, করাতী, কাঠুরে, রাজমিস্ত্রি, মেথর, লেখক, বই বাঁধাইকারী, মুদ্রণকারী, মালি, পেশকার, পাচক, সেবিকা, শিক্ষক, রঙমিস্ত্রি, সাইনবোর্ড লেখক, দোকানদার, রাজনীতিবিদ, অভিনেতা, আমলা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, কবিরাজ, ব্যবসায়ী, রিকশাওয়ালা, গাড়িচালক, পরিবহন শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, পিঠা বিক্রেতা, গায়ক, গীতিকার, সুরকার, কম্পিউটার কর্মী, গার্মেন্টস শ্রমিক. বিমানবালা, নাবিক, সার্কাস প্রদর্শক, গাড়ি মেকানিক, কাঁসারু বা কংসবণিক, গন্ধবণিক, সুবর্ণবণিক, কসাই, জ্যোতিষী, কুলি, ধাত্রী, গুণিন, ওঝা, পুঁথিলেখক, পুঁথিপাঠক, ময়রা, গোয়ালা, মন্ত্রী, পুলিশ, সেনা, ট্রাফিক, চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, প্রতারক, মুদি, পতিতা, নর্তক-নর্তকী, দর্জি, চলচ্চিত্র নির্মাতা, টেলিভিশন শিল্পী, রেডিও শিল্পী, সাংবাদিক, সংবাদকর্মী, বন প্রহরী, বিজ্ঞানী, পুরোহিত, মাওলানা, দার্শনিক, বিচারক, খেলোয়াড়, উকিল, দাস-দাসী, জাদুকর, চিত্রশিল্পী, ঢুলি বা শব্দকর, টাওরা বা শূকরপালক, অর্থনীতিবিদ, পাটনি বা খেয়া নৌকার মাঝি, ভাঁড় বা কমেডিয়ান, বারুজীবী বা বারুই, ভিক্ষুক, স্থপতি, পরিবেশবিদ, আলোকচিত্রী, ধারাভাষ্যকার, বিজ্ঞাপনকর্মী, পাখাল বা পাখি বিক্রেতা, মলঙ্গী, কাজী, খলিফা, ভেণ্ডার, নোটারি পাবলিক, অনুবাদক, কাগতী বা কাগজ প্রস্তুতকারী, রাখাল, ঠিকাদার, পীর, ফাটকা কারবারি বা শেয়ার ব্যবসায়ী, জাহাজের খালাসি ইত্যাদি। এই পেশাগুলোর মধ্যে নিচে কয়েকটি পেশার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
দেয়া হলো-
কৃষক : বাংলার প্রধান পেশা হলো কৃষিকাজ। দেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হলো কৃষক। তারা জমি চাষ করে, ফসল ফলায়, ফসল কাটে, মাড়াই করে ও শুকিয়ে গোলাজাত এবং বিক্রি করে। কৃষাণীরা ফসল কাটার পর বাড়িতে বিভিন্ন কাজ করে, বীজ রাখে ও বীজ বোনে, বাড়িতে শাক সবজি ও ফলগাছ লাগায়। কৃষকরা অনেকেই বাড়িতে হাঁস-মুরগি, ছাগল ও গরু পালন করে। প্রাচীনকালে অধিকাংশ আবাদি জমি ছিল জমিদার, জায়গীরদার, নিষ্কর লাখেরাজ ভোগীদের দখলে। সাধারণ ও দরিদ্র কৃষকরা তাদের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করত। এখনো অনেক ভ‚মিহীন কৃষক জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে। কৃষকদের অধিকংশই এখনো ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণীর, দরিদ্র।
কুমার : নদীবিধৌত পলিমাটির বাংলার মৃৎশিল্পের এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য রয়েছে। সে ঐতিহ্যের রূপকার হলো কুমোর বা কুমার শ্রেণীর পেশাজীবীরা। কুমাররা মাটি দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন। এ দেশে কুমার শ্রেণী সাধারণত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত, তারা 'পাল' পদবিতে পরিচিত। নরম কাদা মাটি দিয়ে নিপুণ কৌশলে গড়ে তোলেন বিভিন্ন তৈজসপত্র ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার্য সামগ্রী। কুমাররা হাঁড়ি, কলসি, ঘড়া, ঘাগড়া, সানকি, প্রদীপ, পাঁজাল বা ধুপতি, গ্লাস, বদনা, ঝাঁঝর, চাড়ি, মটকি, পিঠার সাঝ, সরা, ঢাকন, বাটি, ফুলের টব, পুতুল, প্রতিমা, মূর্তি ইত্যাদি তৈরি করেন। এঁটেল মাটি হলো এসব সামগ্রী তৈরির প্রধান উপকরণ। কুমাররা এসব সামগ্রী তৈরি করতে চাকযন্ত্রও ব্যবহার করে থাকেন। কাঁচা মাটি দিয়ে এসব সামগ্রী বানানোর পর পুড়িয়ে ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে রঙ করে সেগুলো বাজারে বা গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করেন। অতীতে নৌকা বোঝাই করে এসব সামগ্রী নিয়ে পাল মশাইরা কয়েক দিনের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। মাটির এসব সামগ্রী তৈরিতে কুমারদের স্ত্রী ও মেয়েদেরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বৈশাখ মাস হলো তাদের মলো মাস, এ মাসে তারা কোনো মাটির জিনিস তৈরি করে না, শুধু বিক্রি করে। অধিকাংশ কুমার শিবের উপাসক। প্রাচীনকাল থেকেই এসব সামগ্রী বাংলার মানুষেরা নিত্যপ্রয়োজনে ব্যবহার করে আসছে। সম্প্রতি আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় সেই শিল্পে অনেকটা ভাটা পড়েছে। এখন শহরের প্রায় সবাই ধাতব, প্লাস্টিক, মেলামাইন ও চীনামাটির বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহার করায় কুমার শ্রেণীর পেশা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। তবে নতুন করে মৃৎশিল্পের আর একটি শাখা উন্মোচিত হয়েছে। সেটি হলো নান্দনিক মৃৎশিল্প। ঢাকার প্রায় ৭০০ দোকানে এসব শৌখিন মৃৎসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে। পটুয়াখালী হলো এসব পেশা শিল্পীদের পীঠস্থান।
কাঁসারু বা কংসবণিক : কাঁসা শিল্প এ দেশের এক ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। এ শিল্পের কারিগরদের বলা হয় কাঁসারু। তারা ঠাটারি নামেও পরিচিত। তারা তামা, পিতল ও কাঁসা ধাতু দিয়ে সুন্দর সুন্দর সামগ্রী তৈরি করতে পারে। সাধারণত গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার করা যায় এমন সব জিনিসই তারা তৈরি করেন। যেমন বদনা, ঘটি, পান পাত্র, থালা, গ্লাস, আগরদানি, কলসি, প্রদীপদানি, প্রদীপ, দীপাধার, গোলাপজলদানি, ডেকচি, হাঁড়ি-পাতিল, বাটি, কাপ, গাড়–, রেকাবি, চিলমচি, পাঞ্চালি, চামচ, হাতা, গড়গড়া, বালতি, তামাড়ি, ঘণ্টা, খুন্তি, ধুনুচি, কাজলচি ইত্যাদি। কাঁসারুরা হিন্দু সম্প্রদায়ের এক বিশেষ শ্রেণীর লোক। তারা দেবতা শিবের অনুসারী। তবে এখন আর কাঁসাশিল্পে হিন্দুদের সেই আগের একাধিপত্য বজায় নেই। এখন অন্য সম্প্রদায়ের লোকও কাঁসাশিল্পে জড়িত হয়ে পড়েছেন। তাই তাদেরও কাঁসারু নামে ডাকা হয়। ঢাকা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কাঁসারুদের দেশব্যাপী খ্যাতি রয়েছে। ঢাকার বিক্রমপুর ও টাঙ্গাইলের কাগমারী কাঁসাশিল্পের জন্য সুবিখ্যাত। কাগমারীর তৈরি কাঁসার কলস কাগমারী কলস নামে পরিচিত। এখন স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও অ্যালুমিনিয়ামের সামগ্রী আসায় কাঁসাশিল্পে ভাটা পড়েছে। ফলে কাঁসারুদের এখন দুর্দিন চলছে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জবাসী তাদের সেই পুরনো ঐতিহ্যকে এখনো ধরে রেখেছেন। এখনো সেখানে কাঁসার সামগ্রী ছাড়া কোনো বিয়ে হয় না। এখন এক কেজি ওজনের কাঁসার কোনো সামগ্রী কিনতে প্রায় ১০০০-১২০০ টাকা লাগে। এগুলো পরিচ্ছন্ন ও ঝকঝকে করে রাখাও আধুনিক গৃহিণীদের জন্য কঠিন। এ ছাড়া এসব ধাতুর আমদানি বন্ধ হওয়ায় সেই পুরনো কাঁসা-পিতলের সামগ্রীই নতুন করে তৈরি হচ্ছে।
স্বর্ণকার : স্বর্ণকাররা সোনা-রুপার গহনা তৈরি করে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের কিছু পোড়ামাটির ফলকে মেয়েদের স্বর্ণালঙ্কার পরার প্রমাণ দেশে দেখা যায়। মহাস্থানগড়ের পোড়ামাটির ফলকেও সেরূপ চিত্র উৎকীর্ণ রয়েছে। তবে মুঘল আমলে মূলত সুবে বাংলায় স্বর্ণশিল্প ও স্বর্ণকারদের বিকাশ ঘটে। অষ্টাদশ শতকে ঢাকার তাঁতীবাজারে স্বর্ণকারদের বাণিজ্যালয় গড়ে ওঠে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৪শ সোনার দোকান রয়েছে। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারেও অনেক স্বর্ণকার আছে। দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে স্বর্ণকার নেই। তবে সোনার অব্যাহত দাম বৃদ্ধিতে অনেক স্বর্ণকার এখন কাজ না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন।
মালাকার : মালাকার গোত্রের লোক সোলা দিয়ে বিভিন্ন সামগ্রী যেমন মালা, সোলার ফুল, টোপর, খেলনা ইত্যাদি তৈরি করে। সোলাগাছ এ দেশে জলাভূমিতে জন্মানো এক ধরনের গাছ। সেই গাছ কেটে নিপুণ হাতে তারা এসব সামগ্রী তৈরি করেন। এসব সামগ্রী মূলত পুজো, বিয়ে ও খেলনা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাগুরা, ঝিনাইদহ, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় মালাকার সম্প্রদায়ের বাস।
বাজিকর : আমাদের দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিশেষ করে পুজো-পার্বণ ও বিয়েতে আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ করার এক অতীত ঐতিহ্য রয়েছে। পঞ্চদশ শতক থেকে আতশবাজি জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। এসব বাজি তৈরির পেশায় যারা জড়িত তারা বাজিকর নামে পরিচিত। আবার জুয়াড়িদেরও বাজিকর বলা হয়। এরা জুয়া খেলায় বাজি ধরে। এটাও এক ধরনের পেশা। বাজি পোড়ানোয় এখন সরকারি নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করায় সে ঐতিহ্যে ভাটা পড়েছে। তাই বাজিকরদের পেশাও বিলুপ্ত হতে চলেছে।
তাঁতি : তাঁতিদের কাজ হলো তাঁতে কাপড় বোনা। প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদেও তাঁতি ও তন্তুবয়নের উল্লেখ আছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও তাঁতিদের বোনা কাপড় মনের মতো, ¯িœগ্ধা, দুকুল, পত্রানন্দ, খৌমা ইত্যাদির উল্লেখ আছে। প্রাচীন ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। এখনো ঢাকাই জামদানি ও বেনারসি শাড়ির যথেষ্ট কদর রয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই তাঁতি আছে। তাঁতিরা প্রধানত শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ধুতি, গেঞ্জি ইত্যাদি বোনেন।
কামার : বিভিন্ন ধাতব সামগ্রী বিশেষ করে লোহা দিয়ে কামাররা নানান জিনিস তৈরি করে। কোদাল, কাস্তে, শাবল, গাঁইতি, হাতুড়ি, বাটাল, দা, বঁটি, ছুরি, কাঁচি, কোচ, বর্শা, বাসন-কোসন ইত্যাদি তারা তৈরি করেন। এদের কেউ কেউ কর্মকারও বলেন। এরা দেবতা বিশ্বকর্মার উপাসক। প্রাচীনকালে রাঢ় অঞ্চলে প্রচুর লোহা উৎপন্ন হতো। ওই সময় বাঙালিদের ধাতুশিল্পে বেশ দক্ষতা ছিল। কামাররা হাপর চালিয়ে লোহাকে গরম করে পিটিয়ে বিভিন্ন ধরনের ধারাল অস্ত্র
তৈরি করেন।
জ্যোতিষী : বাঙালির লৌকিক জীবনে পঞ্জিকা ও জ্যোতিষীর এক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পঞ্জিকা দেখে ও তিথি-নক্ষত্র বিচার করে জ্যোতিষীরা বাঙালি জীবনের নানা ক্রিয়াকর্মের শুভাশুভ নির্ণয় করে দিতেন। এসব ক্রিয়াকর্মের মধ্যে ছিল গৃহারম্ভ, গৃহপ্রবেশ, বিয়ে, জন্মানুষ্ঠান, অন্নপ্রাশন, নৌকা গড়া, নৌকা চালনা, ক্রয়বাণিজ্য,
বীজ বপন, গ্রহপুজো, ধান কাটা,
নাট্যারম্ভ ইত্যাদি।
গুণিন ও ওঝা : অস্ট্রিক যুগ থেকেই বাংলার লোকজীবনে প্রভাব ফেলেছিল বিভিন্ন ধরনের ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া। ফলে লৌকিক জীবনে ওঝা ও গুণিন পেশার লোকদের আবির্ভাব ঘটে। এরা বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচ্চাটন, মারণ, বাণ মারা, গুণ করা ইত্যাদি কাজ করতে পারে বলে লোকে বিশ্বাস করে। সাপে কামড়ালে বিষ নামানোর জন্য ওঝা বা রোজা পেশার লোক রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এরা শুধু সাপে কামড়ানোর চিকিৎসাই করে না, এরা বাটি চালান, চালপড়া, নখদর্পণ, ভ‚ত ছাড়ানো ইত্যাদি কাজ করে থাকে।
জেলে : জেলেরা নদীতে মাছ ধরে। সুপ্রাচীনকাল থেকে এ দেশে জেলে সম্প্রদায় মাছ ধরার পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। দেশে প্রায় ১৪ লাখ জেলে রয়েছে। নদী, খাল, সাগর প্রভৃতি জায়গায় জাল টেনে তারা মাছ ধরে। জেলেরা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৮৭২ সালে লিখিত ডব্লিউ হান্টার বর্ণনাতে সেকালে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমান সম্প্রদায়ের জেলেদের উপস্থিতিও দেখা যায়। সেকালে হিন্দু জেলেদের মধ্যে ২৩টি গোত্রের অস্তিত্ব দেখা যায়। এগুলো হলো কৈবর্ত্য. কেওয়াট, কারিতা, তেওয়ার বা রাজবংশী, দাস শিকারি, মালো বা জালো, চণ্ডাল, বেরুয়া, জিয়ানি, করাল, পোদ বা বিন্দু, বাগদি, পাটনি, নদীয়াল, মালি হারি, গোনরি, বানপুর, গাঙ্গোতা, মুরারি, সুরাইয়া ও লোহিত। মুসলিম সমাজে জেলেরা নিকারি, ধাওয়া, আবদাল ইত্যাদি বলে পরিচিত। তারা মাছ ব্যবসায়ের সঙ্গেই বেশি জড়িত।
গার্মেন্ট শ্রমিক : এ দেশে গার্মেন্ট শিল্পে বর্তমানে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক নিয়োজিত। দেশে প্রায় ৪৮২৫টি গার্মেন্ট কারখানায় বর্তমানে ৩৫ লক্ষ শ্রমিক কাজ করছে। এ পেশার অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। গার্মেন্ট শিল্প এখন দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশের জোগান দিচ্ছে। এসব কারখানায় কাজ করে একজন শ্রমিক মাসে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করছে।
মলঙ্গী : চট্টগ্রামের লবণ উৎপাদনকারীরা মলঙ্গী নামে পরিচিত। সাগরের লোনা পানি মলঙ্গীরা জমিতে আল বেঁধে আটকে রোদে শুকিয়ে লবণ তৈরি করত। লবণ তৈরির এসব ক্ষেত্রকে বলা হয় তোফল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে বছরে ৭৯ থেকে ৯৯ হাজার মণ লবণ উৎপাদিত হতো। কিন্তু ব্রিটিশরা পরবর্তীতে সাগরের পানি শুকিয়ে লবণ উৎপাদনে বাদ সাধে। তারা মলঙ্গীদের লবণ উৎপাদনে জেলজরিমানা ও জুলুমের হুকুম জারি করে এবং ইউরোপ থেকে এ দেশে লবণ আমদানি শুরু করে। ফলে মলঙ্গীদের জীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। এখন অবশ্য কক্সবাজার, টেকনাফ, মহেশখালী প্রভৃতি এলাকায় প্রচুর লবণক্ষেত্র রয়েছে। অতীতে ভোলার মনপুরা দ্বীপেও লবণ উৎপাদিত হতো।
কাগতী : প্রাচীনকালে কাগতীরা কাগজ তৈরির পেশায় নিয়োজিত ছিল। মধ্যযুগে হাতে তৈরি কাগজের প্রচলন ছিল। হাতে তৈরি কাগজকে বলা হতো হৈত্যালী কাগজ। তুলট কাগজের প্রচলনও ছিল। চট্টগ্রাম ছিল এসব কাগজ তৈরির অন্যতম প্রধান স্থান। তাই চট্টগ্রামবাসীর মুখে হরিতালী কাগজ হয়ে ওঠে হৈত্যালী কাগজ। কাগতীদের হাতে তৈরি এসব কাগজ হাজার বছরও টেকসই হতো বলে চট্টগ্রামের সমাজ সংস্কৃতির রূপরেখা গ্রন্থের লেখক আবদুল হক চৌধুরী উল্লেখ করেছেন।
বারুজীবী : হিন্দু সম্প্রদায়ের নবশাখ শাখার একটি অন্যতম পেশার লোক হলো বারুজীবী বা বারুই। মুসলমানরা সাধারণত এ পেশায় আসে না। বারুইরা পান উৎপাদন ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। যশোর, খুলনা, নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ, বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি জেলায় অনেক বারুই আছে। পানের বরজ তৈরি করে বলেই এদের বারুই বলা হয়। বারুইরা এখন অনেকেই লেখাপড়া শিখে তাদের পেশা পরিবর্তন করছে। শতাধিক বছর আগে যশোরে প্রধান উকিল যদুনাথ মজুমদার বেদান্তবাচস্পতি বিদ্যাবারিধি বারুই জাতির উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি খুলনা বিএল কলেজের অন্যতম ট্রাস্টি। এ ছাড়া কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারও একজন বারুই ছিলেন। খুলনার মহেশ্বরপাশায় আর্ট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শশীভূষণ পালও ছিলেন বারুই সম্প্রদায়ের লোক। এসব নাম থেকে আমরা বারুই শ্রেণীর লোকদের পদবি ব্যবহারের কিছু নমুনা পাই। তারা সরকার, সমাদ্দার, দে বিশ্বাস প্রভৃতি পদবি নামের শেষে ব্যবহার করেন। বারুইদের কেউ কেউ মৌজার অধিকারপ্রাপ্ত হওয়ার পর মজুমদার পদবি ধরেন। যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের লেখক সতীশচন্দ্র মিত্র এদের বৈশ্য বারুজীবী বলে উল্লেখ করেছেন।
লেখক আবদুল হক চৌধুরী 'চট্টগ্রামের সমাজ সংস্কৃতির রূপরেখা' গ্রন্থে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর এ দেশে পেশাদার বিভিন্ন শ্রমিকের মাসিক মজুরি, আয় বা বেতন কীরূপ ছিল তার একটি তালিকা দিয়েছেন। এর সঙ্গে সমকালীন পেশার শ্রমিকদের মজুরির একটি তুলনামূলক চিত্র পাঠকদের জন্য তুলে দিলামÑ
প্রথমোক্ত সময়ে টাকায় প্রায় দেড় মণ চাল পাওয়া যেত। দ্বিতীয়োক্ত সময়ে দেড় মণ সাধারণ চালের দাম প্রায় ২ হাজার ৪শ টাকা। এ থেকে সেকালের বিভিন্ন বৃত্তিধারী বা পেশার মানুষের জীবনযাত্রার একটি সরল তুলনা করা যায়। এ ছাড়া আবদুল হক চৌধুরী তৈরি উপরোক্ত তালিকায় সে সময়ের সমাজে প্রধান বা সাধারণ বৃত্তিধারীদের একটি পরিচয় পাওয়া যায়। সে যুগে খানসামা, বাবুর্চি, ছুতার প্রভৃতি পেশার মানুষের আয় বেশি ছিল বলে দেখা যায়। কারিগর শ্রেণীর আয় অন্য শ্রমিক শ্রেণীর আয়ের চেয়ে বরাবরই বেশি ছিল ও আছে। অন্যদিকে কৃষকদের আয় সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। অথচ সেকালেও কৃষকরা ছিল সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক।
সমকালীন বাংলার পেশাদারি লোকদের মোটামুটি তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণী হলো রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্র পরিচালক। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, অন্যান্য জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিবিদ প্রমুখ এই শ্রেণীর পেশায় জড়িত। অনেকটা প্রাচীনকালের রাজা বা জমিদারদের মতো। দ্বিতীয় শ্রেণী হলো চাকরিজীবী ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। রাষ্ট্রের ও সমাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই শ্রেণীর লোকেরা বেতন নিয়ে সেবা করেন বা চাকরি করেন। এরা শিক্ষিত বা ¯^ল্প শিক্ষিত। আমলা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, ব্যাংকার, গার্মেন্ট শ্রমিক, বিমানবালা, লেখক প্রমুখ এই শ্রেণীর লোক। প্রাচীনকালে এসব শ্রেণীর অনেকে ছিলেন রাজকর্মচারী। তৃতীয় শ্রেণী হলো সমাজের সেবাদানকারী বা সাধারণ বৃত্তিধারী লোক। কৃষক, কুলি, দিনমজুর, শ্রমিক, কুলু, কুমার, ধোপা, জেলে, কামার, বণিক, মুচি, মেথর, ডোম, মালী প্রভৃতি এই শ্রেণীর লোক। পেশার এই পিরামিডে সবচেয়ে ওপরের অবস্থানে আছে রাজন্য ও রাজনীতিবিদরা, মধ্য অবস্থানে রয়েছে চাকরিজীবীরা এবং নিচের স্তরে রয়েছে সেবাদানকারীরা। আয়ের ক্ষেত্রেও এরূপ স্তরবিন্যাসের একটি সামঞ্জস্য রয়েছে।
লেখক : কৃষিবিদ ও গবেষক
পেশা বা বৃত্তিধারী সময়কাল ২৪ জুলাই, ১৭৭৬* সময়কাল : ৫ এপ্রিল ২০১২
খানসামা ৭.০০ টাকা ১৫০০০ টাকা
বাটলার ৪.০০ টাকা ১৫০০০ টাকা
বাবুর্চি ৬.০০ টাকা ২০,০০০ টাকা
মুটে ২.৫০ টাকা ৮০০০ টাকা
কম্পাউন্ডার ২.০০ টাকা ৭৫০০ টাকা
হেডপিয়ন ৫.০০ টাকা ৯০০০ টাকা
পিয়ন ২.০০ টাকা ৬০০০ টাকা
মেটার্স ১.৫০ টাকা -
হরকরা ২.০০ টাকা ৬০০০ টাকা
সহিস ৩.০০ টাকা ৬০০০ টাকা
মশালচি ১.৫০ টাকা -
হুকাবরদার ৬.০০ টাকা -
দরজি ২.০৬ টাকা ১৫০০০ টাকা
ধোপা ২.০৬ টাকা ৬০০০ টাকা
ইস্ত্রিকারক ২.০৬ টাকা ৪০০০ টাকা
মুচি ২.০৬ টাকা ৭৫০০ টাকা
কামার ২.০৮ টাকা ৮০০০ টাকা
কুমার ৩.০০ টাকা ৪০০০ টাকা
চপ্পরবন্দ ২.০০ টাকা -
বজরার মাঝি ৩.৫০ টাকা -
ঘাসুড়ে বা ঘাসকাটুরে ১.২৫ টাকা ৩০০০ টাকা
হেড বেয়ারার ২.০০ টাকা ৮০০০ টাকা
বেয়ারার ১.৫০ টাকা ৫০০০ টাকা
মালী ২.০০ টাকা ৭০০০ টাকা
কুলিমাঝি বা সর্দার ১.৫০ টাকা ৯০০০ টাকা
কুলি ১.২৫ টাকা ৬০০০ টাকা
ইট নির্মাতা ২.০০ টাকা ৬৬০০ টাকা
ছুতার মিস্ত্রি ৭.০০ টাকা ১০৫০০ টাকা
ছুতার শ্রমিক বা হেলপার ২.০০ টাকা ৭৫০০ টাকা
জাহাজের খালাসি ৪.০০ টাকা -
http://www.shaptahik-2000.com/?p=1206
বাংলা ভাষা নিয়ে ভ্যানতাড়া
সাদা চামড়ার সায়েবরা যদ্দিন এদেশের মাথায় বসেছিল তদ্দিন বাপ বলে ইংরিজি বুলিটা রপ্ত করতে হত ৷ নইলে লোকজনের ভিড়ে ভদ্দরলোক বলে কল্কে মিলত না, বাপের ঠাকুর লালমুখোদের তোয়াজ করে নানান ধান্দা করার উপায় থাকত না, আঙুলে থুতু লাগিয়ে নোট গোণা যেত না ৷হেয়ার কলিন পামরশ্চ কেরী মার্শমেনস্তথা ৷ পঞ্চগোরা স্মরেনিত্যং মহাপাতকনাশনম্ ৷৷ — তার মানে ঘুম থেকে ধরমর করে উঠে চোদ্দপুরুষের আউড়ানো পঞ্চকন্যার নাম খেয়ে ফেলে তার বদলে পঞ্চগোরার নাম আউড়েও দিনভর গোরাদের হাতে কেলানি খাওয়ার ভয়ে চিমসে মেরে থাকতে হত ৷ অবশ্যি ওরই ফাঁক-ফোকরে, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে, হরেক কিসিমের ফন্দি-ফিকির করে ফায়দা লোটার চেষ্টা-চরিত্তির চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না ৷ আর ইংরিজিতে বুকনি ঝাড়তে পারলে হেভি সুবিদে হত — সায়েব ফাদার সায়েব মাদার বলে লালমুখোদের এঁড়ে তেল মাখানো যেত, মজাসে দিশি ছোটলোকদের চমকানো কি টুপি পরানো যেত ৷ তবু ইংরেজিওয়ালা টপ্ টপ্ ভদ্দরলোকদের মনটা চুপসে থাকত৷ চব্বিশ ঘন্টা গটমট ইংরিজি বলেও গোরা সায়েবগুলোর মেজাজ ঠাণ্ডা রাখা দায়, দিনে পাঁচশবার ঝাড় খেতে হয়, বিলিতি খিস্তিখাস্তা মুক বুজে হজম করতে হয়, মায় চুনোগলির বেজম্মা ফিরিঙ্গিগুলো অব্দি ব্লাডি নিগার বলে মা-মাসি তোলে ৷ তাই মান-ইজ্জতে পয়জার খাওয়া ইংরিজিতে এগ্গাদা পাশ দেওয়া ভদ্দরলোকদের অনেকে মায়ের মুকের ভাষায় গপ্পো-কবতে কি বইপত্তর লিখে বা পড়ে একটুখানি সোয়াস্তি পেতেন ৷ ঐ বাঙালিপনাটা ছিল বাবুদের বুকের বেথার মলম, ওটা ছিল সায়েবদের হুকুমদারির বাইরে ৷ খিদিরপুরের মদুসুদন দত্ত থেকে হাটখোলার সুদিন দত্ত পজ্জন্ত কোট-প্যান্টুলুন পরা বহুত তাবড় তাবড় দিশি ইংরিজিোয়ালাদের বাংলা বাজারটাই ছিল মাতা গোঁজার ঠেক ৷
তারপর বাপ-ঠাকুদ্দার আমলের সেসব সখের প্রাণ গড়ের মাঠের দিন ভোগে গেল ৷ দু-দুটো লড়াইয়ের হেভি কিচাইন, তিরিশের টাইমে দুনিয়া জুড়ে মালগন্ডার মন্দা — সায়েবদের জান কয়লা — বলা যায়, ও দুটো রগে উঠে গেল! দেখা গেল শেষমেশ সায়েবের বাচ্চারা ফুটল ৷ তবে ওটা শুধু চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য,আসলে গোরারা রামু শামুর মতো ভোট পবলিককে ঢপের চপ গেলাল ৷ ব্রিটিশ লালমুখোগুলো নামকা ওয়াস্তে সটকে পড়ল, আসল ব্যাপারটা হল, একা শুধু ব্রিটিশ গোরারা নয় তাবৎ লালমুখোরা যেসব দেশ জবরদখল করে তার মাথায় গেঁড়ে বসেছিল সেগুলো একটার পর একটা লোক দেখানো কায়দায় ছেড়ে দিয়ে সবাই মিলেঝুলে একাট্টা হয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াবে বলে ঠিক করল ৷ মারদাঙ্গা করে, তার ওপর আবার বন্দে মাতাগরম বন্দে পেটগরমের ঝক্কি সামলে সায়েবদের আর পোষাচ্ছিল না, লাভের গুড় মাছিতে খাচ্ছিল ৷ ওদের মাথায় বাওয়া জিলিবির প্যাঁচ — ওরা দেশটাকে ভেঙে দুটুকরো করে রামওয়ালা আর আল্লাহো-আকবরওয়ালাদের মধ্যে বেঁটে দিল, যাতে দুদলের কামড়াকামড়ি লেগে থাকে, তাঅলে ঘোলা জলে নির্ঝঞ্ঝাটে মাছ ধরা যাবে, হরবকত পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ানোর সুবিদে হবে ৷ বলতে কী সব সায়েবে মিলেঝুলে পেছন থেকে সুতো টানতে পারলে আর কোনো ঝক্কি পোয়াতে হবে না, মস্তিসে রস নিঙড়ে চুক চুক করে খাওয়া যাবে — হারামির বাচ্চা দিশি কেলে ভূতগুলো জাতির বাপের মতো নেংটি পরে আঁটি চুষবে ৷ এদ্দিন যারা সায়েবদের কাগজে পোছা হেগো পোঁদ চেটে এসেছে, গোরারা সেই দিশি ইংরিজিওয়ালাদের অত্থাৎ কিনা মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের তখতে বসিয়ে দিয়ে গেল ৷ ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালারা সায়েবদের ফেলে যাওয়া চেয়ারে সব গ্যাঁট হয়ে বসল, হয়ে উঠল গোরাদের নতুন ফিকিরের আড়কাঠি ৷ লালমুখোদের সুতো টানার মন্তর হয়ে থাকল ইংরিজি বুলি ৷ আর মেকলে সায়েবের ঐ বেজম্মা নাতিপুতিদের ছকে ইংরিজি বুলিটা দেশে আরো জবরদস্তভাবে মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসল ৷ নয়া জমানায় ঐ কেলে ইংরিজিওয়ালাদের আর মাতা গোঁজার ঠেকের দরকার রইল না, ওরাই হয়ে উঠল দেশের মাতা — কথায় বলে, ছাতুবাবু লাটুবাবু হয়ে গেল গায়েব ৷ এবার সায়েব তো সায়েব কেলে সায়েব ৷৷ কিম্বা, রাধাকান্ত নবকেস্ট একে একে গেল সবাই অক্কা ৷ এখন শুধু কেলে সায়েবরা মেরে যাচ্ছে দানে দানে ছক্কা ৷৷ ওদের সবাই — মেজ সায়েব, সেজ সায়েব, ছোট সায়েব আর ন সায়েবরা সবাই সুটবুট চাপিয়ে ভাসন দিতে লাগল — ইংরিজি হল আমাদের দিশি ভাষা নিজের ভাযা ৷ ও ভাষা ছাড়লে চলবে না ৷ আর বিলিতি ধলা সায়েবরা হল গিয়ে আমাদের দাদা ৷ (না না, মায়ের পেটের ভাই নয়, তুতো দাদা ৷ কোন তুতো? খুড়তুতো?মাসতুতো? পিসতুতো? নারে বাঞ্চোত না, ওসব দিশি তুতো নয়, খাঁটি বিলিতি সম্পক্ক — গাঁড়তুতো) ৷
সায়েবি জমানায় মদুসুদন দত্ত থেকে ভবানী ভটচায্, সরোজিনী নাইডু অব্দি নেটিভদের বেশ দুচারজন ইংরিজিতে বই ছাপাত ৷ সায়েবদেরতো কথা বাদই দাও, এমন কী দিশি ভদ্দরলোকরাও তাদের বড় একটা পাত্তা দিত না ৷ লোকজন বলাবলি করত, ওসব হল গিয়ে ফিরিঙ্গি লেখা — অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান রাইটিং । এবার লালমুখোরা দেখল, ইংরিজি বুলিটা দেশের ঘাড়ে যত চেপে বসছে ওদের আঁখ মাড়াইয়ের কল গরগর ঘরঘর করে ততই বেড়ে চলছে, তেল দিতে হচ্ছে না। তাই ফায়দা তোলার আঁক কষে সায়েবরা কেলোদের মাথায় হাত বোলানোর জন্যে ফতোয়া দিল, কেলে সায়েবদের ইংরিজি মালগুলো মন্দ নয়। গোরা সায়েবের থুতু গেলা কেলো সায়েবদের বিশ ইঞ্চি ছাতি ফুলে ফেঁপে ছত্তিশ ইঞ্চি হয়ে উঠল। ওরা বুকনি ঝাড়তে লাগল, আমাদের ইংরিজি মাল আর অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান নয়,ইন্দো-অ্যাংগ্লিকান । গোরারা এসব কেলেদের দুচারবার কালাপানি পার করে বিলেত-আমেরিকা মুল্লুকে চক্কর দিইয়ে আনল। কেলেরা হেভি লেজ নাড়াতে লাগল। আনকোরা বিলিতি কোট-প্যান্টুলুনে ঘেমে নেয়ে ওরা লেকচারে লেকচারে অন্ধকার করে দিল। যোদো মোধোরও হুঁশ হল। ইংরিজি বুলি রপ্ত না থাকলে টু পাইস কামানো যাবে না, পাড়ায় ইজ্জত থাকবে না, মায় মেয়েকে কোনো একটা মন্দের ভালো পাওরের গলায়ও ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে না। ফটাফট ইংরিজি বকতে না পারলে ছেলেপিলেকে লাফাঙ্গা হয়ে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াতে হবে, বাপের হোটেলে খেয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গুলতানি করতে হবে। যোদো তার ছেলেকে বাপের ইংরিজি বকা লালু ছেলে বানাবার জন্যে ঘটিবাটি বন্দক দিয়ে ইংরিজি গোয়ালে ঢুকিয়ে দিল। মোধো পেটে গামছা বেঁদে এগ্গাদা নোট খসিয়ে মেয়েটাকে ধুমসো কেলে মেমসায়েব আন্টিদের জিম্মায় পৌঁছে দিয়ে এল। এবার বাড়ির মধ্যে ইঞ্জিরি বকা শুরু হয়ে গেল। আন্ডাবাচ্চা আর বাড়ির কুত্তার সঙ্গে ইয়েস-নো-কাম-গো সিট-ইট বলে ইঞ্জিরি না ফাটালে আর চলে না। যোদোর লেড়েকুত্তা ভুলোর নতুন নাম দেয়া হল টমি। মোধোর বাড়ির মেনি বেড়ালটা হয়ে গেল পুসি। পাড়ার কাকা, জেঠা আর কাকা, জেঠা রইল না, হয়ে গেল আংকল ;জেঠিমা, খুড়িমা, মাসিমা, পিসিমা, গুষ্টিশুদ্দু সব ঝেঁটিয়ে আন্টি।
বাপঠাকুদ্দার আমলে দেশে জাতফাত নিয়ে হরবকত হেভি ঝামেলা লেগে থাকত:বামুন, বোদ্যি, কায়েত, শুদ্দুর, নম শুদ্দুর, বড়জাত, ছোটজাত, জলচল. জলঅচল,নবশাখ, হেলে কৈবত্ত, জেলে কৈবত্ত আরো কতো যে ঘোট! ওসব ভোগে গেছে,নম শুদ্দুরের হোটেলে কুলীন রাঢ়ী বামুনের ছেলে বাসন মাজছে, বারিন্দির বামুনের মেয়ে জাতে জেলে কৈবত্ত ছেলেকে লভ মেরেজ করে দিব্যি ঘর করছে ৷ দিনকাল পালটে গ্যাছে, আজকাল কেউ ওসব নিয়ে মাতা ঘামায় না, ধোপা নাপিত বন্দ করে একঘরে করার দিন চলে গ্যাছে, ৷ এখন জাতপাতের নতুন ছক ৷ এই নতুন ছকের মাপকাঠি হল গিয়ে কে কতটা ইংরিজিতে সরগর তার ওপর ৷ তুমি গুরু গটমট করে ইংরিজি বল আর ঘ্যাচঘ্যাচ করে ইংরিজি লেখ ৷ তুমি হলে বামুন,তাতে যদি আবার সায়েবি ইস্কুল থেকে বেরুনো হও, ইংরিজি বলার সময় কথার আদ্দেকটা চিবিয়ে খেয়ে ফেল, বাড়িতে চাকরবাকর আর ডেরাইভার ছাড়া সবার সঙ্গে ইংরিজি বল তাহলে তুমি হলে গিয়ে নৈকষ্য কুলীন ৷ এর পর যারা দিশি কায়দায় কোনোরকমে ইংরেজি বলে আর লেখে তারা হল যজমেনে বামুন ৷ আর যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দ্যাখে অত্থাৎ ইংরেজি বলতে গেলে ঘন ঘন ঢোক গেলে, আর লিখতে গেলে মাথা চুলকিয়ে মাথায় প্রায় টাক ফেলে দেয় তারা হল গিয়ে বোদ্দি কি কায়েত, তারপর রয়েছে যারা কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে ইংরেজি দুচার লাইন পড়তে পারে তবে বলতে গেলে সব গুলিয়ে যায়, বুকের ভেতর ধপাস ধপাস করে এরা জলচল — বলা যায় নবশাখ ৷ এর পরের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোক হল জল-অচল আর অচ্ছুৎ ৷
লোকে বলে, গোরারা নাকি কেটে পডেছে ৷ তার মানে দেশ নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে ৷ এখন সবার নাকি সমান অধিকার ৷ কী বললে? ঢপ? ঢপ হতে যাবে কেন?তোমার কি চোখ বলতে কিছুই নেই? দেখতে পাচ্ছনা সবাই স্বাধীন দেশের নাগরিক, মাথাপিছু সবার একটা করে ভোট ৷ তবে একথাটাও মিথ্যে নয় যে ঐ ভোটেই শুরু আর ঐ ভোটেই শেষ ৷ তোমরা হলে গিয়ে ছোটলোক পবলিক,তোমরা যে ভোট দিতে পারছ ওটাই তোমাদের চোদ্দপুরুযের ভাগ্যি, ভোটের কাগজটা বাক্সে গুঁজে দিয়েমুখ বুজে শুনসান ফুটে যাও ৷ দেশের আইনকানুন,সরকারি চিঠিপত্তর, দলিল-দস্তাবেজ, কাজ-কম্ম সবই ইংরিজিতে, তোমার হুদ্দোর বাইরে ৷ তুমি ইংরিজিতে পোক্ত নও, তুমি শালা জল-অচল ছোটজাত! ইংরিজির শাসন যুগ যুগ জিয়ো! মেকলে সায়েবের বেজম্মা নাতিপুতিদের রাজত্ব চলছে চলবে!
ঐ যা বলছিলাম, সায়েবরা দুঁদে মাল, ওরা বুঝতে পারল ওদের ছক দুয়ে দুয়ে চার হতে শুরু করেছে। রস চাখতে চাখতে লালমুখোদের মালুম হল, খেলটা হেভি জমে উঠেছে, আর গোটাকয়েক দানেই কিস্তি মাৎ । তারা দিশি ইংরিজিয়ালাদের বেশ করে পিঠ চাপড়ে দিল, কেলেদের ইংরিজি বইপত্তরের তারিফ করতে লাগল মায় দু-চারটে প্রাইজ ফাইজও ঠেকিয়ে দিল। তোল্লাই খেয়ে ফুলে ওঠা দিশি কেলে সায়েবরা বাওয়াল শুরু করে দিল। বুঝলে, আমাদের মাল হচ্ছে দিশি ইংরিজি। বিলিতি ইংরিজিতে বেশ কিছু খাদ ঢুকে পড়েছে — আমাদের মালটা যোল আনার ওপর বত্তিশ আনা খাঁটি ; আমাদের হল গিয়ে ইন্ডিয়ান ইংলিশ। (মা শেৎলার নামে কিরে খেয়ে বলছি, পেছন থেকে হারামির গাছ কেউ একটা ফুট কাটল, জাঙিয়ার বুকপকেট আর কি !) বাজারে বাংলা কাগজগুলোর বাঙালি বাবুরা ঐ সায়েবি ইংরেজি বুলিতে খুব একটা রপ্ত নয়। ওদের মধ্যে দুচাজ্জন — যারা কানার মধ্যে ঝাপসা দেখে — ওদেরও বুলিটা পেটে আসে তো মুখে আসে না। ওরা তো তুলকালাম ধুমধাড়াক্কা লাগিয়ে দিল। অমুক দিশি সায়ের আর তমুক কেলে মেমসায়েব ইংরিজিতে বই ছাপিয়েছে। সে বই বেরিয়েছে খোদ বিলেত মুল্লুক থেকে। তার ওপর তিন তিনটে বিলিতি কাগজে কেলে মেমসায়েবের বগলকাটা মেনা দেখানো ফোটো উঠেছে। যাই বলো বস্, কেলি আছে ! আর শালা, কথায় বলে, মাগির মাগি লেউইনস্কি, নেশার নেশা হুইস্কি ; পেশার পেশা দালালগিরি,বুলির বুলি ইঞ্জিরি। ওর সঙ্গে বাংলা বুলির কোনো কমপারিজন চলে ? — কোথায় গালের তিল আর কোথায় হাইড্রোসিল ! চাঁদে আর পোঁদে ? বাংলা কাগজয়ালাদের বুকের ভেতরটা সারাক্ষণ ঢিপ ঢিপ করে, পাছে পাবলিক ওদের পট্টিটা ধরে ফেলে — বুঝে ফেলে ওদের ইংরিজি বুলির দখলদারি তেমন পাকাপোক্ত নয়। তাই ঐ বাংলা কাগজয়ালারাই সারাক্ষণ ইংরিজির ঢাক পিটিয়ে কানে তালা লাগিয়ে দেয়।
তাঅলে বল এখন বাংলা বুলির হালটা কী ? বাংলা মাল আর বাংলা বুলি চলছে চলবে। তবে বস্, চাদ্দিকের ইংরিজির ধামাকায় বাংলাটা আর গিয়ার খাচ্ছে না। ওদিকে হিন্দিয়ালারাও তড়পাচ্ছে, আরে রাষ্ট্রভাষা বোল। তা যা বলছিলাম, বাংলা বুলির হাল। বাংলা এখন পুরোপুরি গরিবগুর্বো, ছোটলোকদের বুলি। ফেকলু চাকরবাকর, বাজারের মাছয়ালা, আনাজয়ালা, আর গাঁয়ের চাষাভুষোর বুলি হল গিয়ে বাংলা। পাত্তি বানাতে চাও, জ্ঞানফ্যানের বেওসায় নাক গলাতে চাও,মান-ইজ্জত পেতে চাও, পাঁজ্জন ঘ্যাম লোকের পাশে কি সামনে চেয়ারে বসে পা নাচাতে চাও, বিলিতি মালে চুমুক দিতে দিতে ঝিং চাকচাক ডিস্কো মিউজিক শুনতে চাও, মায় ঠোঁটে গালে রঙ লাগানো জিন পরা ফ্রেশ ডবকা মাল কি জম্পেশ মেয়েছেলে তুলতে চাও — তোমার মুখ থেকে বাওয়া ইংরিজির পপকর্ন ফোটাতে হবে। (তুইত শালা আচ্ছা টিউবলাইট! ওসব খৈ-মুড়ির দিন কবে চলে গেছে !দেখিস না ভদ্দরলোকেরা আর ঝলমু়ড়ি খায় না। গলির মোড়ে সবে চুলকুনি জাগা বাবুদের বাড়ির নেকি মেয়েগুলো ইংরিজিতে খুক খুক হাসতে হাসতে হলিউড থেকে আসা পপকর্ন আর বলিউড থেকে আসা ভেলপুরি খায়।)। হ্যাঁ, যা বলছিলাম ননেস্টপ ইঞ্জিরি বকে যেতে হবে আর সঙ্গে সঙ্গে খচাখচ ইঞ্জিরি লিকতে হবে। (পেছন থেকে আরেক বাঞ্চোতের বাচ্চা অ্যাড করল, সকালে দাঁতন দিয়ে দাঁত মেজে রুটিমুটি খেয়ে হাগতে যাওয়া চলবে না, দুপুরে আর রাতে পাত পেতে গাণ্ডে পিণ্ডে গেলা যাবে না। টুথব্রাস করে ব্রেকফাস্ট সেরে টয়লেটে যেতে হবে, ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ আর ডিনার করতে হবে। — মাইরি বলছি, এই ছোটলোকদের কথায় কিছু মাইণ্ড করো না, বস্। বাপের ক্যাপফাটা এসব ছেলেপিলেদের আর মানুষ করা গেলনা!)
কী বলছিলে ? বাংলা বলতে চাও ? বাংলায় লেকালিকি করতে চাও ? মাতাফাতা সব ঠিক আছে ত ? মায়ের ভাষা বাংলা — তাই ত ? চাঁদ আমার মা-নেওটা। তবে দেখ বাওয়া, ঐ মায়ের ভাষার টানে পোঁদের কাপড় যেন মাতায় উঠে না যায় ! (ঐ যে দেসাওবোদক গান আছে, ঐ যে সেই রজনী সেনের গান — মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই — ছেলের মা-অন্ত প্রাণ, মাতাটা তাই পুরো গেছে, একটা ইসকুরুও আর টাহট নেই। বোঝ ঠ্যালা ! মায়ের দেওয়া কাপড়ে পোঁদ না ঢেকে ওটা মাথায় বেঁধে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে যাচ্ছে !) হ্যাঁ, এতক্ষণে মালটা ক্যাচ করেছি। তার মানে ইংরিজি বুলিটা তোমার ঠিকঠাক আসে না। তুমি শালা ভদ্দরলোকদের দলে পাত পাও না। কী আর করবে, কপালের নাম গোপাল। এখন ছোটজাতদের বাংলার দলে ঢুকে পড়। ছোটলোকদের সঙ্গে গা ঘসাঘসি কর,ও দুটো চুলকোতে চুলকোতে বাংলা বুলিতে গ্যাঁজাও। যত খুশি হ্যাজাতে চাও হ্যাজাতে পার তবে জ্ঞান মারিও না — তাঅলে চারপাশের বুড়ো হাবড়া থেকে ক্যাওড়া ছোঁড়ারা সব্বাই মিলে প্যাঁক দিয়ে গুষ্টির তুস্টি করে ছাড়বে। আর বাংলায় লেকলিকি করবে ? কর — কেউতো তোমায় বারণ কচ্ছে না। তবে কিনা লেকালিকির কথা বলতে গেলে পড়াপড়ির কথাটাও তুলতে হয়। ভদ্দরলোকের বাচ্চারা, বলতে গেলে যেসব মালপয়মালরা এক-আদটু ক্যাটম্যাটস্যাট ইংরিজি বুলি রপ্ত করেছে তারা কেউ বাংলা লেকালিকি শুঁকেও দেখে না, বাংলায় ছাপা বইয়ের লেজ উল্টেও দেকতে চায় না মালটা কী, গোরু না বকনা। অবশ্যি যে হোঁচট খেতে খেতে নাকানিচোবানি খেয়েও ইংরিজি বই পড়তে পারে সে বাংলা পড়তে যাবে কোন দুঃখে, তুমিই বল। এক ছোটলোক ছাড়া কেউ আর বাংলা বইয়ের পাতা ওলটায় না। ছোটলোক, ছোটজাত — তার মানে ইংরিজিতে যাদের ক অক্ষর গোমাংস, আর যারা বাপমায়ের খুচরো পাপে কখনো ইংরিজি ইস্কুলের মুখ দেখতে পায় নি, আর গরিবগুর্বোর ঘরের যত অগামারা অপোগণ্ডের দল — চোদ্দবার ফেল মেরে শেষ অব্দি কেঁদে ককিয়ে দু-একখানা পাসের চোতা জুটিয়েছে, ইংরিজি পড়তে গেলে চোখে সর্ষেফুল দেখে এরাই হল গিয়ে বাংলা বইয়ের খদ্দের ৷ এছাড়া ধ্যাদ্দেরে গোবিন্দপুরের কিছু আতাক্যালানো দেহাতি — পাড়াগাঁয়ের বাংলা ইস্কুলে যারা হালে পড়াশোনা শেষ করেছে, যাদের চোদ্দগুষ্টি কখনো ইস্কুলের পত মাড়ায় নি, আর কিছু কেরানি কি দোকানদারের বউ — পাঁচ-পাঁচবার বিয়োনোর পর এখন মুটিয়ে আলুর বস্তা বনে গেছে, দুপুরবেলা পান চিবুতে চিবুতে টিভি দেখার পর কিছুক্ষণ বাংলা বহটই ঘাঁটাঘাঁটি করে, ইংরিজি অক্ষর দেখলেই ওদের বুকের ভেতরটা কাটা ছাগলের মত ধপাস ধপাস করতে থাকে। এই সব এলেবেলে লোকজন, এদের তো আর ভদ্দরলোক বলা যায় না। বাংলায় লেকালিকি করবে ? লেক শালা এদের জন্যে। তার বেওস্থাও আছে। বাংলা বইয়ের হাট। উত্তর থেকে গেলে ঠনঠনেতে মায়ের পায়ে পেন্নাম ঠুকে আর দক্ষিণ থেকে এলে হাড়কাটার মাগিদের বারকয়েক কানকি মেরে কলেজইষ্ট্রিট পাড়ায় ঢুকে পড়। ওটা হল গিয়ে বইপাড়া। চাদ্দিকে গলিঘুঁজি জুড়ে মায় পেচ্ছাবখানার দেয়াল ঘেঁসে বইয়ের হাটের হাটুরেদের সার সার দোকান। বইয়ের পসরা সাজিয়ে অনেকে রাস্তার ওপর বসে পড়েছে। এরা সব বাংলা বই ছাপায়। ঐ যে আমাদের হুগলি জেলার জকপুকুর গ্রামের হারান ঘোষের দুনম্বর বৌযের চারনম্বর ছেলে ঘোঁৎনা গন্ডায় গন্ডায় উজবুককে জক দিয়ে আর উদগান্ডুর মাথায় কাঠাল ভেঙে বেশ মালকড়ি হাতিয়ে আর ঘোঁৎনা রইল না নিবারণবাবু বনে গেল ৷ ঘোঁৎনা ওরফে নিবারণবাবু কলকাতার বইপাড়ায় এসে পেল্লাই একটা দোকান হাঁকিয়ে বসল — ইংরিজিতে তার সাইনবোর্ড — শ্রী শ্রী নিউ কালিমাতা ইন্টারন্যাশনাল পাবলিশিং এন্টারপ্রাইজ। নিবারণবাবু ওরফে ঘোঁৎনা এখন শয়ে শয়ে মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি লটকালটকি লদকালদকির রগরগে গপ্পের গাবদা গাবদা বাংলা বই ছাপিয়ে বাড়ি গাড়ি হাঁকিয়ে ফেলেছে, দলবাজি করে প্রকাশক সমিতির সম্পাদক বনে গেছে ৷ সারাক্ষণ সে ভাষণ দিয়ে যাচ্ছে যে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্যই সে তার জীবন দিচ্ছে। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। তা যা বলছিলাম, বাংলা লেকালিকির কথা। এগ্গাদা কাগজ, এতগুলো ঢাউস পুজোসংখ্যা আর বইয়ের হাট — এই নিয়ে লেকালিকির বাংলা বাজার। খেলসা করে বলতে গেলে, দিশি আর চুল্লুর ঠেক আর ঘুপচি ঘাপচি মেরে এখানে ওথানে কিছু তাড়ির ঘড়া। বাংলায় যাঁরা লেকালিকি করেন তাঁরা হরবকত মাল বানিয়ে সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছেন — নানান রসের গাদাগুচ্ছের গপ্পো-উপন্যাস। হাটুরেরা সেগুলো বেচছেন —খাঁটি বাংলা মাল, দুনম্বর আর তিননম্বর সি এল, ব্লাডারের চুল্লু, আর মাটির ঘড়ার তাড়ি। এছাড়া রয়েছে বেশ কিছু পাগলাচো… এরা বানাচ্ছে গ্যাঁজলা ওঠা কবতে। এরা নিজেরাই তা বাজারে ছাড়ছে। ঐ মাল দুয়েকজন পবলিক এক-আদ ঢোক গিলতে ট্রাই করে কুলকুচি করে ফেলে দেয়।
আবার ইংরিজিওয়ালা বাঙালি জ্ঞানের কারবারিদের মধ্যে দুচাজ্জনের দয়ার শরীর। কালেভদ্রে ওঁরা বাংলা বাজারে দর্শন দেন। ছোটলোকদের কথা ভেবে ওঁদের পাঁজরায় ব্যথা হয়। হাজার হলেও দেশতুতো সম্পক্ক ! তাছাড়া এসব জ্ঞানের বেওসায়িরা আগে সবাই ছাত্তর ঠ্যাঙাতেন। তাই জ্ঞান দেওয়ার স্বভাবটাও পুরোদমে রয়ে গেছে। ওঁরা হাটুরেদের ঝুলোঝুলিতে ঢেঁকি গেলেন — দু একটা বাংলা মাল নাবিয়ে দেন। সবাই যুগ যুগ জিয়ো বলে চেল্লায়। তবে কিনা বাংলাপড়া ছোটলোকগুলো সব মাতামোটা, ধুর — তার ওপর ওদের বাংলা বুলিটাও জ্ঞানের শক্ত শক্ত বুকনি ঝাড়ার জন্য সেরকম পোক্ত নয়। তাই জ্ঞানবাবুরা ইংরিজি মালের রঙটা ফিকে করতে করতে উড়িয়ে দেন — একটুখানি এসেনস দিয়ে খুব পাৎলা করে একটা বাংলা পাঁচন ছাড়েন। ইংরিজিতে যা দেওয়া হয় তা বাংলায় দিলে সেটা ছোটলোক পাবলিকের পেটগরম করবে, বুকে কষ্ট দেবে, মাতায় ঘোট পাকাবে। ছোটলোকদের দিতে হলে দুয়েক ফোঁটা বিলিতি মাল এক গেলাস টিপ্ কলের দিশি জল মিশিয়ে দিতে হয়, যা ওদের পেটে সয়।
এ সমস্ত বাদ দিয়ে বাংলা বাজারে আরেক কিসিমের কিম্ভুত-কিমাকার মাল বিক্রি হয়। এ মালগুলো যাঁরা বানান তাঁরা হলেন গিয়ে ম্যাস্টর, বিশেষ করে বাংলার ম্যাস্টর। বেচারারা ছোটলোকদের বুলির ম্যাস্টর বলে এমনিতেই পোঁদের ফাঁকে লেজ গুঁজে সিঁটিয়ে থাকেন। না ছাত্তর না চারপাশের পবলিক, কেউ ওঁদের মানুষ বলে গন্যি করে না। সেই খার থেকে ওঁরা ঘরের কোণে বসে গাবদা গাবদা বই বানিয়ে বাজারে ছাড়েন। ঐ মালগুলোর আদ্ধেক হেন্ সায়েব আর তেন্ সায়েবের ইংরিজি বুকনিতে ঠাসা থাকে, আর বাকি আদ্ধেকে থাকে বাংলায় ওসব সায়েবি বুকনি নিয়ে ভুলভাল মানে করে আলটুফালটু কপচানি, ভাট বকা আর হ্যাজানো। তার মধ্যেই আবার এগগাদা সায়েবের প্যান্টুলুন আর মেমসায়েবের গাউন ধরে জাতীয়তাবাদী টানাটানি। আসলে বেচারা ম্যাস্টররা শো করেত চান, বাংলার ম্যাস্টর হলে কী হবে, ওঁরা ফেলনা নন, ইংরিজি পড়ে ওঁরা নিজের পছন্দমাফিক একটা মানে আন্দাজ করে নিতে পারেন। আর ইতিমদ্ধে নামজাদা সব সায়েবের এন্তার বিগ বিগ বই নিয়ে সব ফিনিস করে দিয়েছেন। তবে কিনা স্রিফ দেসওয়ালি আম জন্তার কথা ভেবে দিল দিওয়ানা হয়ে যায় বলে বাংলা বুলির জন্যে জান লড়িয়ে দিচ্চেন, জিন্দিগি বরবাদ কচ্চেন ; তা নইলে কবে শালা বিলেতে গিয়ে সাদা চামড়ার আঁতেলদের জিগরি দোস্ত বনে যেতেন। আর অসুবিদেটাই বা কী ছিল ? ওসব বার্ত-ফার্ত, বাখতিন-টাকতিন, স্ট্রাকচার-মাকচার,পাওয়ার-ফাওয়ার, ঘনাদা, টেনিদা, দেরিদা-মেরিদা — সবই তো ওঁদের কবে জলভাত হয়ে গেছে!
কী বলছ? এসবের পরও তুমি বাংলা বুলিতে লেকালেকি করতে চাও ! তা কী লিকবে বলো ৷ গপ্পো না কবতে? বাংলায় গপ্পো, কবতে ছাড়া আর কীইবা লেখা যায়? মাতাটা যখন গেছে, ইংরিজি বুলিটাও তেমন আসে বলে মনে হয় না তখন আর কী করা ৷ যাও — বাংলা বাজারে ঢুকে পড়, যত মাল পয়মালদের সঙ্গে বার দোয়ারি কী খালাসিটোলায় বেঞ্চিতে পোঁদ ঠেকিয়ে বাংলা টেনে আতা-ক্যালানো দেহাতি আর ছোটলোকদের জন্যে বাংলা বুলিতে লেকালেকি শুরু করে দাও ৷ জিন্দিগি চোরপোরেশনের ভ্যাটে ফেলে দিতে চাও, দাও ৷ আমার কী এসে যায় ?গরিব কায়েতের ছেলে নেইকো কোনো কতাতে ৷ কেলোর পোঁদ ভুলোয় মারে দাঁড়িয়ে দেকি তপাতে ৷৷ — সব বুঝে শুনে আমি এখন বাপঠাকুদ্দার মুখে শোনা এই নীতিই মেনে চলেছি ৷
এতটা লিখে চোতাটা একজন জানপয়চান বড়বাবুকে দেখালাম ৷ বললাম, বস্ উলটোপালটা বকেছি,মালটায় একটু চোখ বুলিয়ে দাও ৷ বাবু সেদিন ইংরিজিতে মার্কিন মুল্লুকের আজকালকার লিখিয়েদের লেখায় সেলেং (বাংলা বুলির ম্যাস্টররা বলে অপভাষা অত্থাৎ কিনা তোমার আমার মতো রামা শ্যামা যোদো মোধোর বুলি)বেবহারের ফরে বক্তিমা দিয়ে এসেছেন ৷ দুচার লাইন দেখেই তিনি লেখাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, বললেন, ন্যাস্টি, একে বাংলা, তার ওপর গুন্ডা বদমাসদের অবসিন ভাষা, কোনো ভদ্দরলোক এসব পড়তে পারে ?
ঠিক! একশ পঞ্চাশ ভাগ রাইট! ঐ যে বাগবাজারের অম্রেতবাজারি জয়গৌর মার্কা ঘোষবাড়ির নামকেত্তন করা বোস্টম জামাইয়ের বানানো আর এখন তার আমেরিকা-ভজা নাতিপুতিদের চালানো সুতারকিন গলির আনন্দবাজার পত্রিকা হরবকত বাংলা ভাষার গুষ্টির তুষ্টি করে ৷ ভদ্দরলোকদের বুলিতে বলতে হয়, সাধু ভাষায় তিরস্কার করত চতুর্দশ পুরুষকে উদ্ধার করে ৷ কেউ বাংলা ভাষার হয়ে রা কাড়তে গেলেই আনন্দবাজার তাকে বাংলাবাজ বলে হেভি খিস্তিখাস্তা করে — সাধু ভাষায় বলতে গেলে সুকঠিন ভাষায় ভর্ৎসনা করে (সাধু ভাষা বোঝ না যাদু?বুঝবেটা কী করে! চব্বিশ ঘন্টা গলির মোড়ে ছোটলোকদের সঙ্গে গুলতানি করছ,শোন , সাধু ভাযা হল গিয়ে তোমাদের চোর ভাষার উলটো) ৷ ভদ্দরলোক বাঙালির প্রাণের বাংলা কাগজ আনন্দবাজারের কেত্তন হল হল 'এস হে মার্কিনি চন্দ্র সাঙ্গপাঙ্গ সঙ্গে করি, এস হে', মনপছন্দ্ হল ইংরিজিখোররা৷ বল গুরু, ওয়ার্ল্ডে কোথায় এমন আরেকটা কাগজ রযেছে যা যে বুলিতে বেরয় তারই খাল খিচে দেয়ার জন্য সারাক্ষণ রেডি থাকে! সত্যিই তো 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি' ৷
এই হল গিয়ে বাংলা বুলির হাল! ইস্কুলে যা পড়েছিলে তা তো কবে খেয়ে হজম করে ফেলেছ, হক কথা বলা একটা লাইন মনে পড়ছে ? তবে শোন: আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্চোত ভূমি বঙ্গে!
No comments:
Post a Comment