Friday, February 8, 2013

একদিনে ৯ শিশুর মৃত্যু, ফের কাঠগড়ায় বি সি রায়

একদিনে ৯ শিশুর মৃত্যু, ফের কাঠগড়ায় বি সি রায়

একদিনে ৯ শিশুর মৃত্যু, ফের কাঠগড়ায় বি সি রায়
অনির্বাণ ঘোষ 

শিশুর মৃত্যুমিছিল থামছেই না৷ ফের অস্বাভাবিক সংখ্যায় শিশুমৃত্যু বি সি রায় শিশু হাসপাতালে৷ মঙ্গলবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ১৩টি একরত্তি শিশুর মৃত্যু হয়েছে৷ এর মধ্যে শুধু বুধবারই মারা গিয়েছে ৫ দিন থেকে ১ বছর বয়সি ৯টি শিশু ও সদ্যোজাত৷ 

জেলার মাঝারি মানের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে নয়, রাজ্যের সর্বোচ্চ শিশু চিকিত্‍সা প্রতিষ্ঠান বি সি রায় শিশু হাসপাতালেই একদিনে এতগুলি শিশুমৃত্যুর খবরে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরের উপরমহলে৷ উদ্বিগ্ন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বৃহস্পতিবার হাসপাতালের অধ্যক্ষ মালা ভট্টাচার্য বলেন, 'প্রতিটি শিশুই অনেক দূর থেকে রেফার হয়ে এসেছিল৷ কেউ বর্ধমান তো কেউ মুর্শিদাবাদ৷ অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল৷' কিন্তু দু'জায়গাতেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থাকার পরও কেন কলকাতায় রেফার করতে হল মুমূর্ষু শিশুদের, তা নিয়ে কোনও সদুত্তর মেলেনি৷ মালাদেবীর সাফাই, 'তবে এদের সবাই ভর্তি হয়েই মারা যায়নি৷ অত্যন্ত কম ওজন এবং ভয়াবহ সংক্রমণ নিয়ে এরা সোম, মঙ্গল ও বুধবার ভর্তি হয়৷ দুর্ভাগ্যজনক, বুধবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও এই ৯ জনকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি৷' 

প্রকাশ্যে 'তেমন কোনও বড় ব্যাপার নয়' বলে শীর্ষ স্বাস্থ্যকর্তারা বি সি রায় হাসপাতালের পাশে দাঁড়ালেও, বাস্তবে শিশুমৃত্যুর 'ভূত' বৃহস্পতিবার দিনভর ঘুরে বেড়িয়েছে স্বাস্থ্যভবনের 'বড়' ঘরগুলির আনাচেকানাচে৷ কারণ স্বাস্থ্যসূত্র বলছে, বুধবারের ঘটনা এই হাসাপাতালের গড় শিশুমৃত্যুর চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গড়ে ৩-৪টির বেশি শিশু এই হাসপাতালে মারা যায় না একদিনে৷ বর্ষাকালে কিংবা শীতের গোড়ায় সেই সংখ্যা ক্কচিত্‍ ৫ ছাড়ায়৷ কিন্তু কেন বুধবারই শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ৯ এবং দু'দিনে তা ১০ ছাড়াল, তা নিয়ে চিন্তিত সরকার৷ স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যসচিব সতীশ তিওয়ারি, শিশুমৃত্যু রোধে গঠিত 'হাই লেভেল টাস্ক ফোর্স'-এর চেয়ারম্যান ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিবারকল্যাণ কমিশনার সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশেষ সচিব (স্বাস্থ্য-শিক্ষা) মনোজ চৌধুরী-সহ স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রায় সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্তা দীর্ঘ বৈঠকে এ দিন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন, ফের বি সি রায়ে এত কম সময়ে এতগুলি শিশুমৃত্যুর কারণ কী৷ মালদা, বর্ধমান-সহ অন্যান্য জায়গাতে শিশুমৃত্যুর ঘটনা সম্প্রতি একাধিকবার শিরোনামে এলেও ২০১১-র জুন এবং অক্টোবরে শেষ বার এই হাসপাতালে এতগুলি শিশুমৃত্যুর খবরে তোলপাড় হয়েছিল৷ ইতিমধ্যে শিশুস্বাস্থ্য পরিকাঠামো অনেক উন্নত হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে সরকারের তরফে৷ তাই, এখন ফের একবার বি সি রায় হাসপাতালে শিশুমৃত্যু লাগাম ছাড়ানোয়, ঘুম ছুটেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের৷ 

এ দিন সকালেই বি সি রায় শিশু হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে স্বাস্থ্যভবনে তলব করে কৈফিয়ত চাওয়া হয়, কী ভাবে শিশুচিকিত্‍সায় রাজ্যের সেরা পরিকাঠামোযুক্ত হাসপাতালে একদিনে এত শিশুর মৃত্যু হল? বুধবার রাতে টাস্ক ফোর্স-এর চেয়ারম্যান পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে স্বয়ং হাসপাতালে পৌঁছে গেলেও সে সময়ে বি সি রায়ের এই দুই শীর্ষকর্তা কেন সেখানে আসেননি, সেই প্রশ্নেও রীতিমতো কাঠগড়ায় তোলা হয় অধ্যক্ষ মালা ভট্টাচার্য এবং উপাধ্যক্ষ দিলীপকুমার পালকে৷ এই দুই প্রশাসনিক কর্তাকে সঙ্গে নিয়ে এ দিন দফায় দফায় বৈঠক করেন উচ্চপদস্থ স্বাস্থ্য-আমলারা৷ প্রতিটি শিশুর মৃত্যুর কারণ 'অডিট' করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্তারা৷ পাশাপাশি, বি সি রায় হাসপাতালের অধ্যক্ষকে কেন এই হাসপাতাল সামলানোর পাশাপাশি চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের মতো একটি বড় হাসপাতালের অধ্যক্ষপদেও রাখা হয়েছে, সে প্রশ্নও উঠেছে৷ ইঙ্গিত মিলেছে, প্রয়োজনে যে কোনও একটি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এই প্রবীণ চিকিত্‍সককে৷ 

এ দিনের বৈঠকে অধিকাংশ অভিযোগের লক্ষ্য ছিলেন বি সি রায়ের অধ্যক্ষ মালাদেবী৷ এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, 'ক্যাপ্টেন যদি নন-প্লেয়িং হন, তা হলে টিমের মনোবল থাকবে কী করে? উনি চিত্তরঞ্জনে এক ঘণ্টা থাকেন, তার পর বি সি রায়ে ঘণ্টা দেড়েক থাকেন৷ কোথাও রোগী দেখেন না৷ এমনকী, বুধবার এতগুলি শিশুর মৃত্যুর খবর পেয়েও উনি হাসপাতালে যাননি!' স্বাস্থ্যভবন সূত্র বলছে, এ দিনের বৈঠকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমাদেবীও এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন৷ এমনকী, তিনি নিজে এই শিশুমৃত্যুর খবর অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষের বদলে ত্রিদিববাবুর মুখ থেকে শোনায়, ক্ষোভ গোপন করেননি৷ কেন বুধবার এত শিশু মারা যাওয়ার পরও তিনি বা উপাধ্যক্ষ সন্ধের পর ছিলেন না হাসপাতালে, সে প্রশ্নের জবাব বৈঠকে তাঁরা দিতে পারেননি৷ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উন্নয়ন খাতে সাংসদ তহবিলের ১.৫ কোটি টাকা খরচ করতে না পারার অভিযোগও রয়েছে৷ শিশুচিকিত্‍সায় রাজ্যের এক নম্বর হাসপাতালে ফের শিশুমৃত্যু এবং কর্তৃপক্ষের অকর্মণ্যতা নিয়ে দৃশ্যতই এ দিন বিব্রত স্বাস্থ্যকর্তারা৷ 

স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্তবাবু বি সি রায় হাসপাতালে বুধবার ৯টি শিশুমৃত্যু সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে চাননি৷ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মৃত শিশুরা দূর-দূরান্ত থেকে এসেছিল কম ওজন, সেপসিস, নিউমোনিয়া, শ্বাসরোধ কিংবা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে৷ ত্রিদিববাবু এই ঘটনাকে 'ক্লাস্টার এফেক্ট' আখ্যা দিয়ে বলেন, 'বিভিন্ন সময়ে ওই শিশুরা ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে৷ তাদের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে বাঁচানো মুশকিল ছিল৷ জুনিয়র ডাক্তার এবং আরএমও-রা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন৷ দুর্ভাগ্যজনক, একই দিনে ৯ জনই মারা গেল৷'

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Census 2010

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors