দেবেশ রায়
দেবেশ রায় (জন্ম ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৬) একজন বাঙালি ভারতীয় সাহিত্যিক। জন্ম অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। ১৯৭৯ সাল থেকে তিনি এক দশক পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস যযাতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল: মানুষ খুন করে কেন(১৯৭৬), মফস্বলী বৃত্তান্ত (১৯৮০), সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), লগন গান্ধার (১৯৯৫) ইত্যাদি।[১]
তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৯০ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন।[২]
[সম্পাদনা]গ্রন্থ তালিকা
- তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত
- মফস্বলি বৃত্তান্ত
- সময় অসময়ের বৃত্তান্ত
- লগন গান্ধার
- আত্মীয় বৃত্তান্ত
- শিল্পায়নের প্রতিবেদন
- দাঙ্গার প্রতিবেদন
- খরার প্রতিবেদন
- যযাতি
- তিস্তাপুরাণ
- আঙিনা
- ইতিহাসের লোকজন
- উচ্চিন্নো উচ্চারণ
- একটি ইচ্ছা মৃত্যুর প্রতিবেদন
- চেতাকে নিয়ে চীবর
- জন্ম
- তারাশংকর:নিরন্তর দেশ
- নবেলজোড়
- বেঁছে বততে থাকা
- শিল্পায়নের প্রতিবেদন
- মার-বেতালের পুরান
- যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ
- সহমরণ
- বরিশালের যোগেন মণ্ডল
- দেবেশ রায়ের ছোটগল্প (৬ খণ্ড)
- রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর আদি গদ্য (প্রবন্ধগ্রন্থ)
- সময় সমকাল (প্রবন্ধগ্রন্থ)
- উপন্যাস নিয়ে (প্রবন্ধগ্রন্থ)
- উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে (প্রবন্ধগ্রন্থ)
- শিল্পের প্রত্যহে (প্রবন্ধগ্রন্থ)
- উপনিবেশের সমাজ ও বাংলা সাংবাদিক গদ্য (প্রবন্ধগ্রন্থ)
- মানিক বন্দ্যোপাধ্যয়: নিরন্তর মানুষ (প্রবন্ধগ্রন্থ)
[সম্পাদনা]পাদটীকা
এই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সমৃদ্ধ করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |
প্রবন্ধ ১... |
জয়পুর ও আশিস নন্দী বিশেষজ্ঞতা ও গণতন্ত্র |
আশিস নন্দীর বক্তব্য নিয়ে যে-কাণ্ড, তাতে এই ভয় মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে মন্ত্রীরা বা হাকিমরা যে-কাউকে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে দিতে পারেন। |
জয়পুরে সাহিত্য উৎসবে সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর একটি কথা নিয়ে কোর্টকাছারি হচ্ছে, সরকার-পুলিশ তো হয়েইছে, মুখ্যমন্ত্রী-কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও স্বেচ্ছায় জড়িয়ে পড়েছেন, আশিসের গ্রেফতার একটি রাজনৈতিক দাবি হয়ে উঠেছে। এ-নিয়ে কোনও তথ্য-সংগ্রহ না করেও বুকে বল নিয়ে বলা যায়, এই সব হাঙ্গামায় যাঁরা স্বনাম রক্ষায় গলা মিলিয়েছেন সেই মন্ত্রী ও নেতারা ও যাঁদের এজলাশে মামলা উঠতে পারে, সেই হাকিমদের অনেকেই আশিস নন্দীর নাম এই প্রথম শুনলেন। আশিস নন্দী সমাজবিজ্ঞানকে একটি বিশেষ আয়তন দিয়েছেন সমাজবিদ্যার সঙ্গে মনস্তত্ত্ব যোগ করে। সমাজবিজ্ঞানেরও এ এক বিশিষ্ট বিভাগ। এ বিশিষ্ট বিভাগে চিন্তাভাবনা করার মানুষ পৃথিবীতেই কম, ভারতে আরও কম। সারা দুনিয়াতে এই বিষয়টিকে ফরাসি দার্শনিক লাকাঁর চিন্তাভাবনা নতুন আয়তন দিয়েছে। আমার পক্ষে এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন যে, আশিস নন্দী সমাজমনের যে-পার্শ্বদেশ নিয়ে কাজ করেন, সেই পার্শ্বদেশ এমনকী সমাজবিজ্ঞানীদেরও খুব চেনা মুখ। তা হলে এত জঙ্গি আন্দোলন কী নিয়ে এবং কেন? আশিস কী বলেছেন ও তাঁর কথায় কী শোনা হয়েছে সে-বিষয়ে কিছু বলার আগে আমার দুটো প্রশ্ন: আশিস নন্দী এই সম্মিলনে গেলেন কেন ও এই জয়পুর উৎসবের সংগঠকরা আশিস নন্দীকে ডাকলেন কেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তর অনুমান করাও কঠিন। এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কোনও বন্ধুর অনুরোধে আশিস নন্দী গিয়েছেন। একটা মেলা মতো হচ্ছে, লোকজনের সঙ্গে দেখাশোনা ও কথাবার্তা হবে না যাওয়ারই বা কী আছে। আশিস নন্দী মানুষ হিসেবেও একটু ভোলেভালা তাঁকে নিয়ে যাওয়াও এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। যেমন, তাঁর পক্ষে এমন গোপন উচ্চম্মন্যতা লালনও সম্ভব নয় যে, তাঁর তাত্ত্বিক গবেষণা এই ধরনের ফেস্টিভাল-মঞ্চে উত্থাপনীয় নয়। |
শিল্পী: সুমিত্র বসাক |
সেটা তো বেশি বোঝা উচিত ছিল এই ফেস্টিভালের সংগঠকদের। তাঁরা ভেবেছেন কী ভাবেননি সেটা প্রাসঙ্গিক কথা নয়। এই সংগঠকরা এই ধরনের ফেস্টিভালের বিনিয়োগকারী। জয়পুর ফেস্টিভালের সময়ে একটা হিসেব বেরিয়েছিল যে ফেস্টিভালের প্রধান ব্যবস্থাপক বলেছেন লসের পরিমাণ এত বেশি বা লাভের পরিমাণ এত কম (১০ কোটির এ-দিক ও-দিক) যে, আগামী বছর ফেস্টিভাল জয়পুরে না-ও হতে পারে। আমি কোনও নৈতিক প্রশ্নের ধারকাছ দিয়েও যাচ্ছি না। কেউ যদি মনে করেন এখন ফেস্টিভাল বিনিয়োগযোগ্য একটি ব্যাবসা যেখানে খাটানো-টাকা হাতে-হাতে উঠে আসে, তা হলে তিনি সেখানে টাকা খাটাতেই পারেন। প্রধানত দিল্লিতে একটা নতুন বিনিয়োগক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বিয়েবাড়ির কন্ট্রাক্ট। আপনি থিমেটিক বিয়েবাড়ি চান না পারিবারিক বিয়েবাড়ি চান, সেই চাহিদা মতো কোটি-কোটি টাকা খাটিয়ে সে বিয়েবাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। এমনকী সিনেমায় দেখা বিয়েবাড়িরও কন্ট্রাক্ট নেওয়া হচ্ছে। দিল্লি কর্পোরেশন প্রস্তাব করেছে প্যান্ডেল অনুযায়ী বিয়েবাড়ির ট্যাক্স বসানো হবে। এই লিটারারি ফেস্টিভালগুলোও তেমনই একটি বিনিয়োগক্ষেত্র। কয়েক জন খ্যাতিমান মানুষকে দেখিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের বিশিষ্ট বিনোদন। এই ধরনের বিনিয়োগে আশিস নন্দীর গোলমাল ফেস্টিভালের আকর্ষণ বাড়ায়। গত বছরও রুশদি-নয়পল এ-সব নিয়ে ভাল ঘোঁট হয়েছিল। এ বারের ঘোঁটটা নিম্নবর্গ, মন্ত্রীটন্ত্রি, কোর্টকাছারি মিলে একটু বেশি গোলমেলে হয়ে উঠেছে। তার কারণ, গণতন্ত্র ও বিশেষজ্ঞতা বিনিয়োগের মঞ্চে একত্রিত হয়েছে। গণতন্ত্রের অর্থ অধিকারের কোনও জাত ভেদ নেই। তার বিপজ্জনক অর্থ তো এটা হতে পারে না যে, বিশেষজ্ঞতার কোনও অধিকারভেদ নেই। যে-কেউ বিশেষজ্ঞ হতে পারেন এই পর্যন্ত গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্র তো যে-কাউকে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে দিতে পারে না। হওয়া আর বানানো দুটো আলাদা কাজ। আশিস নন্দীর বক্তব্য নিয়ে যে-কাণ্ড হচ্ছে, তাতে এই ভয়টাই মারাত্মক হয়ে উঠেছে যে মন্ত্রীরা বা হাকিমরাই এখন যে-কাউকে বিশেষজ্ঞ বানিয়ে দিতে পারেন। কী বলেছেন আশিস নন্দী? পুরো পেপারটা আমি পাইনি। যা পেয়েছি তাতেই বুঝেছি। না-পেলেও বুঝতাম। ওঁর সারা জীবনের কাজের সঙ্গে পরিচয় থেকেই জানি উনি কী বলতে পারেন। 'বরিশালের যোগেন মণ্ডল' নামে একটি উপন্যাস লেখার সময় সংরক্ষণের সূত্রপাত যে দ্বিতীয় গোলটেবিলে, সাম্প্রদায়িক রোয়েদাঁদে (কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড) ও ১৯৩৫-এর 'ভারত শাসন আইন'-এ তার তত্ত্বতালাশ আমাকে খুঁজতে হয়েছিল এমনকী দেশান্তরের মহালেখ্যাগারেও। সেখানে এমন তথ্যও এক জন মুসলমান পুলিশ অফিসারের জবানিতে দেখেছিলাম সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের গোপন খবর যাঁরা পুলিশের কাছে পয়সার বিনিময়ে দিয়ে যেতেন, তাঁরাও বেছে নিতেন হিন্দু অফিসার, যাতে রিওয়ার্ডের টাকা এক জন হিন্দু পান। সাম্প্রদায়িকতা ডি-এন-এর চাইতেও অনপনেয় উপাদান ঘুষ ও রিওয়ার্ডের টাকাতেও জাতিভেদ সক্রিয় রাখে। আশিস নন্দী এক জটিল কৌম মানসিকতার উপাদান বিশ্লেষণ করেছেন। সংরক্ষণ এমন আইন নয়, যা বিধিবদ্ধ হলেও কার্যকর হয়। সেই বাধাবিঘ্ন উতরে সংরক্ষিত গোষ্ঠীর অন্তর্গত হয়েও কেউ কেউ সরকারের উচ্চপদে যেতে পারতেন। বা, এখন, কোনও কোনও রাজ্যের সরকার পর্যন্তও তৈরি করতে পারছেন। তাঁরা, উঁচুজাতের নেতামন্ত্রীদের সমতুল্য মর্যাদা পেতে ঘুষ-খাওয়াটাকে একটি গ্রহণযোগ্য সহজ উপায় হিসেবে বেছে নিতেন ও নিচ্ছেন। ভারতের অজস্র জটপাকানো হিন্দু ও হিন্দু-প্রান্তিক সমাজের লুকনো তাকবন্দি ব্যবস্থার গতিমুখের সংকেত তৈরি করেছেন আশিস নন্দী। সেই তাকবন্দি ব্যবস্থা এখন একটা রূপান্তরে পৌঁছেছে। এর রূপান্তরণ ক্ষমতা অচিন্তনীয়। এখন একটা ধারণা তৈরি হয়ে আছে যে, হিন্দুসমাজের সেই তাকথাক ভেঙে গিয়েছে। বস্তুত সেই তাকথাক পোস্টমডার্ন হয়েছে। এই সংকেতের বর্ণপরিচয় যাঁদের নেই, তাঁরাও তাঁর গ্রেফতার দাবি করছেন ও আদালত তাঁদের কথাও সমমর্যাদায় শুনছে এটা গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্রেরই একটা নিষেধও তো থাকা উচিত। যার কাজ, কাজটা তাকেই করতে দেওয়া হোক। আশিসকে তাঁর বক্তব্যের সূত্র ধরেই ও আমার তত্ত্বতালাশ থেকেই আরও একটা অন্বেষণসূত্র দিতে চাই। ১৯৩৫-এর আইনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে যে সব রাজ্যে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা হল, প্রায় বেশির ভাগ প্রদেশেই বেছে-বেছে তফসিলিদেরই কেন আবগারি মন্ত্রক দেওয়া হত? আর সেই অভ্যেসটা স্বাধীন হওয়ার পরও অপরিবর্তিত থাকলই বা কেন? গ্রেফতারই যদি হতে হয়, আশিস, তবে সব কথা বলে হওয়াই ভাল। |
ব্যক্তি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পারফরমেন্স নিয়ে তাঁকে দশে শূন্য দিলেন রাজ্যের প্রাক্তন প্রশাসনিক প্রধান৷ নন্দীগ্রাম-তদন্ত নিয়ে সিবিআই জেরা কিংবা ২১ জুলাইয়ের গুলি চালনা নিয়ে যখন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তুলেছে শাসক তৃণমূল, তখন নজিরবিহীন ভাবে মঙ্গলবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় গেলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ এ দিন দু'টি টেলিভিশন চ্যানেলে টানা কয়েক ঘণ্টার সাক্ষাত্কারে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সম্পত্তি থেকে রাজ্য সরকারের কাজকর্ম, সিপিএমের দলীয় মতপার্থক্য থেকে রেজ্জাক মোল্লা বিতর্ক, শিল্প ও জমি অধিগ্রহণ থেকে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের মতো বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে খোলামেলা মতপ্রকাশ করেছেন সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্য৷ কিন্তু নানা ইস্যুর মধ্যে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে তদন্ত দাবি করে রাজ্য রাজনীতিতে প্রবল আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ এই ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সততা কিংবা তাঁর পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তদন্তের দাবি এর আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো কোনও শীর্ষ সিপিএম নেতা করেননি৷ সিপিএম রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য গৌতম দেব এর আগে মুখ্যমন্ত্রীর আঁকা ছবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ সেই ছবি কারা কত দামে কেনে, তুলেছিলেন সেই প্রশ্নও৷ এমনকী পরোক্ষে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে 'তোলাবাজির' অভিযোগ এনেছিলেন৷ এ বার একইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সম্পত্তি ও নন্দীগ্রামে যারা হিংসা ছড়িয়েছিল এবং মাওবাদী-তৃণমূল 'আঁতাঁত' নিয়ে তদন্ত দাবি করে পাল্টা চাপ তৈরির রাস্তায় হাঁটলেন বু্দ্ধদেব ভট্টাচার্য৷
সততার প্রতীক হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে ভাবে এতকাল তৃণমূলের তরফে তুলে ধরা হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বক্তব্য, 'এই বিষয়ে আমি ভিন্নমত পোষণ করি৷ সত্ হলে খুশি হতাম৷ কিন্তু সত্ বলে মনে করতে পারছি না৷' কেন মুখ্যমন্ত্রীর সততা নিয়ে তিনি সংশয়ী তার ব্যাখ্যায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, 'তাঁর পরিবারের আগে কী অবস্থা (পড়ুন আর্থিক) ছিল আর এখন কী অবস্থা (পড়ুন বিষয় সম্পত্তি) হয়েছে তা আপনারা তদন্ত করে দেখুন৷ তদন্ত করলে বের করতে অসুবিধা হবে না৷ আমার কাছে সততার মাপকাঠি ভিন্ন৷' দু'টি সাক্ষাত্কারেই শিল্পায়ন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, জমি অধিগ্রহণ এবং বন্ধ, ধর্মঘট নিয়ে দলের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের কথা স্বীকার করেন সিপিএম পলিটব্যুরোর এই প্রবীণ সদস্য৷ তাঁর বক্তব্য, শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতেই হবে৷
একটি টেলিভিশন চ্যানেলে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের বর্তমান অবস্থান তদন্ত করে দেখার দাবি তুলে আর একটি চ্যানেলে গিয়ে বুদ্ধবাবু তৃণমূল নেতাদের 'দুর্নীতি' নিয়ে বলেন, 'এরা আগে কত সম্পত্তির মালিক ছিলেন এখন কত সম্পত্তির মালিক হয়েছেন'৷
ইতিমধ্যে নন্দীগ্রাম মামলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে জেরা করার আর্জি তুলে সিবিআই-কে চিঠি দিয়েছে রাজ্য সরকার৷ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে টার্গেট করে ঘুঁটি সাজানোর অভিযোগ উঠছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে৷ সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমার কিংবা আমাদের দিকে নিশানা থাকবে, আগেও ছিলাম৷ কিন্তু কে কাকে জেরা করবে৷
নন্দীগ্রামে তৃণমূল ও মাওবাদীরা হাত মিলিয়ে রাস্তা কেটেছে, মানুষ খুন করেছে আমরা চুপ করে মেনে নেব? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছিলাম৷ নন্দীগ্রামে যারা হিংসা ছড়িয়েছিল তাদের জেরা করা উচিত৷' পাশপাশি মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন তিনি৷ বিপরীতে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও যে অনেক মামলা রয়েছে তা এ দিন স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি৷ তাঁর কথায়, 'আমি যখন সরকারে ছিলাম তখন ওঁদের বিরুদ্ধেও অনেক মামলা ছিল৷ যিনি এই সব কথা বলছেন তাঁর বিরুদ্ধেও অনেক মামলা ছিল৷ কিন্তু আমি কিছু করিনি৷' একই ভাবে ২১ জুলাইয়ের ঘটনা নিয়ে মদন মিত্রের অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ তাঁর কথায়, 'আজেবাজে লোকেরা মন্ত্রিসভায় আছে৷ মহাকরণ থেকে কেউ গুলি চালানোর নির্দেশ দেয় না৷'
সিপিএমের দিকে মহাকরণ থেকে ফাইল লোপাট করে দেওয়ার যে অভিযোগ তোলা হয় তা খণ্ডন করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, সমস্ত ফাইল মহাকরণে রয়েছে৷ রাজ্যে জমানা পরিবর্তনের পর ইতিমধ্যে একাধিক সিপিএম নেতাকে জেলে যেতে হয়েছে৷ বুদ্ধদেববাবু বলেন, এই ভাবে বামেদের ভয় পাইয়ে দিতে পারবে না৷ এই তরজার মাঝে সলমন রুশদি বিতর্কে মুখ খুলে এ দিন বুদ্ধবাবু বলেন, 'সলমন রুশদি যাতে এখানে আসতে পারেন তার জন্য চেষ্টা করা উচিত ছিল৷ গোলমাল না হতেও পারত৷ সরকার বাড়াবাড়ি করেছে৷'
দেবেশ রায়ের 'বরিশালের যোগেন মণ্ডল' : যুগপৎ উপন্যাস ও ইতিহাস
দেবেশ রায়ের 'বরিশালের যোগেন মণ্ডল' : যুগপৎ উপন্যাস ও ইতিহাস – আলোচনায় ড. তপন বাগচী: কবি-প্রাবন্ধিক। উপপরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা
'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত' ও 'সময় অসময়ের বৃত্তান্ত' পড়ে কী এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এরপর পড়েছি 'খরার প্রতিবেদন', 'দাঙ্গার প্রতিবেদন' প্রভৃতি গ্রন্থ। দেবেশ রায় ক্রমশ আমার কাছে আদর্শ হয়ে উঠতে থাকেন। জীবনে কোনোদিন উপন্যাস লিখিনি, লেখার চেষ্টাও করিনি, কিন্তু এইসব গ্রন্থ পাঠ করে মনে হতে আমিও যদি এরকম লিখতে পারতাম! কিন্তু কখনো উপন্যাস লেখার দুঃসাহস করিনি। বাংলাদেশের প্রিয় কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের প্রেরণায় একখানা উপন্যাস লিখে তা প্রকাশের আগেই পেয়ে গেলাম 'জেমকন সাহিত্য পুরস্কার'| স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, লেখার জন্য পাওয়া দশদিনে প্রায় প্রতি মুহূর্তেই ভেবেছি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, হরিপদ দত্ত, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখের উপন্যাস রচনার কৌশলের কথা। শেষতক কারো মতোই হয়নি। নিজের লেখা উপন্যাস নিয়ে এত অস্বস্তি যে, তিন বছর পেরিয়ে গেলেও ওটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের ব্যাপারে পুরস্কারদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের একটিবারের জন্যও তাগাদা দিইনি। সুযোগ পেলে নতুন করে লিখব ওই উপন্যাস।
আমার উপন্যাসটিতে এত উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছি যে, কথার চেয়ে তথ্য বেশি হয়ে গেছে। এই দুর্বলতা জেনেও তা মোচনের শক্তি আমার নেই বলেই মনে করি। বিচারক-পর্ষদের সদস্য আমার প্রিয় লেখক কিন্নর রায়কে এই কথা ধজানালে তিনি বলেন, 'দরকার কী নতুন করে লেখার? ফিকশনের কি কোনো বাঁধাধরা নিয়ম আছে? তুমি এরকম আর দু-একটা উপন্যাস লিখে ফেলো, দেখবে এটিই উপন্যাসের একটি ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে।' আমি কিন্নর রায়ের কথায় আশ্বস্ত হই। এরই মধ্যে বেরিয়ে যায় জাকির তালুকদারের 'মুসলমানমঙ্গল' এবং অদিতি ফাল্গুুনীর 'কিম্পুরুষ ১৯৭১ : দ্য ক্যান্টারবারি টেলস্' উপন্যাস পড়ে আমার মনে কিছুটা স্বস্তি এল যে তথ্যভারাক্রান্ত হলেও তা ফিকশন হতে পারে। এরই মধ্যে হাতে এসে যায় দেবেশ রায়ের 'বরিশালের যোগেন মণ্ডল'। ১০৫৯ পৃষ্ঠার বিশাল উপন্যাস। এটি যে উপন্যাস তা বোঝাতে বইয়ের নামের নিচে 'উপন্যাস' শব্দটি লিখে দিতে হয়েছে। বইয়ের পরিচয়পত্রে জানানো হয়েছে, 'এই নতুন সময়ে বাংলার তফশিলি নেতা বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন অবিসংবাদী শূদ্রনেতা। তিনিই প্রথম বলেন, উচ্চবর্ণ হিন্দুদের রক্ষা করা শূদ্রদের কাজ নয় ও মুসলমানদের সঙ্গে শূদ্রদের শ্রেণিগত মিল অনেক বেশি। এই শূদ্র যোগেন মণ্ডলই একমাত্র ভারতীয় যিনি পাকিস্তানকে তাঁর স্বদেশ বলেছিলেন ও সেই কালবেলায় ভারতবর্ষ-ধ্যানটিকে রক্ষা করেছিলেন।' এই বক্তব্য লেখকের নয়, প্রকাশকের। কিন্তু পাঠক এ থেকে উপন্যাসের বিষয় সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন।
বিশাল এই উপন্যাসে রয়েছে ২০টি অধ্যায়। আর প্রতিটি রয়েছে ১৮১টি উপশিরোনামে বিস্তৃত আখ্যান। অধ্যায় বিন্যাসের শুরু তে লেখক বলেছেন, 'যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল প্রায় সম্পূর্ণ বিস্মৃত এখন। ১০৩৭ থেকে ৪৭-এই দশটি বছরে তিনি ছিলেন বাংলার নমঃশূদ্রদের অবিসংবাদী নেতা। বাংলার ও ভারতের রাজনীতিতে পরে তিনি প্রধানতম বিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন। ১৯৪৩-এ খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন। ৪৬-এ পুনর্নির্বাচিত হয়ে সারওয়ার্দির মন্ত্রিসভাতেও। ১৯৪৬-এ তিনি মুহম্মদ আলি জিন্নাহ কর্তৃক অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভায় মুসলিম লিগের প্রতিনিধি মনোনীত হওয়ায় হিন্দু ও মুসলিম দুই জাতের শত্রু হয়ে পড়েন। তিনি পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫০-এ কলকাতায় চলে আসেন। আম্বেদকর ও যোগেন মণ্ডল তাঁদের শূদ্রতার কারণে কোনো জাতীয়তাবাদেই গৃহীত হননি। বহু নিন্দা ও বিরোধিতার পর কংগ্রেস দলিত-ভোটের জন্য আম্বেদকরকে জাতীয়-আখ্যানের দেবমণ্ডলিতে জায়গা করে দেয়। বাংলা বিভক্ত হওয়ায় যোগেন মণ্ডল সম্পর্কে তেমন কোনো দায় বা ভয় জাতীয়তাবাদীদের ছিল না। তাঁকে তাই ইতিহাস থেকে স-ম্-পূ-র্ণ মুছে দেয়া হয়েছে। তাঁর নাম কোনো স্থানীয় ইতিহাসের ফুটনোটেও তাকে না।' লেখকের এই বক্তব্যে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাস রচনার প্রেরণা ও তাৎপর্যের কথা। ইতিহাসে উপেক্ষিত মনীষীতুল্য এই নেতা ও সংস্কারককে নিয়ে বিশাল প্রেক্ষাপটের উপন্যাস লেখার জন্য দেবেশ রায় বাংলাসাহিত্যে তাঁর পাকা অবস্থানকে উজ্জ্বল করলেন। প্রান্তবাংলার প্রেক্ষাপটে অজস্র চরিত্র নির্মাণ ও উপকাহিনির বয়ানে 'বরিশালে যোগেন মণ্ডল' হয়ে উঠেছে এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। যে যোগেন মণ্ডল সম্পর্কে কোনও দায় নেননি জাতীয়তাবাদীরা, ইতিহাসের সে দায়ই নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে লেখক দেবেশ হয়ে উঠলেন নতুন ইতিহাসের নির্মাতা। 'বরিশালে যোগেন মণ্ডল' যুগপৎ উপন্যাস ও ইতিহাস গ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা পারে।
যোগেন মণ্ডল বরিশালের মৈস্তারকান্দি গ্রামে নমঃশূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ ও বিএল ডিগ্রি নিয়ে আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি বরিশাল সদর লোকাল বোর্ডেও সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে সাধারণ নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে বাখরগঞ্জ উত্তর-পূর্ব আসন থেকে অশ্বিনী দত্তের ভাইপো সরল দত্তকে হারিয়ে এমএলএ নির্বাচিত হন। সরল দত্ত জমিদার এবং উচ্চবর্ণেও মানুষ ছিলেন। তিনি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জিতেছেন। নির্দলীয় প্রার্থী হওয়ায় নমঃশূদ্র এবং মুসলমানদের ভোটও পেয়েছেন। কিন্তু নমঃশূদ্রের প্রার্থী ছিলেন না। তিনি যতখানি এই নির্বাচনে শূদ্রনেতার চেয়ে জননেতার ইমেজটাই মুখ্য হতে পারে। কিন্তু তাঁর এই অভূতপূর্ব সাফল্যকে ম্লান করা হয় শূদ্রনেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায়। ১৯৪০ সালে তিনি সুভাষচন্দ্র বসু ও শরৎ বসুর সহযোগিতায় কলকাতা সিটি করপোরেশনের ৩নং বটতলা ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি তফশিলি ফেডারেশনের প্রার্থী হিসেবে পিরোজপুর-পটুয়াখালী কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে সোহরাওয়ার্দির মন্ত্রিসভায় বিচার, পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রী হন। ৪৭-এর দেশভাগে তাঁর সায় ছিল না। তিনি দেশভাগের বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তবে দেশভাগের পাশাপাশি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা গঠনের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দি, আবুল হাশিম, শরৎ বসু প্রমুখ নেতা, সে উদ্যোগের সঙ্গেও ছিলেন যোগেন মণ্ডল। অন্যরা জাতীয় নেতার স্বীকৃতি পেলেও যোগেন মণ্ডল হয়ে পড়লেন সমালোচিত ও বিতর্কিত। তিনি তখন করাচি চলে যান। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের অস্থায়ী স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৫ আগস্ট দেশভাগ গলে তিনি পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ঢাকা-বরিশাল-খুলনা অঞ্চলে ভয়াবহ দাঙ্গায় সংখ্যালঘুদের পক্ষে সরকারের নীরবতার প্রতিবাদে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এর পরের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। এর পরে তিনি কলকাতা চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও কোনো নির্বাচনেই বিজয়ী হতে পারেননি। এমনকি ১৯৬৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে বামফ্রন্টের সমর্থন নিয়ে আরপিআই-এর প্রার্থী হিসেবেও বারাসাত লোকসভা কেন্দ্র থেকে পরাজিত হন। এভাবেই ১৯৩৭ সালের বিজয়ী নায়ক ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবন শেষে করুণ পরাজয়ের মধ্য থেকে মঞ্চ থেকে বিদায় নেন। আস্তে আস্তে তিনি হারিয়ে যান বাংলার ইতিহাস থেকেও। দেবেশ রায় তাঁকে তুলে ধরেন রাজনীতির নায়ক হিসেবেই।
উপন্যাস হিসেবে এত বাস্তব চরিত্রকে ধারণ করা যত কঠিনই হোক, দেবেশ রায় তাতে সফল হয়েছেন বলেই ধরে নেয়া যায়। কেবল যোগেন মণ্ডল নয়, তার পারিবারিক জীবন, তাঁর প্রতিবেশ, তাঁর সময়ের বাংলার রাজনীতি সবই তুলে আনা হয়েছে এই উপন্যাসে। তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের মূলে যে 'বরিশাল হিতৈষী'র সম্পাদক দুর্গামোহন সেনের ভূমিকা ছিল, কাহিনির শুরু সেখান থেকেই। দুর্গামোহন সেনের কলমে যোগেন হয়ে ওঠেন 'বরিশালের মেগাস্থিনিস' | যোগেনকে ভোটে দাঁড়াতেও উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। ভোটের প্রচারণা নিয়েও গড়ে উঠেছে চমৎকার সব আখ্যান। কোনো কোনো স্থানে হয়তো কাল্পনিক চরিত্র ও ঘটনা যুক্ত হয়েছে, তাতে মূল কাহিনির কোনো সমস্যা হয় না। দেবেশ রায় তো ইতিহাস লিখছেন না, লিখছেন উপন্যাস। তাই কল্পনার মিশেল তো থাকবেই। দেবেশ রায় তো ইতিহাসের চরিত্রের রূপায়ণ করছেন, তাই ইতিহাসের মোটাদাগের ঘটনা-তারিখকে অক্ষুণœ রাখতে হয়। সেই চেষ্টাতেও তিনি আন্তরিক। আর এত বড় মাপের কাজ করতে গিয়ে কিছু অসঙ্গতি হয়তো আবিষ্কার করা যায়, কিন্তু উপন্যাসের ক্ষেত্রে এহ বাহ্য! যেমন যোগেনকে দিয়ে কবিগানের আসরে ঢোল বাজানো হয়েছে। কবিগান শুনতে শুনতে ভাববিষ্ট যোগেন আসরে উঠে পড়বেন, তা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না। লেখা হয়েছে,
'যোগেন পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় বৈরাগীর পাশে। বৈরাগী মাটি ছুঁয়ে নমস্কার করে গুরে ঢোলওয়ালার গলা থেকে ঝোলানো ঢোলটা খুলে এনে যোগনকে পরিয়ে দেয়। যোগেন, ঢোলে টোকা দিয়ে চারিদিকে তাকিয়ে চোখদুটো ঢোলে ফিরিয়ে এনে কিছু জিজ্ঞাসা করে বৈরাগীকে। বৈরাগী সম্মতি দেয়। … ঢোলটা যোগেনের টোকায় জোওে বেগে উঠতেই যোগেন বেশ উছচু গলায় গানের সুরে রৈাগীকে জিজ্ঞেস করে।
প্রশ্ন : যোগেন
পদ্মবিলায় যাবৎ যবন যদি নিধনই করিলা।
তাইলে এত মজুদ যবন কোথাথিক্যা পাইল॥'
ঢোল বাজানো একটা পেশাদার ব্যাপার। তা একদিনের টোকায় আয়ত্ত হয় না। তাই ঢোল বাজিয়ে কবিগানের পদ তৈরি করে সুর করে গাওয়ার বিষয়টি যোগেনের মতো নেতার পক্ষে বেমানান।
মুসলমানদের সঙ্গে নমঃশূদ্রদের কাইজ্যা বা দাঙ্গার কথা যেমন বলা হয়েছে, ওই একই এলাকায় উলপুরের জমিদারদের সঙ্গে অর্থাৎ উচ্চবর্ণের ক্ষমতাধরদের সঙ্গে নমঃশূদ্রদের লাড়াইয়ের ঘটনাও রয়েছে। এবং এই লড়াইয়ে নমঃশূদ্রদের পক্ষে ছিল এলাকার মুসলমানরা। পক্ষ হলো জমিদার বনাম প্রজা। নমঃশূদ্র আর মুসলমান তখন একসঙ্গে জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। সেই কাহিনি যুক্ত হলে পদ্মবিলার কাইজার কাহিনি হালে পানি পেত। তাছাড়া পদ্মবিলা কাইজ্যার ঘটনায় গুরুচাঁদ ঠাকুরের হাত আছে বলে যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা-ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। গুরুচাঁদ ঠাকুর ওই এলাকার হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ও বাঁচার অধিকার আদায়ের নেতা। ধর্মীয় নেতার চেয়ে তিনি সমাজসংস্কারক হিসেবেও কম সম্মানিত নন। বাস্তবতা তো নয়ই, জনশ্রুতিও সায় দেয় না এ ব্যাপারে।
আমরা দেবেশ রায়ের এই উপন্যাস-পরিকল্পনাকে সাধুবাদ জানাই। পশ্চিমবঙ্গের পাঠক এই উপন্যাসকে কীভাবে নিয়েছেন, জানি না, বাংলাদেশের পাঠক একে উপন্যাসের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়ে পড়েছে, সেই সাক্ষ্য দিতে পারি। তবে তথাকথিত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে এই উপন্যাস নিয়ে যতটা আগ্রহ লক্ষ করা গেছে, তথাকথিত উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ের মধ্যে তেমনটা নয়। দেবেশ রায় যে দায় নিজের কাঁধে তুলে নিলেন, তা কি শুধু তাঁর কাঁধেই থেকে যাবে। এই উপন্যাসের পরেও কি যোগেন মণ্ডল কোনো জাতীয়তাবাদে গ্রহণীয় হবেন না? এই উপন্যাস পড়তে পড়তে নিজের প্র্রতি আরো কিছু প্রশ্ন জেগে উঠেছে -
? পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পরেও যোগেন শুধু 'বরিশালের' যোগেন মণ্ডল হয়ে থাকবেন?
? কংগ্রেস বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বিপুল ভোটে এমএলএ হওয়ার পরেও তিনি নমঃশূদ্রদের নেতা হিসেবেই পরিচিতি হবেন?
? আইনজীবী হিসেবে তো বটেই কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবেও তাঁর কর্মকা- ছিল। এমএলএ এবং পরে মন্ত্রী হয়ে তিনি সংসদে ইংরেজি ভাষায় বক্তৃতা দিতেন। তারপরেও বরিশালের মানুষ প্রমাণ করার জন্য তাঁর মুখে গোঁজামিল দেয়া 'বরিশাইল্যা' উপভাষা যুক্ত করা কি খুব বেশি দরকার ছিল?
এই প্রশ্নের জবাব আমি বারান্তরে খুঁজে দেখব। আপাতত মনে করি দেবেশ রায়ের 'তিস্তাপারের বৃত্তান্ত', 'ইচ্ছামৃত্যুর প্রতিবেদন', 'আঙিনা, 'মার-বেতালের পুরাণ' কিংবা 'যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ' গ্রন্থের মতোই এটি পাঠকপ্রিয় হবে। এবং এই গ্রন্থ লাভ করবে যুগপৎ উপন্যাস ও ইতিহাসগ্রন্থের মর্যাদা।
——-
বরিশালের যোগেন মণ্ডল ॥ দেবেশ রায়
দে'জ পাবলিশার্স
প্রকাশকাল বৈশাখ ১৪১৭
প্রচ্ছদ : নিবেদিতা সেনের আলোকচিত্র এবং তৃপা রায়ের নামলিপি
পৃষ্ঠা : ১১৫৯
দাম : ৮০০ টাকা
http://www.clickforboireview.in/?p=787
তফশিলি সম্প্রদায় আর চণ্ডাল এক নয়
১০৬৯ পৃষ্ঠার দেবেশ রায় লিখিত বৃহৎ কলেবরের বইটিতে যেমন রয়েছে প্রচুর তথ্যবিভ্রাট, তেমনি রয়েছে জাতি-বর্ণ সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা। এখানে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা যায় : প্রথমত, দেবেশ রায় বারবার 'নমঃশূদ্র' সম্প্রদায়কে 'শূদ্র' বলে উল্লেখ করেছেন, যা মিহির সেনগুপ্তের প্রবন্ধেও উদ্ধৃত হয়েছে। কিন্তু হিন্দুদের বর্ণভেদপ্রথায় 'নমঃশূদ্র' এবং 'শূদ্র' দুটি ভিন্ন বর্ণ। নমঃশূদ্ররা প্রধানত কৃষিসংস্কৃতির ধারক; অন্যদিকে শূদ্র হলো কায়স্থ, বৈদ্য ইত্যাদি কয়েকটি অকৃষি জাতের বর্ণনাম। দেবেশ রায় যদি কায়স্থ হয়ে থাকেন এবং মিহির সেনগুপ্ত যদি বৈদ্য হয়ে থাকেন, তাহলে হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী তাঁরাই শূদ্র, যোগেন মণ্ডল নন। হিন্দুদের বর্ণভেদপ্রথা সম্পর্কে দেবেশ রায় এবং মিহির সেনগুপ্ত উভয়েরই জ্ঞান যে অস্পষ্ট, এর প্রমাণ তাঁরা এভাবে যত্রতত্র দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, ব্যাকরণবিদ-পুরুষের সম্ভ্রম দেওয়ার ব্যাপারে দেবেশ রায় এবং মিহির সেনগুপ্ত ভুল করেছেন। সুভাষচন্দ্র বসু এবং ভেগাই হালদার যোগেন মণ্ডলের বয়োজ্যেষ্ঠ, তাঁদের তিনি 'আপনি' বলে সম্বোধন করতেন। অথচ তাঁদের যোগেন মণ্ডল যথাক্রমে 'তুমি' ও 'তুই' বলে সম্বোধন করেছেন বলে দেবেশ রায় তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, যা বাস্তবতার সঙ্গে বেমানান। বিশেষভাবে ভেগাই হালদার (১৮৪৩-১৯৩৩) যেখানে যোগেন মণ্ডলের (১৯০৪-১৯৬৮) চেয়ে ৬১ বছরের বড়।
তৃতীয়ত, যোগেন মণ্ডল নিজেকে 'চণ্ডাল সম্প্রদায়ের' নেতা বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন বলে দেবেশ রায়ের যে দাবি, তা আদৌ সত্য নয়। বাস্তবে যোগেন মণ্ডল গোটা তফসিলি সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন, কোনো কাল্পনিক চণ্ডালদের নেতা নয়। লেখক হয়তো সাঁওতাল বা মুণ্ডাদের মধ্যে উদ্ভূত কোনো বীরের সঙ্গে যোগেন মণ্ডলকে তুলনা করে থাকবেন, কিন্তু তা বাস্তবের সঙ্গে মোটেই সংগতিপূর্ণ নয়। লেখক বা আলোচকের অজানা থাকার কথা নয় যে ১৯৩৬ সালে তদানীন্তন ভারতবর্ষে 'বর্ণহিন্দু', 'তফসিলি হিন্দু' এবং 'অন্যান্য পশ্চাৎপদ শ্রেণী' নামে বর্ণ ও শ্রেণী বিভাজনের সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর মধ্যে হিন্দুদের অনগ্রসর ছোট-বড় ৬০টি সম্প্রদায় নিয়ে 'তফসিলি হিন্দু' গঠিত। এদের সবাইকে চণ্ডাল বলাটা শুধু অশোভনই নয়, সত্যেরও অপলাপ। তা ছাড়া যোগেন মণ্ডল যে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মেছিলেন, সেই সম্প্রদায়কে তিনি কোনোক্রমেই 'চণ্ডাল' বলতে পারেন না। প্রধান কারণ, ব্রিটিশ ভারতের আইন অনুযায়ী তখন কোনো জাতিগোষ্ঠীকেই 'চণ্ডাল' বলা যেত না। আইন বিশারদ, আইন প্রণেতা এবং অবিভক্ত ভারতবর্ষ, অবিভক্ত বাংলা ও পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি তা ভালোভাবেই জানতেন।
চতুর্থত, লেখকের স্বাধীনতা থাকবে, কিন্তু সেই স্বাধীনতায় এমন কিছু কাম্য হতে পারে না, যাতে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রকাশ পায়। দেবেশ রায় এবং মিহির সেনগুপ্ত দুজনই লেখালেখির জগতে বেশ খ্যাতিমান। তাঁদের মতো গুণীজনের কাছ থেকে শালীনতা ও ভব্যতা ভিন্ন অন্য কিছু আশা করা অনুচিত।
পঞ্চমত, দেবেশ রায় যোগেন মণ্ডলকে কখনো কখনো প্রাজ্ঞ রাজনীতিক, এমনকি বরিশালের শ্রেষ্ঠ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু চরিত্র চিত্রণের মধ্য দিয়ে দেবেশ রায় যখন যোগেন মণ্ডলকে ষড়যন্ত্রকারী বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করেন, তখন তা সমকালীন হিন্দু মহাসভার দৃষ্টিভঙ্গিকেই মনে করিয়ে দেয়। হিন্দু মহাসভার সেই মনোভাব মিহির সেনগুপ্তকেও ধারণ করতে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
ষষ্ঠত, দেবেশ রায়ের বই এবং মিহির সেনগুপ্তের প্রবন্ধ দুটিই যেহেতু সম্পূর্ণভাবে যোগেন মণ্ডলকে ঘিরে, তাই মণ্ডলের রাজনীতির ফসল কি তা নিয়ে স্বল্পাকারে আলোচনা করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিষয়টি কারো অজানা নয়, যোগেন মণ্ডল তথাকথিত বর্ণহিন্দুদের বৈষম্যের কারণে অভিমান ও ক্ষোভে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য মুসলিম লীগকে সমর্থন করেন। জানা যায়, বিনিময়ে জিন্নাহসহ অন্য মুসলমান নেতারা মণ্ডলের তফসিলি সম্প্রদায়কে বিশেষ সুবিধা দেবেন বলে মৌখিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী খুব শিগগিরই তা ভুলে যায়। ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় যোগেন মণ্ডল দেখেন, তফসিলিরাই ব্যাপকহারে হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। কারণ এরই মধ্যে অধিকাংশ বর্ণহিন্দু তাঁদের দেশান্তর প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছেন। নমঃশূদ্রদের দোষ, তাঁদের নেতা যোগেন মণ্ডলের আশ্বাসে তাঁরা দেশত্যাগ করেননি, বিশ্বাসে এবং মাটির টানে থেকে গেছেন তাঁদের হাজার বছরের মাতৃভূমিতে। যোগেন উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হন। পাকিস্তানের কর্ণধারদের কাছে আকুল আবেদন জানান দাঙ্গা বন্ধ করে তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার জন্য। তখন পাকিস্তানিরা যোগেন মণ্ডলকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। জীবন রক্ষার্থে তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। সংক্ষেপে এটাই হচ্ছে যোগেন মণ্ডলের রাজনৈতিক ট্র্যাজেডির বর্ণনা।
তথাকথিত বর্ণহিন্দু বা হিন্দু মহাসভাপন্থীদের মতে, যোগেন মণ্ডলই পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য দায়ী। কিন্তু প্রশ্ন_মুসলিম লীগকে যোগেন মণ্ডল সমর্থন না দিলেও কি পাকিস্তান সৃষ্টি হতো না? অবশ্যই হতো। তবে তাতে হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে সিলেট অঞ্চল বাদ পড়ে যেত। কারণ যোগেন মণ্ডলের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ৫৩% - ৪৭% ভোটে বিজয়ী হয়ে মুসলিম লীগ ওই অঞ্চলটি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। এটা যদি যোগেন মণ্ডলের দোষ হয়, তাহলে সে দোষ অবশ্যই একপেশে; কারণ একমাত্র হিন্দুত্ববাদীরাই এটাকে দোষের মনে করবেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বা বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা এটিকে নিছক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবেই দেখবেন। তা ছাড়া এ ধরনের মন্তব্যে ব্রিটিশবিরোধী একাংশের আন্দোলন-সংগ্রামকে চোখ বন্ধ করে অস্বীকার করা হয়। আর তাই প্রকারান্তরে তা দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অবিকল মানচিত্র নিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রকেও অস্বীকার করার শামিল। দেবেশ রায় এবং মিহির সেনগুপ্তসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
বীরেন্দ্রনাথ অধিকারী
এফ-৬ নিপসম স্টাফ কোয়ার্টার, মহাখালী, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৭৩০৪৪৪৭৮২
bn.adhikary@gmail.com
এক হাজার ঊনষাট পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির পাঠ শেষ করে আমার মনে হলো, এর চেয়ে তাঁরা তলস্তয়ের 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' গ্রন্থটি আলোচনার জন্য দিলেও বোধ হয় অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। অবশ্য এর দ্বারা ওই গ্রন্থ দু-খানিকে তৌল করতে চাইছি না। তবে কথাটা যখন উঠল, তার কারণ তো একটা আছেই। প্রাথমিকভাবে এর কারণ হলো গ্রন্থটির বিপুল আয়তন রাজনৈতিক ঘটনা, উপঘটনা, অনুঘটনা এবং অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ, যার আশ্রয় মূলত ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭, এই দশকটির ইতিহাস। যুদ্ধ? হ্যাঁ, যুদ্ধও তো আছেই। গ্রন্থখানির আদ্যন্ত বিশ্লেষণ সম্ভব নয় এবং সে রকমটি কেউ আশাও করেন না, তার প্রয়োজনও নেই। আমার প্রচেষ্টা শুধু ওই দশকটির সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেবেশ রায় যোগেন মণ্ডলকে কিভাবে আধুনিক নাগরিকবৃত্তে উপস্থিত করে তদানীন্তন তাবড়জাতীয় নেতাদের রাজনৈতিক স্বরূপ উদ্ঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন, তাই নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলা। মোদ্দাকথা, গ্রন্থখানির একটি সাধারণ পরিচয় পাঠকদের কাছে তুলে ধরা। সে কাজটিও যথাযথ করতে পারব। এমন ভরসা কম। তথাপি যত্নে-কৃতে যদি ন সিদ্ধতি....ইত্যাদি।
আজ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কথা যাঁরা কখনোসখনো আলোচনা করেন, তাঁরা মূলত দ্বিভক্ত। তাঁরা নমঃশূদ্র সমাজের মানুষ।
১৯৫০-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে যে বিপুল নমঃশূদ্র সমাজের মানুষরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় চলে আসতে বাধ্য হন, তাঁরা যোগেন্দ্রনাথকে এ জন্য সর্বাংশে দায়ী মনে করেন। তাঁদের একসময়ের গোটা বাংলার অবিসংবাদী নেতা ছিলেন যিনি। দাঙ্গার সময় পালিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গে তিনি হয়ে উঠলেন বিশ্বাসঘাতক। এখানে এসেই তিনি পাকিস্তানের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। জিন্নাহর সঙ্গে, পাকিস্তান সমর্থনকারী হিসেবে যোগ দিয়ে তিনি জাতীয় ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান উভয়ের কাছেই শত্রু এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিগণিত হচ্ছিলেন। পরে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের গুরু আম্বেদকারের কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি দলিতদের কাছ থেকেই প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। অনেক হিসাব-নিকাশের পর মূলত দলিত ভোটের স্বার্থে জাতীয় ইতিহাসে, একেবারে হাল আমলে আম্বেদকার গৃহীত হলেও যোগেন উপমহাদেশের এ তিনটি দেশের কোথাও নামমাত্র উলি্লখিত হওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী আজও হননি।
এটুকুই দেবেশ রায় মশাইয়ের উপন্যাসের কাহিনী চুম্বক মোটামুটি। এ রকম একজন বিতর্কিত শূদ্রনেতাকে তিনি তাঁর গ্রন্থের নায়ক করেছেন। গ্রন্থে লেখক নিজেই এক স্থানে বলেছেন, 'যোগেন মণ্ডল লোকটি এ গল্পে সত্যের সবচেয়ে বড় অছিলা।' আসলে আমার মনে হয় প্রাদেশিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতিহাসের এই জটিলতম সময়ের সম্ভাব্য তাবৎ জটিলতাগুলোকে ধরার জন্যই উপন্যাসটিকে ইতিহাসের একটি ধাঁচা বানিয়েছেন তিনি।
যেহেতু ইতিহাসের ওই সময়টার দলিলীকৃত সত্যের চেয়েও গভীর কোনো সত্যের উদ্ঘাটন তিনি করতে চেয়েছেন সে জন্যই কি এ প্রচেষ্টা তাঁর? এ সময়ের ইতিহাসের কুয়াশাচ্ছন্নতাকে অপনোদন করার জন্যই কি সত্যের অছিলা হিসেবে যোগেনের উপন্যাসে প্রবেশ, কারণ ইতিহাস থেকে তাঁকে মুছে দেওয়া হয়েছে। অথচ ইতিহাসের তাঁকে প্রয়োজন নেই এ কথা বলা যাচ্ছে না? ইতিহাস যে এখন শূদ্র গবেষণার সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র! একাডেমিক পলিটিক্যাল নেসেসিটি!
এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক কারণে আমি একটু দীর্ঘ হলেও পর পর দুটি প্যারাগ্রাফ উদ্ধৃত করব। আমার ধারণা, তাতে লেখক এবং যোগেন্দ্রনাথ উভয়ের বক্তব্যই পরিষ্কার বোঝা যাবে। বিশেষত গ্রন্থখানি যেসব অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে সেই সম্বন্ধে।
লেখক লিখেছেন, ''ভারতের স্বাধীনতা পাওয়ার চেষ্টার একেবারে শেষ দশকে সারা ভারতে সে (যোগেন) একমাত্র নেতা যে পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থন করেছিল, বঙ্গভঙ্গের (১৯৪৭ এর?_প্রবন্ধকার) বিরোধিতা করেছিল, তফসিলি হয়েও হিন্দু থাকেনি ও পাকিস্তান প্রস্তাব মানলেও যে শূদ্র মুসলিম হয়নি। ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যালঘু, প্রধানত নমঃশূদ্র হত্যার প্রতিবাদ করেছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে, জিন্নাহীন পাকিস্তানের সামরিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নেতারা তাঁকে খুন করার ষড়যন্ত্র ফেঁদেছিল। সে তাদের ফাঁসিয়ে দিয়ে পালাতে পারে।
এই প্রায় ১০ বছরের রাজনীতিতে হিন্দুরা তাঁকে পার্টিশনের ভিলেন ও মুসলিম লীগের চর যে নিন্দা সারা বাংলায় রটিয়েছিল, তার প্রধান প্রচারক ছিল, তখন হিন্দু মহাসভাগ্রস্ত কংগ্রেস, তার প্রধান বাহক ছিল হিন্দু খবরের কাগজ ও পরে, তার প্রধান তাত্তি্বক ছিল আমাদের জাতীয় হিস্ট্রির লেখকরা। এ জাতীয় হিস্ট্রি রক্তের শ্বেত-কণিকার মতো
এমন হিন্দুয়ানিতে সংক্রামিত যে সেই সংক্রামক ইতিহাস থেকেও তাঁকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিল।'' (যতিচিহ্নাদি লেখকের), এই নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টার মধ্যে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। কারণ বাঙালি হিন্দুর জাতপাত এবং বর্ণভেদের ওপরই তাদের সমাজটা প্রতিষ্ঠিত এবং এর উদ্ভব তথাকথিত আর্য ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম প্রথার থেকেই। সেখানে অস্পৃশ্য অন্ত্যজ পর্যায়ে যে মানব গোষ্ঠী। যাদের নিচে আর কেউ নেই, সেই সমাজজাত এক জাতক হচ্ছেন যোগেন। চাতুর্বর্ণীয় বিধি অনুযায়ী সে শূদ্রও নয়, অসৎ শূদ্রেরও নিম্ন পর্যায়ে। শূদ্রও তার বা তাদের সেবা দাবি করতে পারে। বাঙালি হিন্দু বর্ণভেদে অর্থাৎ জাতপাত বিন্যাসে ছত্রিশ বা একচলি্লশ জাতের একেবারে প্রত্যন্তে তার একটা অবস্থান জুটেছে_'চাড়াল' হিসেবে। বৃত্তি নির্দিষ্ট হয়েছে নৌকার মাঝিগিরি। নৌকা নির্মাণ ইত্যাদি কাজকর্ম। এ রকমই নাকি বাঙালি হিন্দুর বা সর্বভারতীয় হিন্দুর অভ্যন্তরে যোগেনদের অর্থাৎ নমঃশূদ্রদের অন্তর্ভুর্ক্তি। সুতরাং যোগেনরা হিন্দু, তবে সেটা উচ্চ জাতীয়দের প্রয়োজনভিত্তিক, যেমন 'সেন্শাসের' সময় জাত হিসেবে (এ ক্ষেত্রে জাতি হিসেবে) হিন্দুকে সংখ্যাগুরু প্রমাণ করার তাগিদে, পরবর্তীকালে ভোটের দরকারে। প্রয়োজন, শুধু প্রয়োজনের তাগিদেই তারা হিন্দু জাতিগতভাবে নয়। সরকারি তফসিলে নির্দিষ্ট, অনুন্নত হিন্দু সম্প্রদায় হিসেবে। কিন্তু তারা অস্পৃশ্যও।'
এতগুলো কথা খাম্চে খাম্চে বলার কারণ এই যে যোগেন নিজেকে অহিন্দু ভাবে। তার মতে, নমঃশূদ্ররা মুসলমানদের স্বাভাবিক মিত্র। যোগেনের এই ভাবার পেছনে মনে হয়, বাঙালি হিন্দুবর্ণবাদী সমাজের সুদীর্ঘকালের বঞ্চনা ও নিপীড়নের ফলে সঞ্জাত স্বাভাবিক অভিমান কাজ করে। সে বলতে চায়, দুটি কথা। "সুভাষ চন্দ্রের সঙ্গেও তার এ নিয়ে কথা হয়েছিল। একটি কথা_তফসিলিদের রাজনৈতিক পরিচয় তফসিলি। অন্য পার্টিতে, কী আন্দোলনে তফসিলরা থাকতে পারে, যেমন মজুর আন্দোলনে, কৃষক আন্দোলনে।... যোগেন শূদ্র কথাটাই বলে বেশি। 'শুদ্দুর'ও বলে। 'চাঁড়াল' বলেও নিজের পরিচয় দেয়।"
তার দ্বিতীয় কথাটিও এ রকমই সাদা সরল। 'শূদ্ররা শূদ্র। তারা হিন্দু হওয়ার ফলে শূদ্র নয়। কোনো রকম হিন্দুগিরির ছোঁয়া শূদ্রকে রক্ষা করে না। গান্ধীজিরও না। হিন্দু মিশনেরও না। মন্দিরে ঢোকার আইন পাস করে বা শুদ্ধি করে শূদ্রের শূদ্র থাকাটাকে শুধু অস্থির করা যায়। শূদ্রের স্বাভাবিক আত্মীয়তা মুসলমানদের সঙ্গে। শূদ্রও মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট, আয়-ব্যয়, চাষ-আবাদ, মাছ ধরা, নৌকা চালানো, সুখ-অসুখ, চেঁচামেচি, ডাকাডাকি, অসুখ-বিসুখ, টোটকা-টুটকি_সবই এক রকম। তাহলে কোথাও হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাধলেই শূদ্ররা গিয়ে বামুন কায়েত হিন্দুদের লেঠেল হবে কেন?' (উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি)।
মনে হয়, যোগেনের এসব ভাবার পেছনে শুধু একমাত্রিক একটা কারণই দায়ী, ব্যাপারটা বোধ হয় অতটা সরল নয়। বাঙালি হিন্দুর সমাজ-বিন্যাসের হাজার বছরের আরো লক্ষাধিক কারণও বোধ হয় আছে। সেখানে বর্ণবাদী বাঙালি হিন্দুর সমাজ-বিন্যাসের সঙ্গে সেন আমলের সামন্তবাদী পরম্পরা একটা বড় ব্যাপার। তার সঙ্গে পরবর্তীকালীন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভূমিকাটাও নিঃসন্দেহে ব্যাপকভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। অবশ্য শেষ নবাবি আমলের হিন্দু-মুসলমান সামন্তরাও যেকোনোভাবে দায়িক নয়, এমনও বলা যায় না। নচেৎ পঞ্চাশের দাঙ্গায় নমঃশূদ্ররা বামুন-কায়েত তো দূরস্থান, নিজেদের জন্যও কি কোনো প্রতিরোধ তৈরি করতে পেরেছে? অথবা যে মুসলমান সমাজের সঙ্গে তাদের মিলই বেশি বলে যোগেনের দাবি তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তো সাম্প্রদায়িক নয়, তাদের শ্রেণী বিদ্রোহে ফেটে পড়ারই কথা ছিল। অন্তত তেভাগা আন্দোলনেও তো যোগেন বা তার দল 'মুসলিম লীগকে' কৃষকের পাশে দেখি না। কথাটা এ কারণে উঠল যে যোগেন রাজনীতিগতভাবে মজুর বা কৃষক আন্দোলনে থাকতে কোনো আপত্তি জানায়নি। তেভাগার সময়ে তো সে অন্তর্বর্তী সরকারে লীগের পাঁচজনের একজন হয়ে মাউন্টব্যাটেনের আইন মন্ত্রী। পুলিশ, কংগ্রেস এবং লীগের আক্রমণে তো সেদিনের আন্দোলন ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। তেভাগার কৃষক-সংগ্রামে তো শিডিউল এবং মুসলমান চাষিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। যোগেনের সেই কর্মকাণ্ডে বা অকর্মকাণ্ডে (?) কী ভূমিকা ছিল তার খবর জানি না। তবে ১৬ আগস্টের ডাইরেক্ট অ্যাকশনে যে তার সমর্থন ছিল তা যদিও উপন্যাসে উলি্লখিত হয়েছে, কিন্তু 'অ্যাকশনটা' ডাইরেক্টলি কাদের বিরুদ্ধে তা নিয়ে যোগেনের কোনো প্রশ্ন দেখি না।
এ কথাগুলো আমি যে ঠিক উপন্যাসের নিরিখেই তুলছি, তা নয়। কারণ গ্রন্থটি শুধু উপন্যাসই নয়, তার পরিধিটা অনেক ব্যাপক।
এ কারণেই কি যোগেনের নিষ্ক্রান্ত হওয়ার 'স্বাধীনতা' বা 'ইচ্ছাধীনতা'কে মর্যাদা দিয়ে তার চরিত্রগত স্বভাবটিই লেখক কৌশলগতভাবে উপন্যাসে প্রকট করেছেন? অনুমান হয়, যেকোনো সিরিয়াস উপন্যাসকারই হয়তো ওই জায়গায় যোগেনের নিষ্ক্রমণ-অবধারিত করতেনই, তবে এতটা সুচারু দক্ষতায় তা হতো কি না সন্দেহ আছে। কারণ এখানে একটা সম্ভাবনা ছিল এই যে যোগেন ওখানে নিষ্ক্রান্ত না হলে ইতিহাস কথনটা হয়তো আক্ষরিক হতো তার অতঃপরটা নিয়ে, কিন্তু সে উপন্যাসের নায়ক না হয়ে খলনায়কেই পর্যবসিত হতো।
তখন উপমহাদেশীয় স্বাধীনতা-সংগ্রাম এবং জাতি গঠনের অন্তিম পর্ব প্রায়। স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধার অনেক আগে থেকেই একটা জাতি গঠনের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। হিন্দুরা নিজেদের সেই সাম্প্রদায়িক জাতীয়তার সর্বস্বত্বের অধিকারী মনে করে নিজেদের বড় ভাগ্যবান এবং বড় মনে করছিল। কিন্তু 'হিন্দু'_এই ধারণাটা আসলেই বড় গোলমেলে। সুতরাং প্রায় একই ভঙ্গিতে যখন মুসলমান সম্প্রদায়ও নিজেদের একটা 'জাতি' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল এবং অনেকটা এগিয়েও গেল, তখন নানা ক্ষুদ্র-বৃহৎ সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীরা সচেতন হয়ে উঠল, কে কার তাবে গিয়ে পড়বে। যোগেন এই সময়টায় কলকাতার নাগরিক-বৃত্তে। কিন্তু নাগরিক পরিমণ্ডলের যে দরজা দিয়েই সে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে, সেখানেই জাত হিসেবে তার অবস্থান একটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। সে চায় শূদ্র হিসেবেই তার আলাদা একটা আইডেনটিটি। কংগ্রেসের বৃহৎ ছাতার তলায় সে হিন্দু হিসেবে থাকতে চায় না। অস্পৃশ্যতার অভিশপ্ততা তাকে তাড়া করে। হক সাহেবের সঙ্গে সে 'চোর-পুলিশ' খেলে বোধ হয় এ কারণে যে তিনি দল গড়ার-ভাঙার কাজে বড় খেয়াল-খুশিতে চলেন। মার্কসবাদ বিষয়ে অবহিত হয়েও কমিউনিস্ট আন্দোলনে সে কেন যায় না তা পরিষ্কার নয়। শূদ্র এবং অস্পৃশ্য কি মার্কসবাদীদেরও বামুন, কায়েত ও রদ্দি মনে করে? উপন্যাসকার সেখানে তদানীন্তন নেতাদের (বিশেষ করে কংগ্রেসের) বর্ণবাদী অবস্থানকে চূড়ান্তভাবেই দায়ী করেন এবং তা সঠিকও। কিন্তু একইভাবে মুসলিম জাতীয়তার মধ্যেও যোগেন পুরোপুরি ঢুকতে চায় না। কারণ উপন্যাসে উল্লেখ পরিষ্কারভাবে করা না হলেও আমরা জানি যে সেই জাতীয়তায় প্রবেশের জন্য ধর্মান্তরণ একটা আবশ্যিক শর্ত। মত ও পথ নির্বিশেষেই রাজনীতির ক্ষেত্রটা তো অবশ্যই একটা 'এনলাইটেনমেন্ট' ঋদ্ধ নাগরিক বৃত্তই। রাজনীতির স্বার্থে জাতপাতের উঁচু-নিচু অথবা শ্রেণীর বিষয়ে যা-ই বলা হোক না কেন, বৃত্তের বাইরের লোককে কি সহজে অভ্যন্তরে বসানো যায়? বড়জোর কোনো ব্যক্তিকে, যদি সে বুদ্ধিমান তথা শিক্ষিত হয়, তাকে দলীয় স্বার্থে অধিগ্রহণ করে নেওয়া চলে।
কিন্তু উপন্যাসে এই ব্যাপারগুলো যে সূক্ষ্মতায় পরিবেশিত হয়েছে, তাতে সাধারণ পাঠকের কাছে যোগেনের চরিত্রটা খুব পরিষ্কার হয় না। অর্থাৎ সাধারণভাবে আমরা বুঝতে বা চট করে ধরতে পারি না। প্রাদেশিক বা জাতীয় স্তরে যোগেনের স্টেটসম্যানশিপটা কী? তার কাছে প্রধানতম বিষয় ছিল নমঃশূদ্ররা। কিন্তু নমঃশূদ্ররা তো গোটা দেশের শিডিউল কাস্টের মধ্যে একটা গোষ্ঠী মাত্র। হয়তো মাপে বড়। এমনকি দেশের সব শিডিউল গোষ্ঠী মিলে যদি একটা নিজেদের দলও তারা করে। সেটা কি একটা অন্যতম জাতীয় দলের সৃষ্টি করতে পারবে? সুতরাং স্টেটসম্যানশিপটা যোগেনের কিভাবে লভ্য? শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার সামান্য ভাগ পেলেই কি সমস্যা মিটবে? রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে ওই সময় কি স্বাধীনতা একটা বড় বিষয় নয়? কিন্তু সে ভাবনায় যোগেন খুব ভাবিত নয়। তার চিন্তা সামাজিক অসম্মান নিরসনকল্পে তার সমাজে শিক্ষার বিস্তার। নচেৎ স্বাধীনতা তার সমাজের কাছে খুব অর্থবহ হয় না। কিন্তু শিক্ষাবিস্তারের সংস্কারমূলক কাজের সঙ্গে কি স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো বিরোধ আছে? এই প্রশ্নে নাগরিকবৃত্তের স্টেটসম্যানশিপের ধারণার সঙ্গে যোগেনের ধারণার ভিন্নতা আছে, যেটা নাগরিকবৃত্ত কখনোই বোঝার চেষ্টা করে না এবং বোঝাটা সহজও নয় বা উচিত কি না সেটাও বিতর্কের বিষয়। কারণ জাতি গঠন পর্বে অখণ্ড ভারতের সব জাতপাত, আদিবাসী, উপজাতি, শিডিউল, অ-শিডিউলজনদের ঐক্যবদ্ধতার অনুপস্থিতি।
যোগেন বিষয়ে আমার সব প্রশ্নের উত্তরই হয়তো গ্রন্থে কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু তার অনেকটাই অনুমাননির্ভরতায় বলছি। তাই পরিষ্কার হয়ে নিতে সাধ যায়। সুতরাং আর এক-আধটা প্রশ্ন করি, কিন্তু তার আগে গ্রন্থ থেকে একটু উদ্ধৃতি দিই_"একমাত্র যোগেন মণ্ডলই তো বলেছিল, 'আমি শিডিউলও না, হরিজনও না। বামুন যদি তার জন্ম পরিচয়ে বামুন হয়, আমিও আমার জন্ম পরিচয়ে চাঁড়াল। চাঁড়াল হিন্দু নয়, হিন্দুকে রক্ষা করাও তার দায়িত্ব নয়।' উপন্যাসের যোগেন যখন এ কথা বলে, তখন সেটা তার বেসিক প্রেমাইসে দাঁড়িয়েই বলে এবং সেই অনুসারে পরে সে পাকিস্তান মুসলিম লীগ, জিন্নাহ ইত্যাদিদের সমর্থনও করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তার এই কথাটা কতটা আন্তরিক বিশ্বাসের স্থান থেকে সে উচ্চারণ করে? চাঁড়াল যদি হিন্দু না হয় তবে তাকে মুসলমানই হতে হবে এমন কথা যোগেনও বলে না, হিন্দুরাও বলবে না। চাঁড়াল হিন্দু না হলে বা হিন্দু-মুসলমান উভয়ের থেকে সমদূরত্বে থেকে বৌদ্ধ, জৈন, ইসাই_যা খুশি হতে পারে, সে অধিকার তার আধুনিক সমাজে আছে, সামান্য কিছু বিপত্তি সত্ত্বেও। কিন্তু ভারতীয় সমাজে থেকে সে স্বতন্ত্রভাবে চাঁড়ালই থাকবে সেটা রাগ-অভিমানের কথা হতে পারে, বাস্তবে সম্ভব কি না ভাবার বিষয়। আমেদকারের মতো সে বৌদ্ধও যদি হয়, তাহলেও কি বর্ণভেদের প্রকোপ এড়ানো সম্ভব হবে? কারণ ইতিহাসগতভাবে আমরা জানি, বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায়ও ব্রাহ্মণ্য ধারার বাইরে কোনো সমাজ গঠন করেনি। করা সম্ভব হয়নি। গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতে যদিও সে একজন 'নির্লজ্জ' বর্ণভেদবিশ্বাসী হিন্দুকে প্রত্যক্ষ করে, কিন্তু তিনি 'স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নির্ভয় এক ভারতীয়'ও। সেখানে যোগেনের অহিন্দুত্ব ভারতীয়তার ছাতার তলায় পথ পায় না। তার ভিত খুঁজতে ডুব দিতে হবে ভারতীয় জনসমুদ্রের গভীরে বর্ণবাদহীন, জাতপাতহীন এবং বিশেষ করে শ্রেণীভেদহীন সমাজ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে। গান্ধী বিষয়টা বুঝেই তাকে এড়াবার জন্য 'অস্পৃশ্যতা'কে পাপ বলেও বর্ণভেদে বিশ্বাসকে জারি রেখে ভারতীয় জাতীয়তার একটা কাঠামো খাড়া করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসে যোগেনের স্থান না থাকলেও, তার বেসিক প্রেমাইস থেকে সরে গিয়ে হিন্দুত্বে আশ্রয় নেওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ আছে, অন্তত দলিল আকারে। তার বিখ্যাত পদত্যাগপত্র এবং হিন্দু পত্রিকার কলকাতা করেসপন্ডেন্ট মি. টি ভি বেঙ্কট রমনকে ঢাকায় বসে ১৯৫০ সালের ২৫ মে-র দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্যে 'হিন্দু' কথাটাই বারবার ঘুরে-ফিরে এসেছে এবং শিডিউলকাস্ট বা নমঃশূদ্র ইত্যাদিদের হিন্দু সমাজে অন্তর্ভুক্ত করেই, অন্তত বক্তব্যের স্পিরিট বিচার করলে তাই দাঁড়ায়। এমনকি সে এ রকম বাক্যও উচ্চারণ করেছে তার সাক্ষাৎকারে_"I have informed delhi that it is only a question of time before the last Hindu reaches India from east Bengal. you must be prepared to receive is and Rehabilitate us, and if necessary throw out enough Muslims to make room for us. if India is not prepared to do this, we shall appeal to the world, be come Buddhists, Christians but will not submit to slow process of Islamisation." এই বিষয়টা অবশ্য উপন্যাসের অন্তর্গত নয়। তথাপি যোগেন যেমন ইচ্ছাধীনভাবে উপন্যাসের প্রবেশ ও প্রস্থানের সিদ্ধান্ত নিজেই নেয়, আমিও খানিকটা সেভাবেই ইতিহাসে-উপন্যাসে যাতায়াত করেই যোগেনকে বুঝতে চাইছি।
এই মহীরুহসদৃশ আলেখ্যে তিনি যোগেনকে তদানীন্তন ঘাঘু রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যেভাবে তার ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্যে উপস্থাপন করেছেন, তা এককথায় অনবদ্য এবং যোগেনের প্রতি নিঃসন্দেহে এক ঐতিহাসিক সুবিচার। জাতীয় ইতিহাসে তাকে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হলেও, এই গ্রন্থ তাকে যে মর্যাদার আসনে স্থায়ী করল, তার মূল্য কিছুমাত্র সামান্য নয়। ঐতিহাসিক বিচারে যোগেন তার পন্থায় ভুল প্রমাণিত হতে পারে, কিন্তু সে যে তার সমাজের অভ্যুদয়ের বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল সে ব্যাপারটা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টাটা নিঃসন্দেহে বর্ণবাদী ইতিহাসকারদের একটা কুচক্রান্ত। এটা তথাকথিত উচ্চবর্ণীয় শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোকদের যে বজ্জাতিপনা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মুসলমান ইতিহাসকাররাও এই ব্যাপারটায় যে অনেকটাই বর্ণবাদী সে বিষয়েও প্রমাণাভাব দেখি না। ব্রাহ্মণ্য বর্ণবাদী কৌশলের সূক্ষ্ম কারুকার্য 'আপওয়ার্ড' মুসলমান নাগরিক বৃত্তকে কতটা প্রভাবিত করেছে সে গবেষণাটাও প্রয়োজন।
সব শেষে, গ্রন্থখানি বিষয়ে একটি বিরূপ সমালোচনা বিনয়ের সঙ্গেই রাখব। সেটি অবশ্যই বরিশালের ভূমিপুত্র হিসেবে। সে কারণে অগ্রজ লেখকের কাছে আগাম মার্জনা ভিক্ষে করে রাখছি। যোগেন, হক সাহেব ইত্যাদি এবং বেশ কিছু বরিশালিয়া চরিত্রের স্থানীয় ভাষা-সংলাপে আঞ্চলিকতার স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব অত্যন্ত শ্রুতিকটু। স্বতঃস্ফূর্ততা না থাকলে আঞ্চলিকতার ব্যবহারের সার্থকতা ফোটে না। উদাহরণ অনেকই আছে দেওয়ার মতো। কিন্তু রচনার পৃথুলতা বাড়িয়ে লাভ নেই। গ্রন্থখানিতে ব্যাপকভাবে বরিশালের আঞ্চলিক সংলাপ ব্যবহার হয়েছে, হয়েছে যশোরের সংলাপেরও ব্যবহার। যেমন রসিক লালের কথনে। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই স্বতঃস্ফূর্ততার অভাবে পাঠবিভ্রম অনিবার্য হয়েছে এবং আমি কুলীন বরিশালি হয়েও এবং খুলনা-যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় ওয়াকিবহাল হওয়া সত্ত্বেও পাঠকালে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনুমাননির্ভরতার আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি। সম্ভবত সে কারণেই আমার এমনও বোধ হয়েছে যে বইখানার নাম 'বরিশালের যোগেন মণ্ডল' হওয়া সত্ত্বেও এবং বরিশালের ইতিহাস ভূগোল, খাল-বিল, নদী-নালা তথা ব্যাপক চরিত্রের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, সেখানে যেন আত্মার দিক দিয়ে বরিশালটাই উপস্থিত কম। ভাষা-সংলাপের ব্যাপারটা আমার কাছে বোধ হয়েছে যেন পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তর বাংলা_দেশীয় বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণের মতো। তবে এ কথাও বলব যে এই সংলাপ-সংক্রান্ত আঙ্গিকচ্যুতি যদি শুধু আমার মতো বরিশাল্যা কাভিজিস্টদের মতো জন ছাড়া অন্য পাঠকদের কাছে আ@ি@@@ক বৈকল্য বলে মনে না হয়, তবে কোনো সমস্যা নেই। বরিশাল্যাদের অবশ্য পাঠ সমস্যা হবেই, কারণ তাদের ভাষা বিষয়ে অভ্যাসটা প্রায় ব্রিটিশধর্মী। তাদের গোমরটা যেমন 'ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাজ স্পিকিং অর দ্য কুইন স্পিক্স্' হিসেবে আদৃত অথবা অনাদৃত। বরিশালের ক্ষেত্রে অহংকারটা 'অ্যাজ দে স্পিক'। তবে অন্যান্য কাজিয়ার মতো ব্যাপারটা খুনোখুনি অবধি গড়াবে না, শুধু 'মারানি' উত্তর পদযুক্ত কিছু 'খামার' বর্ষিত হতে পারে। কিন্তু সেসবও তেমন চর্মপ্রদাহী গোত্রের হবে বলে মনে হয় না। লেখক নিরাপদে থাকতে পারেন।
এই বিরূপ সমালোচনাটির সঙ্গে যুক্ত করব মুদ্রণকর্মের কর্ণধারদের তথা প্রকাশকের অপরিসীম অশ্রদ্ধার পরাকাষ্ঠা। এ রকম মাৎস্যন্যায় পাল বংশ প্রতিষ্ঠাতা গোপাল দেবের প্রাক্কালে ছাড়া বড় একটা দেখা যায়নি। এখানেও উদাহরণ হাজির করব না। পাঠককুল নিঃসন্দেহ জ্ঞানী এবং সর্বংসহা। এ রকম একখানা বিপুল গবেষণাসমৃদ্ধ গ্রন্থকে এতটা অশ্রদ্ধার সঙ্গে প্রকাশ করা বিরল প্রতিভার পেশাদারিত্ব। গ্রন্থখানা যদি ইংরেজি ভাষায় রচিত হয়ে উপযুক্ত পেশাদারি দক্ষতাসম্পন্ন প্রকাশনা দ্বারা প্রকাশিত হতো, তার আবেদন হতো আন্তর্জাতিক এবং লেখককেও এ রকম একটা অশ্রদ্ধার ভাগী হতে হতো না। অবশ্য ব্যাপারটা এমন নয় যে বাংলা প্রকাশনার জগতে ইদানীং আন্তর্জাতিক মানের পুস্তক নির্মাণ হয় না। দেবেশ রায় মশায়ের মতো লেখকের সে ক্ষেত্রে প্রথম বর্ণে স্থান পাওয়া অবশ্য উচিত ছিল।
তত্ত্ব নিংড়ে কে কবে রসের খবর জেনেছে? উপরন্তু 'বরিশালের যোগেনমণ্ডল' উপন্যাস-সাহিত্য হিসেবে কতখানি রসোত্তীর্ণর্ সে বিচারে প্রবেশ করার সামর্থ্য আমার নেই। আমি আমার অনুভবটির কথাই শুধু বলতে পারি। চরিত্রায়ণের অসামান্য কুশলতায় যোগেনের তাবৎ অনুভূতিতে সর্বোপরি আমি স্পর্শিত। পর্যালোচক হিসেবে যদিও সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক হওয়াটাই আমার এ ক্ষেত্রে ধর্ম হতো, কিন্তু ব্যক্তিকভাবে তথাকথিত উচ্চবর্ণে জন্ম হওয়ায় যোগেনের প্রতি সামাজিক ব্যভিচারের জন্য নিজেকে দায়িক মনে না করে পারি না। যোগেনের রাজনৈতিক প্রস্থানের সঙ্গে সহমত না হলেও তার সামাজিক অবমাননার জন্য দেবেশীয় চপেটাঘাত যে অব্যর্থভাবেই আমার মতো পাঠকের জড়তা অপহরণ করে, সেখানেই এ উপন্যাসের সার্থক প্রতিষ্ঠা মনে হয়।
শুধু রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব বলে কথা নয়, একখানা উপন্যাসের পরিধি যে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে, তার সার্থক নিদর্শন এই দূরূহ এবং কষ্টসাধ্য মহাগ্রন্থ রচনা। কবি গান, আঞ্চলিক ভাষা-সংলাপ ইত্যাদি বিষয়ে কিছু বিরূপ সমালোচনা হতে পারে, তবে এ রকম একখানি যুগ-প্রয়োজনীয় মহাগ্রন্থের আলোচনায় সে প্রসঙ্গ অতি তুচ্ছ।http://www.kalerkantho.com/~dailykal/index.php?view=details&archiev=yes&arch_date=09-06-2011&feature=yes&type=gold&data=news&pub_no=540&cat_id=3&menu_id=81&news_type_id=1&index=1#.URJ0GB2-pA0
নির্বাচনের পর এই প্রথম মিডিয়ায় লাইভ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, সিপিআইএম-এর পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২৪ ঘণ্টার এডিটর ইনপুটঅঞ্জন বন্দ্যোপাধায়ের মুখোমুখি।
বাম শাসনের অবসানের পর কেটে গিয়েছে ২০ মাস। ২০১১-র ২০ মে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পর থেমে নেই রাজ্য রাজনীতিও। পরিবর্তনের ঘোষণা নিয়ে আসা জোট সরকার ভেঙে গিয়েছে। সঙ্গত্যাগ করেছেন সেই সময় সঙ্গে থাকা অনেকেই। চলছে রাজনৈতিক চাপান উতর। এইসব নিয়ে শানিত প্রশ্নের মুখোমুখি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরাতে চেষ্টা করছি।
আপনার মুখে কি দিনের শেষে হাসি ফুটল ২১শে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট না হওয়ায়?
হাসি বা দুঃখের ব্যাপার নয়। কংগ্রেস, বিজেপি সব ট্রেড ইউনিয়নগুলো ধর্মঘট ডেকেছিল। দাবি দাওয়াগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইমুহূর্তে যে প্রশ্নটা খুব বেশি করে উঠছে তা হল ঠিকা শ্রমিকদের প্রশ্ন। তাদের দাবিদাওয়া মানা হচ্ছে না। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের মনে হতে পারে 'রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি'র গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ভাষার প্রশ্নে গুরুত্ব না দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা যখন সরকার চালিয়েছি আমরা ট্রেড ইউনিয়নদের বলেছিলাম এ রাজ্যে একদিনের ধর্মঘট হোক। অন্যদিন শিল্প ধর্মঘট হোক। অন্য সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলুক। সেইভাবেই একদিন ধর্মঘট হবে।
ভাষা দিবস কি কোনও কারণ না অজুহাত?
এটা কি অজুহাত হতে পারে?
মানে একদিনের ধর্মঘটের অজুহাত দিয়ে...
এটা সর্বভারতীয় সিদ্ধান্ত। দিল্লিতে আমাদের লোকেরাও আছেন। আমরাও সিদ্ধান্তের শরিক। যখন ২১শে ফেব্রুয়ারি দিন এগিয়ে আসছে তখন দেখলাম মানুষ আমাদের ভুল ভাবতে পারেন।
- সারা দুনিয়ায় ধর্মঘট হয়। এ রাজ্যে একদিনের ধর্মঘট হোক এটাই চেয়েছিলাম।
- ভাষা দিবসকে বামপন্থীরা খুব গুরুত্ব দেয়।
- দলের মধ্যে মতপার্থক্য হতেই পারে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠর মতই মেনে নিতে হয়।
রাজ্য পিছনের দিকে হাঁটছে। রাজ্যে আতঙ্কের পরিবেশ আছে। কমিউনিস্টদের মধ্যেও পরিবর্তন হয়েছে
আমরা এসএমএস-এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন রাখতে বলেছিলাম। এসএমএসে আসা একটি প্রশ্ন বলছে, আপনি যে পথে উন্নয়নের লক্ষ্যে এগোচ্ছেন সেখানে আপনার পথের সঙ্গে আপনার দলের কট্টরপন্থী একটা অংশের বিরোধ আছে..
দলের মধ্যে মতপার্থক্য হতেই পারে। আমি রাজ্যে যখন সরকার পরিচালনা করেছি তখনও বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য হয়েছে। এরকম অবস্থায় দলের অধিকাংশ মানুষ যা বলেন সেই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়।
আপনার কি মনে হয় আপনি একজন সঠিক মানুষ যিনি ভুল পার্টিতে রয়েছেন?
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরাতে হবে। আমাদের দলের একটা ঐতিহাসিক অবস্থান রয়েছে। সেই অবস্থান দেখে আমাদের ভুলগুলো চিনতে হবে এবং শুধরোতে হবে। আমি এমন একটা পার্টিতে থাকতে পেরে গর্বিত। আমার পার্টির ঐতিহ্য, ইতিহাস সব কিছু আমাকে উত্সাহিত করে, ভাবায়।
ক্ষমতায় আসার আগে বামপন্থীদের নিয়ে যে ধারণা ছিল, সেটা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর আর নেই। কমিউনিস্ট মানেই যে কথাগুলো মানুষ ভাবতে সেই পাঞ্জাবি, ঝোলাব্যাগ। সেসব তো আর নেই!
দেখুন দুনিয়াটা পাল্টাচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিস্টদের মধ্যেও পরিবর্তন হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা আমরা মানুষের সঙ্গে সেদিনও ছিলাম, আজও আছি।
- আমাদের দলও ভুল করেছে। তবে যোগ বিয়োগ করে দেখছি আমার দল ঠিক পথেই আছে।
- রাজ্য পিছনের দিকে হাঁটছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন থমকে গেছে। রাজ্যে আতঙ্কের পরিবেশ রয়েছে।
- মুখ্যমন্ত্রীর কথায় অপরাধীরা সাহস পাচ্ছে।
এই সরকারের শিল্প নীতি দিশাহীন। বড় শিল্প ছাড়া আমরা এগোতে পারব না
তাহলে কমিউনিস্টরা কি সঠিক পথেই আছেন?
হ্যাঁ।
আর আমাদের রাজ্য?
আমাদের রাজ্য পশ্চাদগতিতে হাঁটছে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো বলছেন 'মানুষ ভাল আছেন। পিঠে পুলি খাচ্ছেন, উত্সব করছেন।
রাজ্যে আতঙ্কের পরিবেশ রয়েছে। গ্রাম শহরের মানুষ এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। এর জন্য দায়ী সরকারের মনোভাব আর অপরাধ ঘটার পর মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য। কিছু হয়নি, সাজানো ঘটনা এমন সব কথা বলে অপরাধীদের উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে। পুলিস কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এই তো বারাসতের ঘটনাগুলোর কথাই বলুন না। কী চলছে ওখানে? রোজ রোজ কিছু না কিছু ঘটছে। তার চেয়েও বড় কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছেন না কাল থেকে আর কোনও অপরাধ হবে না।
- শিল্প ছাড়া পথ নেই। কর্মসংস্থান তৈরি করতে হলে শিল্প চাই।
- তবে কৃষির ভূমিকার কথা অস্বীকার করছি না।
- আমাদের সামনে এখন অন্ধকার, দিশাহীন একটা সরকার চলছে।
কর্মসংস্থান সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। রাজ্যের ছেলেমেয়েরা এখন চিন্তিত। আমরা সেক্টর ফাইভে ৮০ হাজার কর্মসংস্থান করে দিয়েছিলাম
আপনি ক্ষমতায় থাকাকালীন তো বারাসতে অপরাধ হয়েছে। রাজীব দাসের ঘটনা তো আপনার আমলেরই ঘটনা।
কিন্তু সে সময় সরকারের ভুমিকার কথা ভেবে দেখুন। আমরা একবারও ঘটনাটা মিথ্যা বলে অপরাধকে প্রশয় দিইনি। পুলিসের কাছে দ্রুত রিপোর্ট চেয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
হ্যাঁ ঘটনার পরদিনই আপনি ছুটে গিয়েছিলেন।
তার চেয়েও বড় কথা পুলিস দ্রুত রিপোর্ট পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছিল। আর এখন হয় ঠিক উল্টো। মুখ্যমন্ত্রীই বলেন সাজানো ঘটনা। আর এতে অপরাধী, দুষ্কৃতিরা উত্সাহিত হয়।
কোনও মুখ্যমন্ত্রী কি চাইতে পারেন তার রাজ্যে সমাজবিরোধীরা মাথাচাড়া দিক?
সেটা ভেবেই তো অবাক হচ্ছি।
রাজ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় কোনটা
ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত। এখন ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে আতঙ্কিত। জানে চাকরি পেতে হলে এই রাজ্যে কিছু হবে না। সেই ব্যাঙ্গালোর ছুটতে হবে।
- কৃষিতে সফল হয়েছি। বিরোধীরাও অস্বীকার করতে পারবে না।
- ২০০৬এর পর থেকে গণ্ডগোলের সময়টাও অনেক টাকার বিনিয়োগ হয়েছে।
- শুধু কৃষির সাফল্য দিয়ে এগোতে পারব না। সেটা বুঝেই শিল্পে জোর দিয়েছেলাম।
আমাদের রাজ্যকে নিয়ে এখন হাসাহাসি হচ্ছে। শিল্পপতিমহলে আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করা হচ্ছে। সবাই এগোচ্ছে, এমনকী বিহার। শুধু আমরা পিছিয়ে পড়ছি
তাহলে বলছেন কিচ্ছু হচ্ছে না
আমরা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার রাজ্যে কিছু বিনিয়োগ হয়নি। শিল্পপতি মহলে আমাদের রাজ্যকে নিয়ে হাসিহাসি হচ্ছে। বাইরের রাজ্যে এখন আমার ঠাট্টার পাত্র হয়ে যাচ্ছি।
আপনাদের দল এই প্রশ্নটা তোলেন বলেই মুখ্যমন্ত্রী কর্মসংস্থান তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন?
দৈনিক ভিত্তিতে কিছু মানুষকে এটাই যদি চাকরি দেওয়ার পথ হয় তাহলে সর্বনাশ।
তার মনে আপনি মনে করেন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হলে শিল্প ছাড়া পথ নেই?
না। উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা কৃষির ভূমিকা কখনই অস্বীকার করতে পারি না। ক্ষমতা আসার প্রথম ১৫-২০ বছর আমরা শুধু কৃষির ওপর জোর দিয়েছি। ১৯৯০-৯২ সালে যখন শিল্প নীতির পরিবর্তন হল তখন আমাদের কাছে সুযোগ এল। সুযোগের পুরোপুরি সদব্যবহার করার জন্য আমাদের নীতি পাল্টানোর প্রয়োজন হল তখন। আমরা বিনিয়োগ আনতেও সফল হয়েছিলাম। ২০০৬ থেকে রাজ্যে সমস্য শুরু হল। তারপর ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ এই পাঁচ বছর কি রাজ্যে বিনিয়োগ আসেনি? ২০১০ সালে রাজ্যে ১০,০০০ হাজার কোটির বিনিয়োগ এসেছিল। কৃষির সাফল্য অক্ষুণ্ণ রেখেই আমাদের শিল্প আনতে হবে।
- বাংলায় দুটোই শিল্প রয়েছে। চারুশিল্প আর ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু নতুন সরকারের কাছে এই দুটোর কোনও পার্থক্য নেই।
- সেই কথা আমি যখন বলতে গেলাম উনি বলেছিলেন ওখানে শুধুই ওয়াইন শপ আর বিউটি পার্লার তৈরি হবে।
- গুজরাটে ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে তাই টাটার পরই ফোর্ড চলে এসেছে।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
এখন শিল্পের ক্ষেত্রে সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
এখন সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে দিশা অন্ধকার। কেন শিল্প চাই, কীভাবে চাই সেই সম্পর্কে কোনও ধারনা নেই। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, পলিটেকনিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প বললেই হয় না। রাজ্যে বড় শিল্প না হলে কখনই ছোট শিল্প হবে না। পেট্রোলিয়াম, অটোমোবাইলের মতো বড় শিল্প হলে তবেই ছোট শিল্প আসবে। আর একটা হল নলেজ ইন্ডাস্ট্রি। কৃষির সাফল্যতে আঘাত না দিয়েই সম্মতি আনতে হবে। জমির সঠিক দাম দিতে হবে ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মতি, জমির দাম ও পুনর্বাসন এই তিনটি জিনস একসঙ্গে নিয়েই দিশা ঠিক করতে হবে। বাংলায় দুটোই শিল্প রয়েছে। চারুশিল্প আর ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু নতুন সরকারের কাছে এই দুটোর কোনও পার্থক্য নেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বারংবার জমিনীতি ও শিল্পপ্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান আলাদা করে দিচ্ছেন...
উনি বলছেন কৃষকদের কাছে গিয়ে জমি কিনবেন। কিন্তু কীভাবে কিনবেন? ইন্ডাস্ট্রি করতে চান, কিন্তু কীভাবে জমি কিনবেন সেই বিষয়ে কোনও দিশা নেই। কেন ৪০০ একর দেওয়া যায় না, তা নিয়ে ধারনা নেই। সিঙ্গুরে টাটার সঙ্গে ৫৬টি অ্যান্সিলারি সংস্থা এসেছিল। যারা গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করবে। সেই কথা আমি যখন বলতে গেলাম উনি বলেছিলেন ওখানে শুধুই ওয়াইন শপ আর বিউটি পার্লার তৈরি হবে। কিন্তু এই ৫৬টি সংস্থা যে এসেছিল তারা থাকলে কিন্তু টাটার পরেও আরও অনেক সংস্থা আসত। গুজরাটে যেহেতু ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে তাই টাটার পরই ফোর্ড চলে এসেছে। আমার এ রাজ্যে শিল্পের জন্য ১০০০ একর জমি লাগলেই কৃষকের কাছে চলে যাব সেটা কখনই হয় না।।
- জমিনীতির কারণেই আমরা পরাজিত হয়েছি।
- সিঙ্গুর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি সতর্ক ভাবে কাজ করব।
- আমি বহুবার তৃণমূলকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দিইনি।
- সিঙ্গুরের রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে আমাদের পরাজয়।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
আপনার কি মনে হয় যেহেতু এই জমিনীতি প্রসঙ্গেই আগের সরকারের হাত পুড়েছে তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি অধিগ্রহণের ওপরই বারবার জোর দিচ্ছেন?
ঠিক। সেই কারণেই আমরা পরাজিত হয়েছি। সিঙ্গুর থেকে শুরু হয়ে এমন একটা রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করা হল যেখান থেকে আমাদের পরাজয় হল।
এই মুহূর্তে আপনি যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতেন তাহলে সবকিছু মাথায় রেখে রাজ্যে শিল্প আনতেন?
আমি সিঙ্গুরে আর যাব না। কারণ ওখানে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। কোর্ট, আন্দোলন সব মিলিয়ে। কিন্তু অবশ্যই শিল্প আনব। জাহাজ নির্মান শিল্প আমরাই এনেছিলাম। উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশে, গুজরাটে শিল্প হলে এখানে কেন হবে না। পেট্রোকেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমি আরও অনেক সতর্ক ভাবে কাজ করব। বড়জোড়া, রঘুনাথপুর, নৈহাটি, পানাগড়ে ৪০০০ একর জমি মানুষ স্বেচ্ছায় দিয়েছে।
এখন যদি ২০০৬ সালের ফিরে যান তাহলে কি সিঙ্গুর মডেল ছিঁড়ে ফেলে দেবেন?
না। আমি সতর্ক ভাবে কাজ করব। এখন সারা দেশে সঙ্কট। আমাদের দেশের জিডিপিও ৮ থেকে ৫-এ নেমে এসেছে। উড়িষ্যা, অন্ধ্র, গুজরাট এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলায় হবে না কেন। সিঙ্গুরে আমি ৮৫% শতাংশ কাজ করে ফেলেছিলাম। সিঙ্গুর কৃষি থেকে কী লাভ করছে? শিল্প হলে কতটা লাভ করত? সবটাই আমরা হিসেব করে এগিয়েছিলাম। এবারেও সেভাবেই সেগুলো মাথায় রেখেই কৃষি থেকে শিল্পে রূপান্তেরর পথে হাঁটব।
এখন সিঙ্গুরে যা পরিস্থিতি যে সিঙ্গুর কাঁদছে। আপনি কি বলবেন সিঙ্গুর কাঁদলে আপনার দায় নেই? অনেকেই মনে করেন আপনি তো শিল্প আনতে চেয়েছিলে। তাহলে সেই সেই আন্দোলনের পর আপনি কেন কঠোর হলেন না? মানুষের কল্যাণের খাতিরে কি আপনার কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিল না?
আমি শুনেছি। পুরোটার একটা ঘটনা পরম্পরা রয়েছে। আমি বহুবার তৃণমূলকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দিইনি। ডানকুনি থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছি। তারই ফলস্বরূপ কেন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না এই কারণে বিধানসভায় লন্ডভন্ড হয়ে গেল। হাতে সংবিধান নিয়ে বিধানসভায় লন্ডভন্ড চলল। এটা তো ইতিহাস। আমি ভেবেছিলাম সিঙ্গুরে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাজ করে ফেলেছি বাকিটা হয়ে যাবে। কিন্তু মাঝখানে নন্দীগ্রাম ঘটে গেল। আমরা পরিষ্কার বলেছিলাম জমি নেব না। তাও নন্দীগ্রাম ভয়ঙ্কর আকার নিল। মাওবাদীরা ছিল বলেই এত ভয়ঙ্কর আকার নিতে পেরেছিল। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে থাকল। আমি টাটাকে বললাম। উনি বলেছিলেন পরোয়া করেন না। কারখানা হলে ৪০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু শেষের দিকে বিক্ষোভ যখন আরও বড় আকার নিল তখন টাটা পাল্টি খেল। উনি আমাকে বললেন এই অবস্থায় থাকলে শিল্প সম্ভব নয়। আমি বললাম আপনাকে কথা দিয়েছি যখন কারখানা হবেই। কিন্তু টাটার সাহস ছিল না। হঠাত্ শারদীয়া উত্সবের আগে টাটা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিলেন। আমি শক্ত হাতে ওনাকে নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেম। কিন্তু উনি আমাকে বলেছিলেন আমি 'আনওয়ান্টেড গেস্ট', অবাঞ্ছিত অতিথি হিসেবে থাকতে চাই না।
আবার সেই অবস্থায় ফিরে যান তাহলে অবস্থান মঞ্চ হতে দেবেন?
যদি ভাবেন এইসব মামলা, কোর্ট কিছু নেই, তাহলে কারও সাধ্য নেই কিছু করার। কিছু আটকানোর। কারণ সাধারণ মানুষ এখন পরিস্থিতি বুঝে গেছেন।
০১৬-এ যদি আপনারা ফেরেন তাহলে...
২০১৬-র বিষয়ে আমি এখন কিছু বলতে চাই না।
এতদিন আপনি চুপ ছিলেন কেন?
দেখুন নির্বাচনে হারের পর হইহই করে রাস্তায় নেমে পড়ব এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। মানুষ এসব ভালভাবে নেয় না। আমার দল ঠিক সময়ই প্রতিবাদ শুরু করেছে। তাতে আমি সামিল হয়েছি।
যে যাদবপুরের জন্য জন্য এত পরিশ্রম করেছিলেন সেই কেন্দ্রেই ২০১১ বিধানসভা হারটাকে আপনাকে খুব দুঃখ দিয়েছিল?
দেখুন আমি নিজেকে নিয়ে এত কথা ভাবি না। আমি হারলাম কি জিতলাম সেটা বড় কথা নয়। গোটা রাজ্যে ফলাফলের প্রভাব যাদবপুরে পড়েছিল।
(এসএমএসে আসা প্রশ্নের ভিত্তিতে) ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে কি আপনি আবার যাদবপুর কেন্দ্র থেকে দাঁড়াবেন?
২০১৬ এখন অনেক দূর। এটা এখন কোনও অ্যাজেন্ডাই নয়।
নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনা থেকে ২১ জুলাই। সব ইস্যুতেই এখন আপনি নিশানায়। আপনাকে নাকি জেরা করা হবে। রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্র তো বলেই দিয়েছেন ২১ জুলাই আপনার নির্দেশে গুলি চলেছিল। এই কথাটা প্রমাণ না হলে নাকি উনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন।
ও মন্ত্রী না থাকলে কিছু এসে যায় না। এ সব কথার প্রতিক্রিয়া দেব না। নিশানার কথা বলছেন, ওটা তো স্বাভাবিক। আমাদের পার্টি কর্মীদের ওপর রাজ্যজুড়ে আক্রমণ চলছে, আর আমাদের মত শীর্ষ নেতৃত্বের নেতাদের নিশানা করা হচ্ছে। তা ছাড়া জেরা কে কাকে করবে? নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের আঁতাতটা নিয়ে আগে প্রকাশ্যে জানানো হোক। কী না হয়েছে ওখানে। রাস্তা কাটা হয়েছে, গাছ ফেলে দেওয়া হয়েছে, পুলিস কর্মীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, ওসিকে মারা হয়েছিল। নন্দীগ্রামে পুলিস তো জমি নিতে যায়নি, গিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। তবে গুলিটা না চললেই ভাল হত। কারা হিংসা করল সেটা আগে দেখা হোক।
- নির্বাচনে হারের পর হইহই করে রাস্তায় নেমে পড়ব এমনটা আমি বিশ্বাস করি না
- ২০১৬ এখন অনেক দূর। এখন আমাদের অনেক দায়িত্ব।
- পার্টিতে শুদ্ধিকরণের কাজ অনেকটা এগিয়েছে।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
শিল্প প্রসঙ্গ যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে আপনার মনে হয় না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়েনর বিষয়টা অনেক সমবেদনশীলভাবে দেখছেন?
মন্দির, মসজিদ, চার্চ চিরকাল ধর্মপ্রাণ মানুষদের দিয়ে চলেছে। উনি হঠাত্ ওখানে হাত দিতে গেলেন কেন? ইমামদের ভাতা দিচ্ছেন উনি। কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে। ভাতা দিয়ে হয় না। আমাদের সময় রাইটার্সে ১০০ জন চাকরি পেলে তারমধ্যে ১০ জন মুসলমান চাকরি পেতেন। উনি যা করছেন তাতে শুধু অর্ডার বাতিল হচ্ছে।
এগুলো কথার কথা বলছেন। কিন্তু সংখ্যালঘু বিষয়টা সংবেদনশীল। উত্তরপ্রদেশ, বিহারেও আমরা দেখেছি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সভায় পোশাকের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
এটা কোনও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় নয়। আমি কোনও একটা ধর্মের মানুষদের সঙ্গে এটা করছি মানে আমি অন্যান্য ধর্মের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছি। এটা এক ধরণের বিচ্যুতি। আমাদের রাজ্যে এটা আমরা চাই না।
এর মধ্যে কি কোনও বিপদের গন্ধ রয়েছে?
অবশ্যই রয়েছে। আপনি যা নন তা আপনি করছেন। আপনি নামাজ পড়তে জানেন না আপনি নামাজ পড়ছেন। আপনি মাথায় চাদর দিতে জানি না আমি দিচ্ছি। এটা এক ধরণের ভন্ডামি, কৃত্রিমতা।
বিজেপি আপনাদের চিরকালীন শত্রু। কিন্তু বিজেপির উত্থান, শক্তিবৃদ্ধি, কংগ্রেসের সঙ্গে মতভেদ ২০১৪-তে যাতে সেই শত্রু ক্ষমতায় না আসে তার জন্য কী এখন সময় এসেছে কংগ্রেসের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার?
সেই সময় এখন নয়। আগেও বলেছি কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের মতভেদ মৌলিক। বিজেপির উত্থানতো এই সেদিন হল মন্দির, মসজিদ ভেঙে। ২০০৪ সালে যখন মনমোহন সিং-অটল বিহারী বাজপেয়ীর মধ্যে বেছে নিতে হয়েছিল তখন আমরা কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছিলাম। কারণ কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য অর্থনীতিতে। বিজেপির সঙ্গে অর্থনীতির সঙ্গে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা।
- জমিনীতির কারণেই আমরা পরাজিত হয়েছি।
- সিঙ্গুর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি সতর্ক ভাবে কাজ করব।
- আমি বহুবার তৃণমূলকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দিইনি।
- সিঙ্গুরের রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে আমাদের পরাজয়।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
নতুন সরকারের বয়স হয়েছে। আপনাদেরই মধ্যে কিছু লোক বলছে যে আপনাদের দলে যেসব অশুদ্ধি ঢুকছিল, মানে বেনোজলের স্রোত যারা হুড় হুড় করে ওদিকে গিয়েছিল তারা বুঝতে পেরেছ এ সরকারে থেকে লাভ নেই। তারা আবার ফিরে আসছে। এতে কি আপনাদের শুদ্ধিকরণে কোথাও ব্যাঘাত ঘটছে?
শুদ্ধিকরণ সহজ পথে হবে না। এত বড় দল, আমাদের প্রতিটা জেলা, অঞ্চল সবকিছু ধরে ধরে এগোতে হবে। জেলা কমিটি, স্টেট কমিটি প্রতিটা কমিটিকে এই শুদ্ধিকরণের কাজ করতে হবে। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া।
আপনাকে ফেসবুকে একজন দর্শক প্রশ্ন পাঠিয়েছেন, যে আপনারা বলছেন শুদ্ধিকরণ চলছে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে এখনও আপনাদের দলে অনেক অসত্ মুখ দেখা যাচ্ছে। ফেসবুকে রাজা আপনাকে এই প্রশ্ন পাঠিয়েছেন।
সারা রাজ্যে অডিট চলছে। শুদ্ধিকরণের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। সবটা এখনও হয়নি। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। যেমন প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা কিছু নতুন নিয়ম এনেছি। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হবে তার গ্রহণযোগ্যতা। মানুষের কাছে তার ভাবমূর্তি কীরকম। যদি দেখা যায় প্রার্থী দারুন কাজ করেন কিন্তু তার গ্রহনযোগ্যতা নেই তাহলে তাকে প্রার্থী করা যাবে না। এগুলো করা হচ্ছে যাতে বেনোজল না থাকে। গ্রহণযোগ্যতা সবার প্রথম। বয়স, অন্যান্য বিষয় তার পর আসবে।
তাহলে কি বলছেন ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়?
এত বড় পার্টিতে কটাই বা এরকম লোক আছেন।
এই ব্যাপার নাগরিক সমাজে কিছু ক্ষোভ থাকলেও গ্রামে সেভাবে প্রভাব পড়েনি। গ্রামের মানুষ এখনও সেভাবে স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্য মুক্ত নয়।
শহর, গ্রাম, দাম্ভিকতা সব নিজের জায়গায় রয়েছে। গ্রাম পরিস্থিতিটা একটু জটিল। যেটা আমাদের খেয়ালে এসেছে যে যারা গ্রামের আসল ক্ষেতমজুর, গরীর কৃষক তাদের মধ্যে কিন্তু এই সমস্যটা নেই। এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে গঞ্জ এলাকায়। যেখানে মহাজনী ঋণ এই জাতীয় বিষয়গুলো ঢুকে পড়েছে। তাদের নিয়েই সমস্যা।
- জমিনীতির কারণেই আমরা পরাজিত হয়েছি।
- সিঙ্গুর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি সতর্ক ভাবে কাজ করব।
- আমি বহুবার তৃণমূলকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দিইনি।
- সিঙ্গুরের রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে আমাদের পরাজয়।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
অনেকেই বলেন, সিপিআইএম স্কুলের শ্রেষ্ঠ ছাত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়...
ভাল ছাত্র-ছাত্রীদের সবচেয়ে ভাল গুণ কী জানেন? অন্যের ভাল গুণগুলো অনুকরণ করাই ভাল ছাত্রীর লক্ষণ, খারাপ গুণগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। তিনি কি পেরেছেন আমাদের ভালগুণগুলো আয়ত্ত করতে। আমাদের দল যা করে গোটা দেশে উদাহরণ তৈরি করেছে সেটা থেকে শিখে রাজ্যকে উপরে নিয়ে যেতে পেরেছেন? এই যে ধান উত্পাদেন আমাদের রাজ্য সবার উপরে গিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, আর উনি একই জিনিসে রাজ্যকে পিছিয়ে দিচ্ছেন! মমতা যোগ্য ছাত্রী নন। আসলে উনি বাজে ছাত্রী।
এবার আপনাকে প্রশ্ন করবেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক দীব্যেন্দু পালিত।
দীব্যেন্দু পালিত- নতুন কিছু লিখছেন কি? নাকি রাজনৈতিক চাপে আর সময় পাচ্ছেন না।
আপনি ভাল থাকবেন। আসলে সত্যি এখন ক'দিন লিখতে পারিনি। ঠিকই বলেছেন রাজনৈতিক চাপ এত বেশি যে লেখালিখির সময় পাচ্ছি না। দু'টো জিনিস একসঙ্গে হয় না। আসলে চালাকি করে কোনও সত্ কাজ হয় না।
তাহলে আপনার লেখালেখি সম্পূর্ণ বন্ধ?
হ্যাঁ। তবে রাতে বই পড়ি। কিন্তু লিখতে পারছি না। আসলে ফাঁকি দিয়ে কোনও কাজ হয় না।
- মমতা যোগ্য ছাত্রী নন। আসলে উনি বাজে ছাত্রী।
- সিঙ্গুর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি সতর্ক ভাবে কাজ করব।
- আমি বহুবার তৃণমূলকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দিইনি।
- সিঙ্গুরের রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে আমাদের পরাজয়।
- জমিনীতির কারণেই আমরা পরাজিত হয়েছি।
- সিঙ্গুর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমি সতর্ক ভাবে কাজ করব।
- আমি বহুবার তৃণমূলকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দিইনি।
- সিঙ্গুরের রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করে আমাদের পরাজয়।
- মূল রাজনীতির ধারা ভেঙে 'আইডেন্টিটি পলিটিক্স' চলছে।
- এটা খুবই বিপজ্জনক।
- রাজনৈতিক দলগুলির দ্বায়। তারা পারফম করতে পারছে না।
- দলের ৩ লাখ সদস্যের মধ্যে কিছু মধ্য মেধার অবস্থান আছে
- তাদের চেতনার মান তুলে ধরতে হবে।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
এবার আপনাকে প্রশ্ন করবেন বিশিষ্ট লেখিকা নবনীতা দেবসেন
নবনীতা দেবসেন- এখন তো বইমেলা চলছে। মনে পড়ছে বইমেলায় সেই আগুন লাগার পরদিন আমরা সবাই মিলে রাস্তায় হেঁটেছিলাম তাতে আপনিও ছিলেন। আচ্ছা আপনি কি এবার বইমেলায় গেছেন?
না এখনও বইমেলা যায়নি। বইমেলায় আগুন লাগার ঘটনাটা সত্যিই ভয়ঙ্কর। আপনি ভাল থাকুন।
এবার আপনাকে প্রশ্ন করবেন আপনার বন্ধু অভিজিত্ মুখোপাধ্যায়?
অভিজিত্ মুখোপাধ্যায়-আচ্ছা যে স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলে, ৬০ দশকে যে স্বপ্নটার কথা খুব বলতে মানে সাম্যবাদ, সমাজকে বদলে ফেলা... এসব কি এতদিন রাজনীতি করার পর, ক্ষমতায় থাকার পর কিছুটা হলেও কি তুমি পারলে?
৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে আমরা যা করলাম, তার মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছি আমরা।
আপনারা যেহেতু রাজনীতির মানুষ তাই বন্ধুদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর বিষয় ছাড়া আলোচনা করেন না
(হেসে) না না, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে এখনও অনেক হালকা বিষয়ে নিয়ে হাসিঠাট্টা করি।
- আমরা ৩৪ বছরের দালিল তৈরি করছি
- জমি প্রশ্নে আমরা নতুন স্থানে পৌঁছেছি।
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
দার্জিলিং আমাদের রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এমন কথা তো মুখ্যমন্ত্রী বলছেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তো আপনাদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ট্যান্ড এক?
মিল আছে আবার পার্থক্যও আছে। সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে আমরা যখন চুক্তি করেছিলাম তখন কোথাও পৃথক রাজ্য গড়ার দাবি ছিল না। কিন্তু এখন তো এসব উঠছে। আসলে বিষয়টা হল সমস্যাটা না বুঝেই কাজ করা হচ্ছে। পাহাড় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে হবে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো বলছেন, পাহাড় হাসছে!
আমাদের সময়ে ১৫-২০ বছর তো মানুষ পাহাড়ে ঘুরতে গেছে। তখন তো কোনও সমস্যা ছিল না।
আপনি এখন বিরোধী দলে তাই সব ইস্যুতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বলবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার বলুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাল দিক কোনটা। মুখ্যমন্ত্রী কিছু তো ভাল করেছেন। আপনাকে একটা কিউ ধরিয়ে দিই। অনেকে বলেন উনি সততার প্রতীক। আপনি কী বলবেন?
আমি ভিন্নমত পোষণ করছি। মমতা সততার প্রতীক আমি মানি না।
কেন? তার কী কোনও কারণ রয়েছে?
আপনারা তদন্ত করুন। তাঁর পরিবারের কী অবস্থান ছিল, এখন কী অবস্থান হয়েছে। তার তদন্ত হোক। আমার মাপকাঠিতে ওনাকে সততার স্থানে ওনাকে রাখতে পারছি না। সেটা আজ আর গোপন নেই। সেটা ওঁর কাছের মানুষরাও জানেন।
এটা তো গুরুতর অভিযোগ। আপনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, পলিটব্যুরো সদস্য। এই অভিযোগটা তো মারাত্মক
মমতা সত্ হলে আমি খুশি হতাম।
মমতার সততা নিয়ে আপনি যে কথাগুলো বললেন সেটার বিষয়ে আরও পরিষ্কার করে বলবেন
আপনার তদন্ত করুন সব জানতে পারবেন
- গোর্খাল্যান্ড চুক্তি আর হিল কাউন্সিলের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
- ওদের গোর্খাল্যান্ডের দাবি এখনও রয়েছে
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
পঞ্চায়েত ভোটের জন্য আপনারা কতটা প্রস্তুত? আপনার নাকি প্রার্থীই খুঁজে পাচ্ছেন না।
সমস্যা আছে। বেশ কিছু জেলায় আমাদের দলের স্বাভাবিককাজ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। তবে মানুষ ওদের আসল রূপটা বুঝতে পারছে। সব দেখে আমাদের পাশে মানুষ ফিরে আসছে।
পঞ্চায়েত নির্বাচন কতটা কঠিন?
চিন্তার বিষয়, সাধারণ মানুষের রায় দিতে যেতে দেবে না। মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে মানুষকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এটাকেই সামাল দিতে হবে।
- পঞ্চায়েত নির্বাচনে পার্থী বাছাই কঠিন হবে
- তবে মানুষের মধ্যে সতস্ফুর্ত প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে
- সবার প্রতিক্রিয়াই আমরা খেয়াল করি
- রুশদির মতো লেখককে রাজ্যে আনার চেষ্টা করা উচিত ছিল
আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে।
সূর্যকান্ত মিশ্র কি দলের চমকপ্রদ আবিষ্কার?
কাজ করতে করতে পরিস্থিতি মানুষকে তৈরি করে।
নির্বাচনে দলের প্রধান মুখ কি আপনি?
প্রধান মুখ তো আপনারা ঠিক করবেন। কয়েকটা মুখ, কয়েকটি মাথা নিয়ে সবটা ঠিক করতে হয়।
আপনার দলের নেতৃত্বে তরুণ মুখের অভাব...
সেটা একটা সমস্যা। আমরা নতুন মুখ আনার চেষ্টা করছি। যাঁরা একটু কথা বলতে পারেন। আমরা বুঝতে পারছি। কিছু বাধা রয়েছে। দলীয় রীতি-প্রথা মেনে চটজলদি সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সেটা আমরা বুঝতে পারছি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায় সম্পর্কে রেটিং কী? আপনাকে যদি নম্বর দিতে বলা হয় তাহলে ১০-এ কত দেবেন?
আমি কিছু দিতে পারছি না।
তার মানে শূন্য দেবেন?
হুঁ, একেবারে শূন্য
- পঞ্চায়েত ভোটে মানুষকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হবে
- মানূষ ঘুরে দাঁড়ালে আমরা পরিবর্তন আনতে পারব
- রেটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আমি শূন্য ছাড়া কিছুই দিতে পারছি না http://zeenews.india.com/bengali/bdb/
ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রাক্তন |
পাঁচ বছর পর দেশ হাসবে আমাদের দেখে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যৎ নিয়ে শিল্প-বণিক মহলের যা উদ্বেগ, তারই প্রতিধ্বনি করলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর ভয়, শিল্পায়নের এই খরার জেরে পাঁচ বছর পরে রাজ্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। যা শুনে শাসক দলের পাল্টা প্রশ্ন, বুদ্ধবাবুরা ৩৪ বছরে রাজ্যকে কোথায় নামিয়েছিলেন! বিধানসভা ভোটে পরাজয়ের পরে এই প্রথম টিভি সাক্ষাৎকার দিলেন বুদ্ধবাবু। এবিপি আনন্দে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারেই প্রশ্ন তুললেন তৃণমূল সরকারের শিল্পনীতি নিয়ে। তাঁর কথায়, "এই সরকার কী করতে চায় সেটাই বুঝতে পারছি না। জমি নীতিও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই নীতিহীনতা, দিশাহীনতা আমার ভয় লাগছে। এ পার্টি জেতে, ও পার্টি হারে ঠিক আছে। কিন্তু পাঁচ বছর পরে পশ্চিমবঙ্গ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? কল-কারখানা নেই, বিদ্যুৎ নেই, রাস্তা নেই সারা দেশ আমাদের দেখে হাসবে।" বেসরকারি শিল্পের জন্য তাঁর সরকার যে এক ছটাকও জমি নেবে না, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পমহলের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের মতো ছোট জোতের রাজ্যে তাদের পক্ষে সরাসরি চাষির থেকে জমি কেনা অসম্ভব। সিপিএম-ও বরাবরই এই মতের শরিক। বুদ্ধবাবু বলেন, "সরকার কিছু না-করলে শিল্পপতিদের হয় জমি মাফিয়াদের কাছে যেতে হয়। না হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।" সুতরাং শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে সরকারের আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা উচিত জানিয়ে বুদ্ধবাবু বলেন, "ব্রিটিশ আমলের আইন পাল্টানো উচিত। সামগ্রিক উন্নতি করতে হলে নতুন আইন চাই, যেখানে সরকারের হাতে বেশি ক্ষমতা দেওয়া উচিত। তবে শুধু আইন দিয়েও এটা করা যায় না। মানুষকে বোঝাতে হবে। তাঁরা দামটা যেন ঠিক পান। এবং যতটা সম্ভব পুনর্বাসন। এই তিনটিকে রক্ষাকবচ নিয়ে সরকারের এগোনো উচিত।" |
কিন্তু সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাঁর দলও তো জমি অধিগ্রহণের বিরোধী। বুদ্ধবাবুর যুক্তি, অন্যান্য অনেক রাজ্যে শিল্পের নামে হাজার হাজার একর জমি নিয়ে আবাসন তৈরি হচ্ছে। সেটা মানা যায় না। "কিন্তু কোনও অবস্থাতেই জমি নেব না। ৫০ একর জমি নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প এসইজেড গড়তে চাইলে তা-ও দেব না। এটা কী করে চলতে পারে!" প্রশ্ন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর। তাঁর বক্তব্য, "দলে বেসরকারি শিল্প সম্পর্কে একটা মনোভাব আছে, সবটা তাদেরই করে নিতে হবে। আমার মনে হয়, সেটা সম্ভব নয়।" শিল্পায়নের স্লোগানে ভর করেই ২০০৬-এ সপ্তম বারের জন্য ক্ষমতায় বসেছিল বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু পরের পাঁচ বছরে সেই শিল্পায়ন করতে গিয়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা এবং তারই জেরে ২০১১ সালে ভরাডুবি। বুদ্ধবাবু অবশ্য এখনও মনে করেন, কিছু ভুলত্রুটি হলেও তাঁর শিল্পায়নের লক্ষ্য সঠিক ছিল। তিনি বলেন, "কৃষি ও কৃষকের উপর যে গুরুত্ব, তা আমাদের সরকার কখনওই ছোট করে দেখেনি। তবে আমরা ভাল করেই বুঝেছিলাম, শুধু কৃষির সাফল্য নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ এগোতে পারে না। এ জন্য দরকার বড়, উৎপাদন শিল্প, যার হাত ধরে মাঝারি ও ছোট শিল্প আসবে।" তাই সিঙ্গুরে ন্যানো কারখানা আর নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তৈরির পরিকল্পনা করেছিল তাঁর সরকার। কিন্তু শিল্পায়নের পথে হাঁটতে গিয়ে কোথাও কোথাও যে ভুল হয়েছিল, তা কবুল করেন বুদ্ধবাবু। তাঁর কথায়, "শিল্পায়নের দু'একটি ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল। নন্দীগ্রামে জমিতে হাত না দিলেও আমাদের বিরুদ্ধে প্রচার হয়ে গেল! আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিলই, বুঝিনি!" বিধানসভা ভোটে হার যে শিল্পায়নপন্থী নীতি থেকে তাঁকে সরিয়ে আনতে পারেনি, তা-ও এ দিন স্পষ্ট করে দেন তিনি। বলেন, "আমরা পরাজিত হলে, হয়েছি। তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি যে, জমি অধিগ্রহণে আরও সতর্ক হতে হবে।" তাঁর উপলব্ধি, "মানুষের মধ্যে যেন কোনও বিরোধ না থাকে। বিরোধমূলক অবস্থা নিয়ে শিল্প করা যায় না। এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। আমরা পরাজিত হলাম। একটা দল জিতল। কিন্তু শিল্পায়নের প্রশ্ন তো বাতিল হতে পারে না।" সিঙ্গুরে জোর করে জমি নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বুদ্ধবাবু বলেন, "সিঙ্গুরে ৮০ শতাংশ মানুষের সমর্থন আমরা নিশ্চয়ই পেয়েছিলাম। বলা হচ্ছে, গরিবের জমি নিয়ে বড়লোক শিল্পপতিদের দিচ্ছি। এটা ইস্যু নয়। ইস্যু হচ্ছে তার জন্য কত কর্মসংস্থান হবে!" প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর এই কথার তীব্র সমালোচনা করেছে তৃণমূল। মুকুল রায়ের কথায়, "ভারতের সঙ্গে গোটা বিশ্ব বাংলার তথ্যপ্রযুক্তি, পরিকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, শিল্প, স্বাস্থ্যে উন্নতির কথা স্বীকার করছে। বলছে, বাংলার সার্বিক ভাবে উন্নয়ন হচ্ছে।" এই সঙ্গেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর কটাক্ষ, "বুদ্ধবাবুদের মুখে সমালোচনা শোভা পায় না। ওদের এখন চুপ করে বসে থাকা দরকার।" http://www.anandabazar.com/6raj1.html |
No comments:
Post a Comment