দুর্নীতির বর্ণাশ্রম?
আনন্দবাজার – রবি, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩বেশির ভাগ দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি, তফসিলি জাতি এবং তফসিলি জনজাতির লোক'জয়পুর সাহিত্য উৎসবে সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর এই মন্তব্যে এই সব বর্গের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন, মর্মাহতও। তাঁদের মনে হয়েছে, আশিসবাবু তাঁদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে দুর্নীতির দায়ে দায়ী করেছেন। তিনি অবশ্য বলতে চেয়েছিলেন, একটা দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী সাম্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। কিন্তু তিনি কথাগুলো বলেছেন খুব অদ্ভুত ভাবে।
দুর্নীতি সম্বন্ধে আশিস নন্দীর ধারণায় বিভ্রান্তি আছে। দুর্নীতির দায়টা তিনি ব্যক্তি থেকে জাতিবর্গের (কাস্ট) ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। এবং ঘটনা হল, স্বাধীন ভারতেও উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকরাই তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে সব কিছু হস্তগত করেছেন। অন্য দিকে যে বর্গের মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন, স্বাধীনতার পরেও যাঁরা কিছুই পাননি, বিশেষত সরকারি কাঠামোয় কোনও গুরুত্বপূর্ণ জায়গাই পাননি, আশিসবাবু তাঁদেরই দুর্নীতিগ্রস্ত বলছেন! আমরা জানি, কারও গায়ে দুর্নীতির তকমা লাগলে তার জীবনটাই বরবাদ হয়ে যায়, সে যদি সত্যিই দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়, তবুও। এটা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনই সত্য জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও।
আশিস নন্দী শিক্ষাজগতের মানুষ, বিদ্বজ্জন হিসাবে সম্মানিত। তিনি একটি বিশেষ চিন্তাধারার শরিক। অনেকাংশে বাঙালি বিদ্যাজীবীদের নেতৃত্বে এই ধারার গবেষকরা 'জাতীয়তাবাদী' পণ্ডিতদের থেকে স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছেন এবং এক ভিন্ন ধরনের তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন। তাঁরা সর্বদাই দাবি করেন যে, তাঁদের অবস্থান নিম্নবর্ণের পক্ষে। কিন্তু অম্বেডকরের পথ থেকে তাঁরা সর্বদা দূরে থেকেছেন এবং এটা নিশ্চিত করেছেন যে, অন্তত বাংলার নাগরিক সমাজে যেন নীচের তলা থেকে, বিশেষ করে শূদ্র, নমঃশূদ্র এবং আদিবাসীদের মধ্যে থেকে এক জনও বিদ্বৎসভায় উঠে না আসেন। তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ক্ষমতাসীন ভদ্রলোক কমিউনিস্টদের থেকে নিজেদের আলাদা বলে জাহির করেছেন বটে, কিন্তু রাজ্যে পশ্চাৎপদ বর্গের মানুষের জন্য সংরক্ষণ যাতে কার্যকর না হয়, সেই চেষ্টায় তাঁরাও দশকের পর দশক শরিক থেকেছেন।
এখন আশিস নন্দী, বেশ হেয় করার সুরেই, বলছেন যে, বাংলা একশো বছর ধরে অনেকটা দুর্নীতিমুক্ত ছিল ও আছে, কারণ সেখানে এসসি, এসটি, ওবিসিরা সরকারি কাঠামোয় জায়গা পায়নি। তিনি এবং তাঁর মতো ভদ্রলোক পণ্ডিতরা যে রাজ্য থেকে এসেছেন সেখানে রাষ্ট্রশক্তির সদর দফতরের নাম 'রাইটার্স বিল্ডিং'। তথাকথিত সাবঅল্টার্নরা যাতে সেখানে ক্ষমতার অংশী হতে পারে, সে জন্য তাঁরা তাঁদের লেখালিখিতে কতটা সত্যিকারের চেষ্টা করেছেন? কমিউনিজম এবং সেকুলারিজমের ছদ্মবেশে জাতপাতের যে প্রতিপত্তি বাংলায় চলে, তা নিয়ে তাঁদের বিস্তর লেখা উচিত ছিল। এবং আশিস নন্দীর এই ভাবে বাঙালি বিদ্যাজীবীদের এ কথা বলার দরকার ছিল না যে, 'ওবিসি, এসসি, এসটি'রা সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত' আর বাঙালি ভদ্রলোকরা 'সবচেয়ে কম দুর্নীতিপরায়ণ', এবং ওবিসি, এসসি, এসটি'রা ক্ষমতার বলয়ে ঢুকলে সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্তদের সঙ্গে সবচেয়ে কম দুর্নীতিপরায়ণদের মিলনের সম্ভাবনা দেখা দিত। এটা কোদালকে কোদাল বলা নয়। এটা হল, কোদালকে কুকুর বলা।
নব্বইয়ের দশকে মণ্ডল আন্দোলনের পরে অম্বেডকর গোটা ভারতে বন্দিত হয়েছেন, কেবল পূর্ব ভারতে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ, অসম এবং ওড়িশা ছাড়া। পশ্চিমবঙ্গে এখনও উচ্চবর্ণ বাঙালি ভদ্রলোকের আধিপত্য। তাঁদের ভুবনে এখনও বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের জয়জয়কার। হ্যাঁ, গাঁধী এবং নেহরুকেও তাঁরা মান্য করেন। কিন্তু চিন্তানায়ক হিসাবে অম্বেডকর তাঁদের কাছে অচ্ছুত। অথচ তিনি যখন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন, তখন ক'জন বঙ্গসন্তান সেখানে পিএইচ ডি করেছেন, তা-ও আবার অর্থনীতিতে? অম্বেডকর তাঁর সময়ের বহু বাঙালি বিদ্বজ্জনের চেয়ে বড় পণ্ডিত ছিলেন, বাঙালি বিদ্যাজীবীরা তবু তাঁকে অচ্ছুত করে রাখলেন কেন? কী বাংলায়, কী ইংরেজিতে, কোনও ভাষাতেই বাঙালি তাঁকে নিয়ে চর্চা করল না; এবং পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি, এসসি, এসটি'রা ক্ষমতার বলয়ে ঢুকতে পারল না এই দুটি ঘটনার কি কোনও অন্তর্নিহিত সম্পর্ক নেই?
আর উচ্চবর্ণ 'সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত' কেন? সেটা কি এই কারণে যে, তাঁরা একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে বাস করেন, যে জগৎটা ওবিসি বা এসসি এসটি'দের জগতের সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রাচীন ভারতে যাঁরা খাদ্য উৎপাদন করতেন, তাঁদের শূদ্র বা চণ্ডাল বলা হত। যাঁরা উৎপন্ন পণ্য ভোগ করতেন, তাঁদের বলা হত ব্রাহ্মণ (ভূদেবতা)। কালক্রমে তাঁরা নানা নামে সম্মানিত হন। যেমন, বম্বে প্রদেশে ব্রাহ্মণদের উপাধি বা পদবি হল পণ্ডিত, দেশমুখ, সরদেশাই, দেশপাণ্ডে, ইত্যাদি। ব্রিটিশ আমলে শূদ্র এবং চণ্ডালদের অনেক অংশকে 'ক্রিমিনাল' অর্থাৎ স্বভাবত অপরাধপ্রবণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এখন আবার তাঁদের এক গোত্রে ফেলে 'সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত' আখ্যা দেওয়া হচ্ছে!
আশিস নন্দী একটা ভাল কাজ করেছেন। ভদ্রলোকের আলোচনাসভায় তিনি জাতপাতের প্রশ্নটাকে এনে দিয়েছেন। আর্থিক, সামাজিক এবং চেতনাগত দুর্নীতির ক্ষেত্রে কোন জাত বা সম্প্রদায়ের দায় কতখানি, সেই বিতর্কটা শুরু হয়েছে। অনেকে অবশ্য সেই বিতর্কে যেতে চাইছেন না, আশিসবাবুর বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে সেটা নিয়েই তাঁদের মাথাব্যথা। দলিত-বহুজন সমাজের বিদ্যাজীবীদের দায়িত্ব এই মামলার বিরোধিতা করা এবং জাতপাত ও দুর্নীতির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কে যোগ দেওয়া। আমরা যদি এই বিতর্কটা চালিয়ে যেতে পারি, অনেক জঞ্জাল বেরিয়ে আসবে।
হিন্দু সমাজের থাকবন্দি কাঠামোটা দানা বাঁধার পর থেকে এই বিষয়ে একটা সত্যিকারের বিতর্ক কখনও হয়নি। তার কারণ, বিদ্যাজীবীরা বরাবর এসেছেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য, এই তিন বর্গ থেকে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কিছু তারতম্য দেখা গেছে বটে, কিন্তু জাতপাতের সামগ্রিক ছবিটা মোটের ওপর একই। আমার 'পোস্ট-হিন্দু ইন্ডিয়া' বইতে আমি যাকে 'সামাজিক চোরাচালান' (সোশাল স্মাগ্লিং) বলেছি, সেই বাণিজ্য এবং নিয়ন্ত্রণের দ্বৈত কৌশলে কারা জাতীয় সম্পদকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছে? আজেবাজে মামলা করে আমাদের ঐতিহাসিক সমস্যাগুলির সমাধান করা যাবে না।
হায়দরাবাদে মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভার্সিটি'র সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব সোশাল এক্সক্লুশন
অ্যান্ড ইনক্লুসিভ পলিসি-র অধিকর্তা; 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু' এবং 'আনটাচেব্ল গড' গ্রন্থের লেখক।
আনন্দবাজার পত্রিকা
নির্বাচনের পর এই প্রথম মিডিয়ায় লাইভ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, সিপিআইএম-এর পলিট বুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ২৪ ঘণ্টার এডিটর ইনপুট অঞ্জন বন্দ্যোপাধায়ের মুখোমুখি।
বাম শাসনের অবসানের পর কেটে গিয়েছে ২০ মাস। ২০১১-র ২০ মে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পর রাজ্য রাজনীতিও থেমে নেই। পরিবর্তনের ঘোষণা নিয়ে আসা জোট সরকার ভেঙে গিয়েছে। সঙ্গত্যাগ করেছেন সেই সময় সঙ্গে থাকা অনেকেই। রাজনৈতিক চাপান উতর। শানিত প্রশ্নের মুখোমুখি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
২৪ ঘণ্টা- আপনার মুখে কি দিনের শেষে হাসি ফুটল ২১শে ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট না হওয়ায়?
বুদ্ধদেব- হাসি বা দুঃখের ব্যাপার নয়। কংগ্রেস, বিজেপি সব ট্রেড ইউনিয়নগুলো ডেকেছিল। দাবি দাওয়াগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এইমুহূর্তে যেই প্রশ্নটা খুব বেশি করে উঠছে তা হল ঠিকা শ্রমিকদের প্রশ্ন। তাদের দাবিদাওয়া মানা হচ্ছে না। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের মনে হতে পারে তাদের কাছে 'রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি'র গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ভাষার প্রশ্নে গুরুত্ব না দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা যখন সরকার চালিয়েছি আমরা ট্রেড ইউনিয়নদের বলেছিলাম এ রাজ্যে একদিনের ধর্মঘট হোক। অন্যদিন শিল্প ধর্মঘট হোক। অন্য সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলুক। সেইভাবেই একদিন ধর্মঘট হবে।
২৪ ঘণ্টা- ভাষা কি কোনও কারণ না অজুহাত?
বুদ্ধদেব- এটা কি অজুহাত হতে পারে?
২৪ ঘণ্টা- মানে একদিনের ধর্মঘটের অজুহাত দিয়ে...
বুদ্ধদেব- এটা সর্বভারতীয় সিদ্ধান্ত। দিল্লিতে আমাদের লোকেরাও আছে। আমরাও সিদ্ধান্তের শরিক। যখন ২১শে ফেব্রুয়ারি দিন এগিয়ে আসছে তখন দেখলাম মানুষ আমাদের ভুল ভাবতে পারে।
২৪ ঘণ্টা- আমরা এসএমএস-এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন রাখতে বলেছিলাম। এসএমএসে আসা একটি প্রশ্ন বলছে, আপনি যে পথে উন্নয়নের লক্ষ্যে এগোচ্ছেন সেখানে আপনার পথের সঙ্গে আপনার দলের কট্টরপন্থী একটা অংশের বিরোধ আছে..
বুদ্ধদেব- দলের মধ্যে মতপার্থক্য হতেই পারে। আমি রাজ্যে যখন সরকার পরিচালনা করেছি তখনও বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য হয়েছে। এরকম অবস্থায় দলের অধিকাংশ মানুষ যা বলেন সেই সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়।
২৪ ঘণ্টা- আপনার কি মনে হয় আপনি একজন সঠিক মানুষ যিনি ভুল পার্টিতে রয়েছেন?
বুদ্ধদেব- আমি সঠিক পার্টিতে রয়েছি। সেই দলের কিছু ভুল হয়েছে। যেই ভুলগুলো শুধরোতে হবে। আমাদের দলের একটা ঐতিহাসিক অবস্থান রয়েছে। সেই অবস্থান দেখে আমাদের ভুলগুলো চিনতে হবে এবং শুধরোতে হবে। আমি এমন একটা পার্টিতে থাকতে পেরে গর্বিত। আমার পার্টির ঐতিহ্য, ইতিহাস সব কিছু আমাকে উত্সাহিত করে, ভাবায়।
২৪ ঘণ্টা- ক্ষমতায় আসার আগে বামপন্থীদের নিয়ে যে ধারণা ছিল, সেটা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর আর নেই। কমিউনিস্ট মানেই যে কথাগুলো মানুষ ভাবতে সেই পাঞ্জাবি, ঝোলাব্যাগ। সেসব তো আর নেই!
বুদ্ধদেব- দেখুন দুনিয়াটা পাল্টাচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিস্টদের মধ্যেও পরিবর্তন হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা আমরা মানুষের সঙ্গে সেদিনও ছিলাম, আজও আছি।
২৪ ঘণ্টা- তাহলে কমিউনিস্টরা কি সঠিক পথেই আছেন?
বুদ্ধদেব- হ্যাঁ।
২৪ ঘণ্টা- আর আমাদের রাজ্য?
বুদ্ধদেব- আমাদের রাজ্য পশ্চাদগতিতে হাঁটছে।
২৪ ঘণ্টা- কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো বলছেন 'মানুষ ভাল আছেন। পিঠে পুলি খাচ্ছেন, উত্সব করছেন।'
বুদ্ধদেব- রাজ্যে আতঙ্কের পরিবেশ রয়েছে। গ্রাম শহরের মানুষ এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। এর জন্য দায়ী সরকারের মনোভাব আর অপরাধ ঘটার পর মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য। কিছু হয়নি, সাজানো ঘটনা এমন সব কথা বলে অপরাধীদের উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে। পুলিস কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এই তো বারাসতের ঘটনাগুলোর কথাই বলুন না। কী চলছে ওখানে? রোজ রোজ কিছু না কিছু ঘটছে। তার চেয়েও বড় কথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছেন না কাল থেকে আর কোনও অপরাধ হবে না।
২৪ ঘণ্টা- আপনি ক্ষমতায় থাকাকালীন তো বারাসতে অপরাধ হয়েছে। রাজীব দাসের ঘটনা তো আপনার আমলেরই ঘটনা।
বুদ্ধদেব- কিন্তু সে সময় সরকারের ভুমিকার কথা ভেবে দেখুন। আমরা একবারও ঘটনাটা মিথ্যা বলে অপরাধকে প্রশয় দিইনি। পুলিসের কাছে দ্রুত রিপোর্ট চেয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
২৪ ঘণ্টা- হ্যাঁ ঘটনার পরদিনই আপনি ছুটে গিয়েছিলেন।
বুদ্ধদেব- তার চেয়েও বড় কথা পুলিস দ্রুত রিপোর্ট পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছিল। আর এখন হয় ঠিক উল্টো। মুখ্যমন্ত্রীই বলেন সাজানো ঘটনা। আর এতে অপরাধী, দুষ্কৃতিরা উত্সাহিত হয়।
২৪ ঘণ্টা- কোনও মুখ্যমন্ত্রী কি চাইতে পারেন তার রাজ্যে সমাজবিরোধীরা মাথাচাড়া দিক?
২৪ ঘণ্টা- সেটা ভেবেই তো অবাক হচ্ছি।
২৪ ঘণ্টা- মুখ্যমন্ত্রী তো বলছেন, ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে।
বুদ্ধদেব- আমরা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার রাজ্যে কিছু বিনিয়োগ হয়নি। শিল্পপতি মহলে আমাদের রাজ্যকে নিয়ে হাসিহাসি হচ্ছে। বাইরের রাজ্যে এখন আমার ঠাট্টার পাত্র হয়ে যাচ্ছি।
২৪ ঘণ্টা- আপনাদের দল এই প্রশ্নটা তোলেন বলেই মুখ্যমন্ত্রী কর্মসংস্থান তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন?
বুদ্ধদেব- দৈনিক ভিত্তিতে কিছু মানুষকে এটাই যদি চাকরি দেওয়ার পথ হয় তাহলে সর্বনাশ।
২৪ ঘণ্টা- তার মনে আপনি মনে করেন কর্মসংস্থান তৈরি করতে হলে শিল্প ছাড়া পথ নেই?
বুদ্ধদেব- না। উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা কৃষির ভূমিকা কখনই অস্বীকার করতে পারি না। ক্ষমতা আসার প্রথম ১৫-২০ বছর আমরা শুধু কৃষির ওপর জোর দিয়েছি। ১৯৯০-৯২ সালে যখন শিল্প নীতির পরিবর্তন হল তখন আমাদের কাছে সুযোগ এল। সুযোগের পুরোপুরি সদব্যবহার করার জন্য আমাদের নীতি পাল্টানোর প্রয়োজন হল তখন। আমরা বিনিয়োগ আনতেও সফল হয়েছিলাম। ২০০৬ থেকে রাজ্যে সমস্য শুরু হল। তারপর ২০০৬, ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯, ২০১০ এই পাঁচ বছর কি রাজ্যে বিনিয়োগ আসেনি? ২০১০ সালে রাজ্যে ১০,০০০ হাজার কোটির বিনিয়োগ এসেছিল। কৃষির সাফল্য অক্ষুণ্ণ রেখেই আমাদের শিল্প আনতে হবে।
২৪ ঘণ্টা- এখন শিল্পের ক্ষেত্রে সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
বুদ্ধদেব- এখন সবথেকে বড় সমস্যা হচ্ছে দিশা অন্ধকার। কেন শিল্প চাই, কীভাবে চাই সেই সম্পর্কে কোনও ধারনা নেই। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, পলিটেকনিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প বললেই হয় না। রাজ্যে বড় শিল্প না হলে কখনই ছোট শিল্প হবে না। পেট্রোলিয়াম, অটোমোবাইলের মতো বড় শিল্প হলে তবেই ছোট শিল্প আসবে। আর একটা হল নলেজ ইন্ডাস্ট্রি। কৃষির সাফল্যতে আঘাত না দিয়েই সম্মতি আনতে হবে। জমির সঠিক দাম দিতে হবে ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মতি, জমির দাম ও পুনর্বাসন এই তিনটি জিনস একসঙ্গে নিয়েই দিশা ঠিক করতে হবে। বাংলায় দুটোই শিল্প রয়েছে। চারুশিল্প আর ইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু নতুন সরকারের কাছে এই দুটোর কোনও পার্থক্য নেই।
২৪ ঘণ্টা- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বারংবার জমিনীতি ও শিল্পপ্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান আলাদা করে দিচ্ছেন...
বুদ্ধদেব- উনি বলছেন কৃষকদের কাছে গিয়ে জমি কিনবেন। কিন্তু কীভাবে কিনবেন? ইন্ডাস্ট্রি করতে চান, কিন্তু কীভাবে জমি কিনবেন সেই বিষয়ে কোনও দিশা নেই। কেন ৪০০ একর দেওয়া যায় না, তা নিয়ে ধারনা নেই। সিঙ্গুরে টাটার সঙ্গে ৫৬টি অ্যান্সিলারি সংস্থা এসেছিল। যারা গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি করবে। সেই কথা আমি যখন বলতে গেলাম উনি বলেছিলেন ওখানে শুধুই ওয়াইন শপ আর বিউটি পার্লার তৈরি হবে। কিন্তু এই ৫৬টি সংস্থা যে এসেছিল তারা থাকলে কিন্তু টাটার পরেও আরও অনেক সংস্থা আসত। গুজরাটে যেহেতু ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে তাই টাটার পরই ফোর্ড চলে এসেছে। আমার এ রাজ্যে শিল্পের জন্য ১০০০ একর জমি লাগলেই কৃষকের কাছে চলে যাব সেটা কখনই হয় না।
২৪ ঘণ্টা- আপনার কি মনে হয় যেহেতু এই জমিনীতি প্রসঙ্গেই আগের সরকারের হাত পুড়েছে তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি অধিগ্রহণের ওপরই বারবার জোর দিচ্ছেন?
বুদ্ধদেব- ঠিক। সেই কারণেই আমরা পরাজিত হয়েছি। সিঙ্গুর থেকে শুরু হয়ে এমন একটা রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি করা হল যেখান থেকে আমাদের পরাজয় হল।
২৪ ঘণ্টা- এই মুহূর্তে আপনি যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হতেন তাহলে সবকিছু মাথায় রেখে রাজ্যে শিল্প আনতেন?
বুদ্ধদেব- আমি সিঙ্গুরে আর যাব না। কারণ ওখানে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে। কোর্ট, আন্দোলন সব মিলিয়ে। কিন্তু অবশ্যই শিল্প আনব। জাহাজ নির্মান শিল্প আমরাই এনেছিলাম। উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশে, গুজরাটে শিল্প হলে এখানে কেন হবে না। পেট্রোকেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমি আরও অনেক সতর্ক ভাবে কাজ করব। বড়জোড়া, রঘুনাথপুর, নৈহাটি, পানাগড়ে ৪০০০ একর জমি মানুষ স্বেচ্ছায় দিয়েছে।
২৪ ঘণ্টা- এখন যদি ২০০৬ সালের ফিরে যান তাহলে কি সিঙ্গুর মডেল ছিঁড়ে ফেলে দেবেন?
বুদ্ধদেব- না। আমি সতর্ক ভাবে কাজ করব। এখন সারা দেশে সঙ্কট। আমাদের দেশের জিডিপিও ৮ থেকে ৫-এ নেমে এসেছে। উড়িষ্যা, অন্ধ্র, গুজরাট এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলায় হবে না কেন। সিঙ্গুরে আমি ৮৫% শতাংশ কাজ করে ফেলেছিলাম। সিঙ্গুর কৃষি থেকে কী লাভ করছে? শিল্প হলে কতটা লাভ করত? সবটাই আমরা হিসেব করে এগিয়েছিলাম। এবারেও সেভাবেই সেগুলো মাথায় রেখেই কৃষি থেকে শিল্পে রূপান্তেরর পথে হাঁটব।
২৪ ঘণ্টা- এখন সিঙ্গুরে যা পরিস্থিতি যে সিঙ্গুর কাঁদছে। আপনি কি বলবেন সিঙ্গুর কাঁদলে আপনার দায় নেই? অনেকেই মনে করেন আপনি তো শিল্প আনতে চেয়েছিলে। তাহলে সেই সেই আন্দোলনের পর আপনি কেন কঠোর হলেন না? মানুষের কল্যাণের খাতিরে কি আপনার কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিল না?
বুদ্ধদেব- আমি শুনেছি। পুরোটার একটা ঘটনা পরম্পরা রয়েছে। আমি বহুবার তৃণমূলকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দিইনি। ডানকুনি থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছি। তারই ফলস্বরূপ কেন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না এই কারণে বিধানসভায় লন্ডভন্ড হয়ে গেল। হাতে সংবিধান নিয়ে বিধানসভায় লন্ডভন্ড চলল। এটা তো ইতিহাস। আমি ভেবেছিলাম সিঙ্গুরে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাজ করে ফেলেছি বাকিটা হয়ে যাবে। কিন্তু মাঝখানে নন্দীগ্রাম ঘটে গেল। আমরা পরিষ্কার বলেছিলাম জমি নেব না। তাও নন্দীগ্রাম ভয়ঙ্কর আকার নিল। মাওবাদীরা ছিল বলেই এত ভয়ঙ্কর আকার নিতে পেরেছিল। পরিস্থিতি আরও জটিল হতে থাকল। আমি টাটাকে বললাম। উনি বলেছিলেন পরোয়া করেন না। কারখানা হলে ৪০০০ থেকে ১০,০০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু শেষের দিকে বিক্ষোভ যখন আরও বড় আকার নিল তখন টাটা পাল্টি খেল। উনি আমাকে বললেন এই অবস্থায় থাকলে শিল্প সম্ভব নয়। আমি বললাম আপনাকে কথা দিয়েছি যখন কারখানা হবেই। কিন্তু টাটার সাহস ছিল না। হঠাত্ শারদীয়া উত্সবের আগে টাটা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিলেন। আমি শক্ত হাতে ওনাকে নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেম। কিন্তু উনি আমাকে বলেছিলেন আমি 'আনওয়ান্টেড গেস্ট', অবাঞ্ছিত অতিথি হিসেবে থাকতে চাই না।
২৪ ঘণ্টা- আবার সেই অবস্থায় ফিরে যান তাহলে অবস্থান মঞ্চ হতে দেবেন?
বুদ্ধদেব- যদি ভাবেন এইসব মামলা, কোর্ট কিছু নেই, তাহলে কারও সাধ্য নেই কিছু করার। কিছু আটকানোর। কারণ সাধারণ মানুষ এখন পরিস্থিতি বুঝে গেছেন।
২৪ ঘণ্টা- ২০১৬-এ যদি আপনারা ফেরেন তাহলে...
বুদ্ধদেব- ২০১৬-র বিষয়ে আমি এখন কিছু বলতে চাই না।
২৪ ঘণ্টা- এতদিন আপনি চুপ ছিলেন কেন?
বুদ্ধদেব- দেখুন নির্বাচনে হারের পর হইহই করে রাস্তায় নেমে পড়ব এমনটা আমি বিশ্বাস করি না। মানুষ এসব ভালভাবে নেয় না। আমার দল ঠিক সময়ই প্রতিবাদ শুরু করেছে। তাতে আমি সামিল হয়েছি।
২৪ ঘণ্টা- যে যাদবপুরের জন্য জন্য এত পরিশ্রম করেছিলেন সেই কেন্দ্রেই ২০১১ বিধানসভা হারটাকে আপনাকে খুব দুঃখ দিয়েছিল?
বুদ্ধদেব- দেখুন আমি নিজেকে নিয়ে এত কথা ভাবি না। আমি হারলাম কি জিতলাম সেটা বড় কথা নয়। গোটা রাজ্যে ফলাফলের প্রভাব যাদবপুরে পড়েছিল।
২৪ ঘণ্টা- (এসএমএসে আসা প্রশ্নের ভিত্তিতে) ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে কি আপনি আবার যাদবপুর কেন্দ্র থেকে দাঁড়াবেন?
বুদ্ধদেব- ২০১৬ এখন অনেক দূর। এটা এখন কোনও অ্যাজেন্ডাই নয়।
২৪ ঘণ্টা- নন্দীগ্রামে গুলি চালানোর ঘটনা থেকে ২১ জুলাই। সব ইস্যুতেই এখন আপনি নিশানায়। আপনাকে নাকি জেরা করা হবে। রাজ্যের মন্ত্রী মদন মিত্র তো বলেই দিয়েছেন ২১ জুলাই আপনার নির্দেশে গুলি চলেছিল। এই কথাটা প্রমাণ না হলে নাকি উনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবেন।
বুদ্ধদেব- ও মন্ত্রী না থাকলে কিছু এসে যায় না। এ সব কথার প্রতিক্রিয়া দেব না। নিশানার কথা বলছেন, ওটা তো স্বাভাবিক। আমাদের পার্টি কর্মীদের ওপর রাজ্যজুড়ে আক্রমণ চলছে, আর আমাদের মত শীর্ষ নেতৃত্বের নেতাদের নিশানা করা হচ্ছে। তা ছাড়া জেরা কে কাকে করবে? নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের আঁতাতটা নিয়ে আগে প্রকাশ্যে জানানো হোক। কী না হয়েছে ওখানে। রাস্তা কাটা হয়েছে, গাছ ফেলে দেওয়া হয়েছে, পুলিস কর্মীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে, ওসিকে মারা হয়েছিল। নন্দীগ্রামে পুলিস তো জমি নিতে যায়নি, গিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে। তবে গুলিটা না চললেই ভাল হত। কারা হিংসা করল সেটা আগে দেখা হোক।
২৪ ঘণ্টা- শিল্প প্রসঙ্গ যদি বাদ দেওয়া হয় তাহলে আপনার মনে হয় না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়েনর বিষয়টা অনেক সমবেদনশীলভাবে দেখছেন?
বুদ্ধদেব- মন্দির, মসজিদ, চার্চ চিরকাল ধর্মপ্রাণ মানুষদের দিয়ে চলেছে। উনি হঠাত্ ওখানে হাত দিতে গেলেন কেন? ইমামদের ভাতা দিচ্ছেন উনি। কর্মসংস্থানে জোর দিতে হবে। ভাতা দিয়ে হয় না। আমাদের সময় রাইটার্সে ১০০ জন চাকরি পেলে তারমধ্যে ১০ জন মুসলমান চাকরি পেতেন। উনি যা করছেন তাতে শুধু অর্ডার বাতিল হচ্ছে।
২৪ ঘণ্টা- এগুলো কথার কথা বলছেন। কিন্তু সংখ্যালঘু বিষয়টা সংবেদনশীল। উত্তরপ্রদেশ, বিহারেও আমরা দেখেছি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সভায় পোশাকের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।
বুদ্ধদেব- এটা কোনও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচয় নয়। আমি কোনও একটা ধর্মের মানুষদের সঙ্গে এটা করছি মানে আমি অন্যান্য ধর্মের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছি। এটা এক ধরণের বিচ্যুতি। আমাদের রাজ্যে এটা আমরা চাই না।
২৪ ঘণ্টা- এর মধ্যে কি কোনও বিপদের গন্ধ রয়েছে?
বুদ্ধদেব- অবশ্যই রয়েছে। আপনি যা নন তা আপনি করছেন। আপনি নামাজ পড়তে জানেন না আপনি নামাজ পড়ছেন। আপনি মাথায় চাদর দিতে জানি না আমি দিচ্ছি। এটা এক ধরণের ভন্ডামি, কৃত্রিমতা।
২৪ ঘণ্টা- বিজেপি আপনাদের চিরকালীন শত্রু। কিন্তু বিজেপির উত্থান, শক্তিবৃদ্ধি, কংগ্রেসের সঙ্গে মতভেদ ২০১৪-তে যাতে সেই শত্রু ক্ষমতায় না আসে তার জন্য কী এখন সময় এসেছে কংগ্রেসের সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার?
বুদ্ধদেব- সেই সময় এখন নয়। আগেও বলেছি কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের মতভেদ মৌলিক। বিজেপির উত্থানতো এই সেদিন হল মন্দির, মসজিদ ভেঙে। ২০০৪ সালে যখন মনমোহন সিং-অটল বিহারী বাজপেয়ীর মধ্যে বেছে নিতে হয়েছিল তখন আমরা কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছিলাম। কারণ কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের মতপার্থক্য অর্থনীতিতে। বিজেপির সঙ্গে অর্থনীতির সঙ্গে রয়েছে সাম্প্রদায়িকতা।
২৪ ঘণ্টা- নতুন সরকারের বয়স হয়েছে। আপনাদেরই মধ্যে কিছু লোক বলছে যে আপনাদের দলে যেসব অশুদ্ধি ঢুকছিল, মানে বেনোজলের স্রোত যারা হুড় হুড় করে ওদিকে গিয়েছিল তারা বুঝতে পেরেছ এ সরকারে থেকে লাভ নেই। তারা আবার ফিরে আসছে। এতে কি আপনাদের শুদ্ধিকরণে কোথাও ব্যাঘাত ঘটছে?
বুদ্ধদেব- শুদ্ধিকরণ সহজ পথে হবে না। এত বড় দল, আমাদের প্রতিটা জেলা, অঞ্চল সবকিছু ধরে ধরে এগোতে হবে। জেলা কমিটি, স্টেট কমিটি প্রতিটা কমিটিকে এই শুদ্ধিকরণের কাজ করতে হবে। এটা একটা জটিল প্রক্রিয়া।
২৪ ঘণ্টা- আপনাকে ফেসবুকে একজন দর্শক প্রশ্ন পাঠিয়েছেন, যে আপনারা বলছেন শুদ্ধিকরণ চলছে। কিন্তু বাস্তব এটাই যে এখনও আপনাদের দলে অনেক অসত্ মুখ দেখা যাচ্ছে। ফেসবুকে রাজা আপনাকে এই প্রশ্ন পাঠিয়েছেন।
বুদ্ধদেব- সারা রাজ্যে অডিট চলছে। শুদ্ধিকরণের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। সবটা এখনও হয়নি। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। যেমন প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা কিছু নতুন নিয়ম এনেছি। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হবে তার গ্রহণযোগ্যতা। মানুষের কাছে তার ভাবমূর্তি কীরকম। যদি দেখা যায় প্রার্থী দারুন কাজ করেন কিন্তু তার গ্রহনযোগ্যতা নেই তাহলে তাকে প্রার্থী করা যাবে না। এগুলো করা হচ্ছে যাতে বেনোজল না থাকে। গ্রহণযোগ্যতা সবার প্রথম। বয়স, অন্যান্য বিষয় তার পর আসবে।
২৪ ঘণ্টা- তাহলে কি বলছেন ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়?
বুদ্ধদেব- এত বড় পার্টিতে কটাই বা এরকম লোক আছেন।
২৪ ঘণ্টা- এই ব্যাপার নাগরিক সমাজে কিছু ক্ষোভ থাকলেও গ্রামে সেভাবে প্রভাব পড়েনি। গ্রামের মানুষ এখনও সেভাবে স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্য মুক্ত নয়।
বুদ্ধদেব- শহর, গ্রাম, দাম্ভিকতা সব নিজের জায়গায় রয়েছে। গ্রাম পরিস্থিতিটা একটু জটিল। যেটা আমাদের খেয়ালে এসেছে যে যারা গ্রামের আসল ক্ষেতমজুর, গরীর কৃষক তাদের মধ্যে কিন্তু এই সমস্যটা নেই। এই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে গঞ্জ এলাকায়। যেখানে মহাজনী ঋণ এই জাতীয় বিষয়গুলো ঢুকে পড়েছে। তাদের নিয়েই সমস্যা।
২৪ ঘণ্টা- অনেকেই বলেন, সিপিআইএম স্কুলের শ্রেষ্ঠ ছাত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়...
বুদ্ধদেব- ভাল ছাত্র-ছাত্রীদের সবচেয়ে ভাল গুণ কী জানেন? অন্যের ভাল গুণগুলো অনুকরণ করাই ভাল ছাত্রীর লক্ষণ, খারাপ গুণগুলো এড়িয়ে যেতে হয়। তিনি কি পেরেছেন আমাদের ভালগুণগুলো আয়ত্ত করতে। আমাদের দল যা করে গোটা দেশে উদাহরণ তৈরি করেছে সেটা থেকে শিখে রাজ্যকে উপরে নিয়ে যেতে পেরেছেন? এই যে ধান উত্পাদেন আমাদের রাজ্য সবার উপরে গিয়ে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে, আর উনি একই জিনিসে রাজ্যকে পিছিয়ে দিচ্ছেন! মমতা যোগ্য ছাত্রী নন। আসলে উনি বাজে ছাত্রী।
২৪ ঘণ্টা- এবার আপনাকে প্রশ্ন করবেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক দীব্যেন্দু পালিত।
দীব্যেন্দু পালিত- নতুন কিছু লিখছেন কি? নাকি রাজনৈতিক চাপে আর সময় পাচ্ছেন না।
বুদ্ধদেব- আপনি ভাল থাকবেন। আসলে সত্যি এখন ক'দিন লিখতে পারিনি। ঠিকই বলেছেন রাজনৈতিক চাপ এত বেশি যে লেখালিখির সময় পাচ্ছি না। দু'টো জিনিস একসঙ্গে হয় না। আসলে চালাকি করে কোনও সত্ কাজ হয় না।
২৪ ঘণ্টা- তাহলে আপনার লেখালেখি সম্পূর্ণ বন্ধ?
বুদ্ধদেব- হ্যাঁ। তবে রাতে বই পড়ি। কিন্তু লিখতে পারছি না। আসলে ফাঁকি দিয়ে কোনও কাজ হয় না।
২৪ ঘণ্টা- এবার আপনাকে প্রশ্ন করবেন বিশিষ্ট লেখিকা নবনীতা দেবসেন
নবনীতা দেবসেন- এখন তো বইমেলা চলছে। মনে পড়ছে বইমেলায় সেই আগুন লাগার পরদিন আমরা সবাই মিলে রাস্তায় হেঁটেছিলাম তাতে আপনিও ছিলেন। আচ্ছা আপনি কি এবার বইমেলায় গেছেন?
বুদ্ধদেব- না এখনও বইমেলা যায়নি। বইমেলায় আগুন লাগার ঘটনাটা সত্যিই ভয়ঙ্কর। আপনি ভাল থাকুন।
২৪ ঘণ্টা- এবার আপনাকে প্রশ্ন করবেন আপনার বন্ধু অভিজিত্ মুখোপাধ্যায়?
অভিজিত্ মুখোপাধ্যায়- আচ্ছা যে স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলে, ৬০ দশকে যে স্বপ্নটার কথা খুব বলতে মানে সাম্যবাদ, সমাজকে বদলে ফেলা... এসব কি এতদিন রাজনীতি করার পর, ক্ষমতায় থাকার পর কিছুটা হলেও কি তুমি পারলে?
বুদ্ধদেব- ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে আমরা যা করলাম, তার মূল্যায়ন করার চেষ্টা করছি আমরা।
২৪ ঘণ্টা- আপনারা যেহেতু রাজনীতির মানুষ তাই বন্ধুদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর বিষয় ছাড়া আলোচনা করেন না
বুদ্ধদেব- (হেসে) না না, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে এখনও অনেক হালকা বিষয়ে নিয়ে হাসিঠাট্টা করি।
২৪ ঘণ্টা- দার্জিলিং আমাদের রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এমন কথা তো মুখ্যমন্ত্রী বলছেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তো আপনাদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ট্যান্ড এক?
বুদ্ধদেব- মিল আছে আবার পার্থক্যও আছে। সুভাষ ঘিসিংয়ের সঙ্গে আমরা যখন চুক্তি করেছিলাম তখন কোথাও পৃথক রাজ্য গড়ার দাবি ছিল না। কিন্তু এখন তো এসব উঠছে। আসলে বিষয়টা হল সমস্যাটা না বুঝেই কাজ করা হচ্ছে। পাহাড় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে হবে।
২৪ ঘণ্টা- কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো বলছেন, পাহাড় হাসছে!
বুদ্ধদেব- আমাদের সময়ে ১৫-২০ বছর তো মানুষ পাহাড়ে ঘুরতে গেছে। তখন তো কোনও সমস্যা ছিল না।
২৪ ঘণ্টা- আপনি এখন বিরোধী দলে তাই সব ইস্যুতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বলবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার বলুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাল দিক কোনটা। মুখ্যমন্ত্রী কিছু তো ভাল করেছেন। আপনাকে একটা কিউ ধরিয়ে দিই। অনেকে বলেন উনি সততার প্রতীক। আপনি কী বলবেন?
বুদ্ধদেব- আমি ভিন্নমত পোষণ করছি। মমতা সততার প্রতীক আমি মানি না।
২৪ ঘণ্টা- কেন? তার কী কোনও কারণ রয়েছে?
বুদ্ধদেব- আপনারা তদন্ত করুন। তাঁর পরিবারের কী অবস্থান ছিল, এখন কী অবস্থান হয়েছে। তার তদন্ত হোক। আমার মাপকাঠিতে ওনাকে সততার স্থানে ওনাকে রাখতে পারছি না। সেটা আজ আর গোপন নেই। সেটা ওঁর কাছের মানুষরাও জানেন।
২৪ ঘণ্টা- এটা তো গুরুতর অভিযোগ। আপনি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, পলিটব্যুরো সদস্য। এই অভিযোগটা তো মারাত্মক
বুদ্ধদেব- মমতা সত্ হলে আমি খুশি হতাম।
২৮ ঘণ্টা- মমতার সততা নিয়ে আপনি যে কথাগুলো বললেন সেটার বিষয়ে আরও পরিষ্কার করে বলবেন
বুদ্ধদেব- আপনার তদন্ত করুন সব জানতে পারবেন
২৪ ঘণ্টা- পঞ্চায়েত ভোটের জন্য আপনারা কতটা প্রস্তুত? আপনার নাকি প্রার্থীই খুঁজে পাচ্ছেন না।
বুদ্ধদেব- সমস্যা আছে। বেশ কিছু জেলায় আমাদের দলের স্বাভাবিককাজ করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের ওপর আক্রমণ করা হচ্ছে। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। তবে মানুষ ওদের আসল রূপটা বুঝতে পারছে। সব দেখে আমাদের পাশে মানুষ ফিরে আসছে।
২৪ ঘণ্টা-- পঞ্চায়েত নির্বাচন কতটা কঠিন?
বুদ্ধদেব-- চিন্তার বিষয়, সাধারণ মানুষের রায় দিতে যেতে দেবে না। মানুষকে ভীতসন্ত্রস্ত করে মানুষকে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে এটাকেই সামাল দিতে হবে।
২৪ ঘণ্টা--সূর্যকান্ত মিশ্র কি দলের চমকপ্রদ আবিষ্কার?
বুদ্ধদেব--কাজ করতে করতে পরিস্থিতি মানুষকে তৈরি করে।
২৪ ঘণ্টা--নির্বাচনে দলের প্রধান মুখ কি আপনি?
বুদ্ধদেব- প্রধান মুখ তো আপনারা ঠিক করবেন। কয়েকটা মুখ, কয়েকটি মাথা নিয়ে সবটা ঠিক করতে হয়।
২৪ ঘণ্টা-- আপনার দলের নেতৃত্বে তরুণ মুখের অভাব...
বুদ্ধদেব-- সেটা একটা সমস্যা। আমরা নতুন মুখ আনার চেষ্টা করছি। যাঁরা একটু কথা বলতে পারেন। আমরা বুঝতে পারছি। কিছু বাধা রয়েছে। দলীয় রীতি-প্রথা মেনে চটজলদি সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সেটা আমরা বুঝতে পারছি।
২৪ ঘণ্টা- মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায় সম্পর্কে রেটিং কী? আপনাকে যদি নম্বর দিতে বলা হয় তাহলে ১০-এ কত দেবেন?
বুদ্ধদেব- আমি কিছু দিতে পারছি না।
২৪ ঘণ্টা- তার মানে শূন্য দেবেন?
বুদ্ধদেব- হুঁ, একেবারে শূন্য
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য Live: Part 1
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য Live: Part 2
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য Live: Part 3
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য Live: Part 4
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য Live: Part 5
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য Live: Part 6
অবস্থা ও ব্যবস্থা
আজ বাংলাদেশে উত্তেজনার অভাব নাই, সুতরাং উত্তেজনার ভার কাহাকেও লইতে হইবে না। উপদেশেরও যে বিশেষ প্রয়োজন আছে তাহা আমি মনে করি না। বসন্তকালের ঝড়ে যখন রাশি রাশি আমের বোল ঝরিয়া পড়ে তখন সে বোলগুলি কেবলই মাটি হয়, তাহা হইতে গাছ বাহির হইবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। তেমনি দেখা গেছে, সংসারে উপদেশের বোল অজস্র বৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু অনেক স্থলেই তাহা হইতে অঙ্কুর বাহির হয় না, সমস্ত মাটি হইতে থাকে।
তবু ইহা নিঃসন্দেহ যে, যখন বোল ঝরিতে আরম্ভ করে তখন বুঝিতে হইবে ফল ফলিবার সময় সুদূরে নাই। আমাদের দেশেও কিছুদিন হইতে বলা হইতেছিল যে, নিজের দেশের অভাবমোচন দেশের লোকের চেষ্টার দ্বারাই সম্ভবপর, দেশের লোকই দেশের চরম অবলম্বন, বিদেশী কদাচ নহে, ইত্যাদি। নানা মুখ হইতে এই-যে বোলগুলি ঝরিতে আরম্ভ হইয়াছিল তাহা উপস্থিতমত মাটি হইতেছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু ভূমিকে নিশ্চয়ই উর্বরা করিতেছিল এবং একটা সফলতার সময় যে আসিতেছে তাহারও সূচনা করিয়াছিল।
অবশেষে আজ বিধাতা তীব্র উত্তাপে একটি উপদেশ স্বয়ং পাকাইয়া তুলিয়াছেন। দেশ গতকল্য যে-সকল কথা কর্ণপাত করিবার যোগ্য বলিয়া বিবেচনা করে নাই আজ তাহা অতি অনায়াসেই চিরন্তন সত্যের ন্যায় গ্রহণ করিতেছে। নিজেরা যে এক হইতে হইবে, পরের দ্বারস্থ হইবার জন্য নহে, নিজেদের কাজ করিবার জন্য, এ কথা আজ আমরা একদিনেই অতি সহজেই যেন অনুভব করিতেছি-- বিধাতার বাণীকে অগ্রাহ্য করিবার জো নাই।
অতএব, আমার মুখে আজ উত্তেজনা ও উপদেশ অনাবশ্যক হইয়াছে-- ইতিহাসকে যিনি অমোঘ ইঙ্গিতের দ্বারা চালনা করেন তাঁহার অগ্নিময় তর্জনী আজ দেশের সকলের চক্ষের সম্মুখে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে।
এখন এই সময়টাকে বৃথা নষ্ট হইতে দিতে পারি না। কপালক্রমে অনেক ধোঁওয়ার পরে ভিজা কাঠ যদি ধরিয়া থাকে, তবে তাহা পুড়িয়া ছাই হওয়ার পূর্বে রান্না চড়াইতে হইবে; শুধু শুধু শূন্য চুলায় আগুনে খোঁচার উপর খোঁচা দিতে থাকিলে আমোদ হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে ছাই হওয়ার কালটাও নিকটে অগ্রসর হয় এবং অন্নের আশা সুদূরবর্তী হইতে থাকে। বঙ্গব্যবচ্ছেদের প্রস্তাবে যখন সমস্ত দেশের লোকের ভাবনাকে একসঙ্গে জাগাইয়া তুলিয়াছে তখন কেবলমাত্র সাময়িক উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত না হইয়া কতকগুলি গোড়াকার কথা স্পষ্টরূপে ভাবিয়া লইতে হইবে।
প্রথম কথা এই যে, আমরা স্বদেশের হিতসাধন সম্বন্ধে নিজের কাছে যে-সকল আশা করি না পরের কাছ হইতে সে-সকল আশা করিতেছিলাম। এমন অবস্থায় নিরাশ হওয়াই স্বাভাবিক এবং তাহাই মঙ্গলকর। নিরাশ হইবার মতো আঘাত বারবার পাইয়াছি, কিন্তু চেতনা হয় নাই। এবারে ঈশ্বরের প্রসাদে আর-একটা আঘাত পাইয়াছি, চেতনা হইয়াছে কি না তাহার প্রমাণ পরে পাওয়া যাইবে।
"আমাদিগকে তোমরা সম্মান দাও, তোমরা শক্তি দাও, তোমরা নিজের সমান অধিকার দাও'-- এই-যে সকল দাবি আমরা বিদেশী রাজার কাছে নিঃসংকোচে উপস্থিত করিয়াছি ইহার মূলে একটা বিশ্বাস আমাদের মনে ছিল। আমরা কেতাব পড়িয়া নিশ্চয় স্থির করিয়াছিলাম যে, মানুষমাত্রেরই অধিকার সমান এই সাম্যনীতি আমাদের রাজার জাতির।
কিন্তু সাম্যনীতি সেইখানেই খাটে যেখানে সাম্য আছে। যেখানে আমারও শক্তি আছে তোমার শক্তি সেখানে সাম্যনীতি অবলম্বন করে। য়ুরোপীয়ের প্রতি য়ুরোপীয়ের মনোহর সাম্যনীতি দেখিতে পাই; তাহা দেখিয়া আশান্বিত হইয়া উঠা অক্ষমের লুব্ধতামাত্র। অশক্তের প্রতি শক্ত যদি সাম্যনীতি অবলম্বন করে তবে সেই প্রশ্রয় কি অশক্তের পক্ষে কোনোমতে শ্রেয়স্কর হইতে পারে? সে প্রশ্রয় কি অশক্তের পক্ষে সম্মানকর? অতএব, সাম্যের দরবার করিবার পূর্বে সাম্যের চেষ্টা করাই মনুষ্যমাত্রের কর্তব্য। তাহার অন্যথা করা কাপুরুষতা।
ইহা আমরা স্পষ্ট দেখিয়াছি, যে-সকল জাতি ইংরেজের সঙ্গে বর্ণে ধর্মে প্রথায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তাহাদিগকে ইঁহারা নিজের পার্শ্বে স্বচ্ছন্দবিহারের স্থান দিয়াছেন এমন ইঁহাদের ইতিহাসে কোথাও নাই। এমন-কি, তাহারা ইঁহাদের সংঘর্ষে লোপ পাইয়াছে ও পাইতেছে এমন প্রমাণ যথেষ্ট আছে। একবার চিন্তা করিয়া দেখো, ভারতবর্ষের রাজাদের যখন স্বাধীন ক্ষমতা ছিল তখন তাঁহারা বিদেশের অপরিচিত লোকমণ্ডলীকে স্বরাজ্যে বসবাসের কিরূপ স্বচ্ছন্দ অধিকার দিয়াছিলেন-- তাহার প্রমাণ পার্শিজাতি। ইহারা গোহত্যা প্রভৃতি দুই-একটি বিষয়ে হিন্দুদের বিধিনিষেধ মানিয়া, নিজের ধর্ম সমাজ অক্ষুণ্ন রাখিয়া, নিজের স্বাতন্ত্র্য কোনো অংশে বিসর্জন না দিয়া, হিন্দুদের অতিথিরূপে প্রতিবেশিরূপে প্রভূত উন্নতি লাভ করিয়া আসিয়াছে, রাজা বা জনসমাজের হস্তে পরাজিত বলিয়া উৎপীড়ন সহ্য করে নাই। ইহার সহিত ইংরেজ উপনিবেশগুলির ব্যবহার তুলনা করিয়া দেখিলে পূর্বদেশের এবং পশ্চিমদেশের সাম্যবাদের প্রভেদটা আলোচনা করিবার সুযোগ হইবে।
সম্প্রতি দক্ষিণ-আফ্রিকায় বিলাতি উপনিবেশীদের একটি সভা বসিয়াছিল, তাহার বিবরণ হয়তো অনেকে স্টেট্স্ম্যান-পত্রে পড়িয়া থাকিবেন। তাঁহারা একবাক্যে সকলে স্থির করিয়াছেন যে, এশিয়ার লোকদিগকে তাঁহারা কোনোপ্রকারেই আশ্রয় দিবেন না। ব্যবসায় অথবা বাসের জন্য তাহাদিগকে ঘরভাড়া দেওয়া হইবে না, যদি কেহ দেয় তাহার প্রতি বিশেষরূপ অসন্তোষ প্রকাশ করিতে হইবে। বর্তমানে যে-সকল বাড়ি এশিয়ার লোকদিগকে ভাড়া দেওয়া হইয়াছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হইলেই তাহা ছাড়াইয়া লওয়া হইবে। যে-সকল হৌস ঐশিয়দিগকে কোনোপ্রকারে সাহায্য করে, খুচরা ব্যবসায়ী ও পাইকেরগণ যাহাতে তাহাদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে, তাহার চেষ্টা করিতে হইবে। যাহাতে এই নিয়মগুলি পালিত হয় এবং যাহাতে সভ্যগণ ঐশিয় দোকানদার বা মহাজনদের কাছ হইতে কিছু না কেনে বা তাহাদিগকে কোনোপ্রকার সাহায্য না করে, সেজন্য একটা টভফভরতশদন অড়ড়ষদভতঢ়ভষশবা চৌকিদার-দল বাঁধিতে হইবে। সভায় বক্তৃতাকালে একজন সভ্য প্রশ্ন করিয়াছিলেন যে, আমাদের শহরের মধ্যে ঐশিয় ব্যবসায়ীদিগকে যেমন করিয়া আড্ডা গাড়িতে দেওয়া হইয়াছে, এমন কি ইংলণ্ডের কোনো শহরে দেওয়া সম্ভব হইত? ইহার উত্তরে এক ব্যক্তি কহিল, না, সেখানে তাহাদিগকে "লিঞ্চ' করা হইত। শ্রোতাদের মধ্যে একজন বলিয়াছিল, এখানেও কুলিদিগকে "লিঞ্চ' করাই শ্রেয়।
এশিয়ার প্রতি য়ুরোপের মনোভাবের এই যে-সকল লক্ষণ দেখা যাইতেছে ইহা লইয়া আমরা যেন অবোধের মতো উত্তেজিত হইতে না থাকি। এগুলি স্তব্ধভাবে বিচার করিয়া দেখিবার বিষয়। যাহা স্বভাবতই ঘটিতেছে, যাহা বাস্তবিকই সত্য, তাহা লইয়া রাগারাগি করিয়া কোনো ফল দেখি না। কিন্তু তাহার সঙ্গে যদি ঘর করিতে হয় তবে প্রকৃত অবস্থাটা ভুল বুঝিলে কাজ চলিবে না। ইহা স্পষ্ট দেখা যায় যে, এশিয়াকে য়ুরোপ কেবলমাত্র পৃথক বলিয়া জ্ঞান করে না, তাহাকে হেয় বলিয়াই জানে।
এ সম্বন্ধে য়ুরোপের সঙ্গে আমাদের একটা প্রভেদ আছে। আমরা যাহাকে হেয় জ্ঞানও করি, নিজের গণ্ডির মধ্যে তাহার যে গৌরব আছে সেটুকু আমরা অস্বীকার করি না। সে তাহার নিজের মণ্ডলীতে স্বাধীন; তাহার ধর্ম, তাহার আচার, তাহার বিধিব্যবস্থার মধ্যে তাহার স্বতন্ত্র সার্থকতা আছে; আমার মণ্ডলী আমার পক্ষে যেমন তাহার মণ্ডলী তাহার পক্ষে ঠিক সেইরূপ-- এ কথা আমরা কখনো ভুলি না। এইজন্য যে-সকল জাতিকে আমরা অনার্য বলিয়া ঘৃণাও করি, নিজের শ্রেষ্ঠতার অভিমানে আমরা তাহাদিগকে বিলুপ্ত করিবার চেষ্টা করি না। এই কারণে আমাদের সমাজের মাঝখানেই হাড়ি ডোম চণ্ডাল স্বস্থানে আপন প্রাধান্য রক্ষা করিয়াই চিরদিন বজায় আছে।
পশুদিগকে আমরা নিকৃষ্ট জীব বলিয়াই জানি, কিন্তু তবু বলিয়াছি, আমরাও আছি, তাহারাও থাক; বলিয়াছি, প্রাণীহত্যা করিয়া আহার করাটা, "প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং, নিবৃত্তিস্তু মহাফলা'-- সেটা একটা প্রবৃত্তি, কিন্তু নিবৃত্তিটাই ভালো। য়ুরোপ বলে, জন্তুকে খাইবার অধিকার ঈশ্বর আমাদিগকে দান করিয়াছেন। য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতার অভিমান ইতরকে যে কেবল ঘৃণা করে তাহা নহে, তাহাকে নষ্ট করিবার বেলা ঈশ্বরকে নিজের দলভুক্ত করিতে কুণ্ঠিত হয় না।
য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতা নিজেকে জাহির করা এবং বজায় রাখাকেই চরম কর্তব্য বলিয়া জানে। অন্যকে রক্ষা করা যদি তাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ খাপ খাইয়া যায় তবেই অন্যের পক্ষে বাঁচোয়া, যে অংশে লেশমাত্র খাপ না খাইবে সে অংশে দয়ামায়া বাছবিচার নাই। হাতের কাছে ইহার যে দুই-একটা প্রমাণ আছে তাহারই উল্লেখ করিতেছি।
বাঙালি যে একদিন এমন জাহাজ তৈরি করিতে পারিত যাহা দেখিয়া ইংরেজ ঈর্ষা অনুভব করিয়াছে, আজ বাঙালির ছেলে তাহা স্বপ্নেও জানে না। ইংরেজ যে কেমন করিয়া এই জাহাজ-নির্মাণের বিদ্যা বিশেষ চেষ্টায় বাংলাদেশ হইতে বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছে তাহা শ্রীযুক্ত সখারাম গনেশ দেউস্কর মহাশয়ের "দেশের কথা' -নামক বইখানি পড়িলে সকলে জানিতে পারিবেন। একটা জাতিকে, যে-কোনো দিকেই হউক, একেবারে অক্ষম পঙ্গু করিয়া দিতে এই সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতাবাদী কোনো সংকোচ অনুভব করে নাই।
ইংরেজ আজ সমস্ত ভারতবর্ষকে বলপূর্বক নিরস্ত্র করিয়া দিয়াছে, অথচ ইহার নিদারুণতা তাহারা অন্তরের মধ্যে একবার অনুভব করে নাই। ভারতবর্ষ একটি ছোটো দেশ নহে, একটি মহাদেশবিশেষ। এই বৃহৎ দেশের সমস্ত অধিবাসীকে চিরদিনের জন্য পুরুষানুক্রমে অস্ত্রধারণে অনভ্যস্ত, আত্মরক্ষায় অসমর্থ করিয়া তোলা যে কতবড়ো অধর্ম, যাহারা এক কালে মৃত্যুভয়হীন বীরজাতি ছিল তাহাদিগকে সামান্য একটা হিংস্র পশুর নিকট শঙ্কিত নিরুপায় করিয়া রাখা যে কিরূপ বীভৎস অন্যায়, সে চিন্তা ইহাদিগকে কিছুমাত্র পীড়া দেয় না। এখানে ধর্মের দোহাই একেবারেই নিষ্ফল-- কারণ, জগতে অ্যাংলোস্যাক্সন জাতির মাহাত্ম্যকে বিস্তৃত ও সুরক্ষিত করাই ইহারা চরম ধর্ম জানে, সেজন্য ভারতবাসীকে যদি অস্ত্রত্যাগ করিয়া এই পৃথিবীতলে চিরদিনের মতো নির্জীব নিঃসহায় পৌরুষবিহীন হইতে হয় তবে সে পক্ষে তাহাদের কোনো দয়ামায়া নাই।
অ্যাংলোস্যাক্সন যে শক্তিকে সকলের চেয়ে পূজা করে, ভারতবর্ষ হইতে সেই শক্তিকে প্রত্যহ সে অপহরণ করিয়া এ দেশকে উত্তরোত্তর নিজের কাছে অধিকতর হেয় করিয়া তুলিতেছে, আমাদিগকে ভীরু বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে-- অথচ একবার চিন্তা করিয়া দেখে না, এই ভীরুতাকে জন্ম দিয়া তাহাদের দলবদ্ধ ভীরুতা পশ্চাতে দাঁড়াইয়া আছে।
অতএব অনেক দিন হইতে ইহা দেখা যাইতেছে যে, অ্যাংলোস্যাক্সন মহিমাকে সম্পূর্ণ নিরুপদ্রব করিবার পক্ষে দূরতম ব্যাঘাতটি যদি আমাদের দেশের পক্ষে মহত্তম দুর্মূল্য বস্তুও হয়, তবে তাহাকে দলিয়া সমভূমি করিয়া দিতে ইহারা বিচারমাত্র করে না।
এই সত্যটি ক্রমে ক্রমে ভিতরে ভিতরে আমাদের কাছেও স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে বলিয়াই আজ গবর্মেন্টের প্রত্যেক নড়াচড়ায় আমাদের হৃৎকম্প উপস্থিত হইতেছে, তাঁহারা মুখের কথায় যতই আশ্বাস দিতেছেন আমাদের সন্দেহ ততই বাড়িয়া উঠিতেছে।
কিন্তু আমাদের পক্ষে অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, আমাদের সন্দেহেরও অন্ত নাই, আমাদের নির্ভরেরও সীমা নাই। বিশ্বাসও করিব না, প্রার্থনাও করিব। যদি জিজ্ঞাসা করা যায় এমন করিয়া সময় নষ্ট করিতেছে কেন, তবে উত্তর পাইবে, এক দলের দয়া না যদি হয় তো আর-এক দলের দয়া হইতে পারে। প্রাতঃকালে যদি অনুগ্রহ না পাওয়া যায় তো, যথেষ্ট অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিলে সন্ধ্যাকালে অনুগ্রহ পাওয়া যাইতে পারে। রাজা তো আমাদের একটি নয়, এইজন্য বারবার সহস্রবার তাড়া খাইলেও আমাদের আশা কোনোক্রমেই মরিতে চায় না-- এমনি আমাদের মুশকিল হইয়াছে।
কথাটা ঠিক। আমাদের একজন রাজা নহে। পৃথিবীর ইতিহাসে ভারতবর্ষের ভাগ্যে একটা অপূর্ব ব্যাপার ঘটিয়াছে। একটি বিদেশী জাতি আমাদের উপরে রাজত্ব করিতেছে, একজন বিদেশী রাজা নহে। একটি দূরবর্তী সমগ্র জাতির কর্তৃত্বভার আমাদিগকে বহন করিতে হইতেছে। ভিক্ষাবৃত্তির পক্ষে এই অবস্থাটাই কি এত অনুকূল? প্রবাদ আছে যে, ভাগের মা গঙ্গা পায় না, ভাগের কুপোষ্যই কি মাছের মুড়া এবং দুধের সর পায়?
অবিশ্বাস করিবার একটা শক্তি মানুষের পক্ষে অবশ্যপ্রয়োজনীয়। ইহা কেবল একটা নেতিভাবক গুণ নহে, ইহা কর্তৃভাবক। মনুষ্যত্বকে রক্ষা করিতে হইলে এই অবিশ্বাসের ক্ষমতাকে নিজের শক্তির দ্বারা খাড়া করিয়া রাখিতে হয়। যিনি বিজ্ঞানচর্চায় প্রবৃত্ত তাঁহাকে অনেক জনশ্রুতি, অনেক প্রমাণহীন প্রচলিত ধারণাকে অবিশ্বাসের জোরে খেদাইয়া রাখিতে হয়, নহিলে তাঁহার বিজ্ঞান পণ্ড হইয়া যায়। যিনি কর্ম করিতে চান অবিশ্বাসের নিড়ানির দ্বারা তাঁহাকে কর্মক্ষেত্র নিষ্কণ্টক রাখিতে হয়। এই-যে অবিশ্বাস ইহা অন্যের উপরে অবজ্ঞা বা ঈর্ষাবশত নহে; নিজের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি, নিজের কর্তব্যসাধনার প্রতি সম্মানবশত।
আমাদের দেশে ইংরেজ-রাজনীতিতে অবিশ্বাস যে কিরূপ প্রবল সতর্কতার সঙ্গে কাজ করিতেছে এবং সেই অবিশ্বাস যে কিরূপ নির্মমভাবে আপনার লক্ষ্যসাধন করিতেছে তাহা পূর্বেই বলিয়াছি। উচ্চ ধর্মনীতির নহে, কিন্তু সাধারণ রাজনীতির দিক দিয়া দেখিলে এই কঠিন অটল অবিশ্বাসের জন্য ইংরেজকে দোষ দেওয়া যায় না। ঐক্যের যে কী শক্তি, কী মাহাত্ম্য, তাহা ইংরেজ আমাদের চেয়ে ভালো করিয়াই জানে। ইংরেজ জানে, ঐক্যের অনুভূতির মধ্যে কেবল একটা শক্তিমাত্র নহে, পরন্তু এমন একটা আনন্দ আছে যে, সেই অনুভূতির আবেগে মানুষ সমস্ত দুঃখ ও ক্ষতি তুচ্ছ করিয়া অসাধ্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়। ইংরেজ আমাদের চেয়ে ভালো করিয়াই জানে যে, ক্ষমতা-অনুভূতির স্ফূর্তি মানুষকে কিরূপ একটা প্রেরণা দান করে। উচ্চ অধিকার লাভ করিয়া রক্ষা করিতে পারিলে সেইখানেই তাহা আমাদিগকে থাকিতে দেয় না-- উচ্চতর অধিকারলাভের জন্য আমাদের সমস্ত প্রকৃতি উন্মুখ হইয়া উঠে। আমাদের শক্তি নাই, আমরা পারি না, এই মোহই সকলের চেয়ে ভয়ংকর মোহ। যে ব্যক্তি ক্ষমতাপ্রয়োগের অধিকার পায় নাই সে আপনার শক্তির স্বাদ জানে না; সে নিজেই নিজের পরম শত্রু। সে জানে যে আমি অক্ষম, এবং এইরূপ জানাই তাহার দারুণ দুর্বলতার কারণ। এরূপ অবস্থায় ইংরেজ যে আমাদের মধ্যে ঐক্যবন্ধনে পোলিটিকাল হিসাবে আনন্দবোধ করিবে না, আমাদের হাতে উচ্চ অধিকার দিয়া আমাদের ক্ষমতার অনুভূতিকে উত্তরোত্তর সবল করিয়া তুলিবার জন্য আগ্রহ অনুভব করিবে না, এ কথা বুঝিতে অধিক মননশক্তির প্রয়োজন হয় না। আমাদের দেশে যে-সকল পোলিটিকাল প্রার্থনাসভা স্থাপিত হইয়াছে তাহারা যদি ভিক্ষুকের রীতিতেই ভিক্ষা করিত তাহা হইলেও হয়তো মাঝে মাঝে দরখাস্ত মঞ্জুর হইত-- কিন্তু তাহারা গর্জন করিয়া ভিক্ষা করে, তাহারা দেশবিদেশের লোক একত্র করিয়া ভিক্ষা করে, তাহারা ভিক্ষাবৃত্তিকে একটা শক্তি করিয়া তুলিতে চেষ্টা করে, সুতরাং এই শক্তিকে প্রশ্রয় দিতে ইংরেজ রাজা সাহস করে না। ইহার প্রার্থনা পূরণ করিলেই ইহার শক্তির স্পর্ধাকে লালন করা হয়, এইজন্য ইংরেজ-রাজনীতি আড়ম্বরসহকারে ইহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া ইহার গর্বকে খর্ব করিয়া রাখিতে চায়। এমন অবস্থায় এই-সকল পোলিটিকাল সভা কৃতকার্যতার বল লাভ করিতে পারে না; একত্র হইবার যে শক্তি তাহা ক্ষণকালের জন্য পায় বটে, কিন্তু সেই শক্তিকে একটা যথার্থ সার্থকতার দিকে প্রয়োগ করিবার যে স্ফূর্তি তাহা পায় না। সুতরাং নিষ্ফল চেষ্টায় প্রবৃত্ত শক্তি, ডিম্ব হইতে অকালে জাত অরুণের মতো পঙ্গু হইয়াই থাকে-- সে কেবল রথেই জোড়া থাকিবার উমেদার হইয়া থাকে, তাহার নিজের উড়িবার কোনো উদ্যম থাকে না।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ভারতবর্ষের পলিটিক্সে অবিশ্বাসনীতি রাজার তরফে অত্যন্ত সুদৃঢ়, অথচ আমাদের তরফে তাহা একান্ত শিথিল। আমরা একই কালে অবিশ্বাস প্রকাশ করি, কিন্তু বিশ্বাসের বন্ধন ছেদন করি না। ইহাকেই বলে ওরিয়েন্টাল-- এইখানেই পাশ্চাত্যদের সঙ্গে আমাদের প্রভেদ। য়ুরোপ কায়মনবাক্যে অবিশ্বাস করিতে জানে-- আর, ষোলো-আনা অবিশ্বাসকে জাগাইয়া রাখিবার যে কঠিন শক্তি তাহা আমাদের নাই, আমরা ভুলিয়া নিশ্চিন্ত হইতে চাই, আমরা কোনোক্রমে বিশ্বাস করিতে পারিলে বাঁচি। যাহা অনাবশ্যক তাহাকেও রক্ষা করিবার,যাহা অশ্রদ্ধেয় তাহাকেও গ্রহণ করিবার, যাহা প্রতিকূল তাহাকেও অঙ্গীভূত করিবার জন্য আমরা চিরদিন প্রস্তুত হইয়া আছি।
য়ুরোপ যাহা-কিছু পাইয়াছে তাহা বিরোধ করিয়াই পাইয়াছে, আমাদের যাহা-কিছু সম্পত্তি তাহা বিশ্বাসের ধন। এখন বিরোধপরায়ণ জাতির সহিত বিশ্বাসপরায়ণ জাতির বোঝাপড়া মুশকিল হইয়াছে। স্বভাববিশ্বাসীকে শ্রদ্ধাই করে না।
যাহাই হউক, চিরন্তন প্রকৃতিবশত আমাদের ব্যবহারে যাহাই প্রকাশ পাউক, ইংরেজ রাজা স্বভাবতই যে আমাদের ঐক্যের সহায় নহেন, আমাদের ক্ষমতালাভের অনুকূল নহেন, এ কথা আমাদের মনকে অধিকার করিয়াছে। সেইজন্যই য়ুনিভার্সিটি-সংশোধন বঙ্গব্যবচ্ছেদ প্রভৃতি গবর্মেন্টের ব্যবস্থাগুলিকে আমাদের শক্তি খর্ব করিবার সংকল্প বলিয়া কল্পনা করিয়াছি।
এমনতরো সন্দিগ্ধ অবস্থার স্বাভাবিক গতি হওয়া উচিত-- আমাদের স্বদেশহিতকর সমস্ত চেষ্টাকে নিজের দিকে ফিরাইয়া আনা। আমাদের অবিশ্বাসের মধ্যে এইটুকুই আমাদের লাভের বিষয়। পরের নিকট আমাদের সমস্ত প্রত্যাশাকে বদ্ধ করিয়া রাখিলে কেবল যে ফল পাওয়া যায় না তাহা নহে, তাহাতে আমাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত আত্মশক্তির মাহাত্ম্য চিরদিনের জন্য নষ্ট হইয়া যায়। এইটেই আমাদিগকে বিশেষ করিয়া মনে রাখিতে হইবে। ইংরেজ আমাদের প্রার্থনাপূরণ করিবে না, অতএব আমরা তাহাদের কাছে যাইব না-- এ সুবুদ্ধিটা লজ্জাকর। বস্তুত এই কথাই আমাদের মনে রাখিতে হইবে, অধিকাংশ স্থলেই প্রার্থনাপূরণটাই আমাদের লোকসান। নিজের চেষ্টার দ্বারা যতটুকু ফল পাই তাহাতে ফলও পাওয়া যায়, শক্তিও পাওয়া যায়, সোনাও পাওয়া যায়, সঙ্গে সঙ্গে পরশপাথরও পাওয়া যায়। পরের দ্বার রুদ্ধ হইয়াছে বলিয়াই ভিক্ষাবৃত্তি হইতে যদি নিরস্ত হইতে হয়, পৌরুষবশত, মনুষ্যত্ববশত, নিজের প্রতি, নিজের অন্তর্যামী পুরুষের প্রতি সম্মানবশত যদি না হয়, তবে এই ভিক্ষাবৈরাগ্যের প্রতি আমি কোনো ভরসা রাখি না।
বস্তুত, ইংরেজের উপর রাগ করিয়া নিজের দেশের উপর হঠাৎ অত্যন্ত মনোযোগ দিতে আরম্ভ করা কেমন-- যেমন স্বামীর উপরে অভিমান করিয়া সবেগে বাপের বাড়ি যাওয়া। সে বেগের হ্রাস হইতে বেশিক্ষণ লাগে না, আবার দ্বিগুণ আগ্রহে সেই শ্বশুরবাড়িতেই ফিরিতে হয়। দেশের প্রতি আমাদের যে-সকল কর্তব্য আজ আমরা স্থির করিয়াছি সে যদি দেশের প্রতি প্রীতির উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয় তবেই তাহার গৌরব এবং স্থায়িত্ব, ইংরেজের প্রতি রাগের যদি তাহার নির্ভর হয় তবে তাহার উপরে ভরসা রাখা বড়ো কঠিন। ডাক্তার অসম্ভব ভিজিট বাড়াইয়াছে বলিয়া তাহার উপরে রাগ করিয়া যদি শরীর ভালো করিতে চেষ্টা করি তাহাতে ক্ষতি নাই, কিন্তু শরীরের প্রতি মমতা করিয়া যদি এ কাজে প্রবৃত্ত হই তবেই কাজটা যথার্থভাবে সম্পন্ন হইবার এবং উৎসাহ স্থায়ীভাবে রক্ষিত হইবার সম্ভাবনা থাকে।
তবে কিনা, যেমন ঘড়ির কল কোনো-একটা আকস্মিক বাধায় বন্ধ হইয়া থাকিলে তাহাকে প্রথমে একটা নাড়া দেওয়া যায়, তাহার পরেই সে আর দ্বিতীয় ঝাঁকানির অপেক্ষা না করিয়া নিজের দমেই নিজে চলিতে থাকে-- তেমনি স্বদেশের প্রতি কর্তব্যপরতাও হয়তো আমাদের সমাজে একটা বড়োরকমের ঝাঁকানির অপেক্ষায় ছিল-- হয়তো স্বদেশের প্রতি স্বভাবসিদ্ধ প্রীতি এই ঝাঁকানির পর হইতে নিজের আভ্যন্তরিক শক্তিতেই আবার কিছুকাল সহজে চলিতে থাকিবে। অতএব এই ঝাঁকানিটা যাহাতে আমাদের মনের উপরে বেশ রীতিমত লাগে সে পক্ষেও আমাদিগকে সচেষ্ট হইতে হইবে। যদি সাময়িক আন্দোলনের সাহায্যে আমাদের নিত্য জীবনীক্রিয়া সজাগ হইয়া উঠে তবে এই সুযোগটা ছাড়িয়া দেওয়া কিছু নয়।
এখন তবে কথা এই যে, আমাদের দেশে বঙ্গব্যবচ্ছেদের আক্ষেপে আমরা যথাসম্ভব বিলাতি জিনিস কেনা বন্ধ করিয়া দেশী জিনিস কিনিবার জন্য যে সংকল্প করিয়াছি সেই সংকল্পটিকে স্তব্ধভাবে, গভীরভাবে, স্থায়ী মঙ্গলের উপরে স্থাপিত করিতে হইবে। আমি আমাদের এই বর্তমান উদ্যোগটির সম্বন্ধে যদি আনন্দ অনুভব করি তবে তাহার কারণ এ নয় যে তাহাতে ইংরেজের ক্ষতি হইবে, তাহার কারণ সম্পূর্ণভাবে এও নহে যে তাহাতে আমাদের দেশী ব্যবসায়ীদের লাভ হইবে-- এ-সমস্ত লাভক্ষতি নানা বাহিরের অবস্থার উপরে নির্ভর করে-- সে-সমস্ত সূক্ষ্ণভাবে বিচার করিয়া দেখা আমার ক্ষমতায় নাই। আমি আমাদের অন্তরের লাভের দিকটা দেখিতেছি। আমি দেখিতেছি, আমরা যদি সর্বদা সচেষ্ট হইয়া দেশী জিনিস ব্যবহার করিতে প্রবৃত্ত হই, যে জিনিসটা দেশী নহে, তাহার ব্যবহারে বাধ্য হইতে হইলে যদি কষ্ট অনুভব করিতে থাকি, দেশী জিনিস ব্যবহারের গতিকে যদি কতকটা পরিমাণে আরাম ও আড়ম্বর হইতে বঞ্চিত হইতে হয়, যদি সেজন্য মাঝে মাঝে স্বদলের উপহাস ও নিন্দা সহ্য করিতে প্রস্তুত হই, তবে স্বদেশ আমাদের হৃদয়কে অধিকার করিতে পারিবে। এই উপলক্ষে আমাদের চিত্ত সর্বদা স্বদেশের অভিমুখ হইয়া থাকিবে। আমরা ত্যাগের দ্বারা দুঃখস্বীকারের দ্বারা আপন দেশকে যথার্থভাবে আপনার করিয়া লইব। আমাদের আরাম বিলাস আত্মসুখতৃপ্তি আমাদিগকে প্রত্যহ স্বদেশ হইতে দূরে লইয়া যাইতেছিল, প্রত্যহ আমাদিগকে পরবশ করিয়া লোকহিতব্রতের জন্য অক্ষম করিতেছিল-- আজ আমরা সকলে মিলিয়া যদি নিজের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় দেশের দিকে তাকাইয়া ঐশ্বর্যের আড়ম্বর ও আরামের অভ্যাস কিছু পরিমাণও পরিত্যাগ করিতে পারি, তবে সেই ত্যাগের ঐক্য দ্বারা আমরা পরস্পর নিকটবর্তী হইয়া দেশকে বলিষ্ঠ করিতে পারিব। দেশী জিনিস ব্যবহার করার ইহাই যথার্থ সার্থকতা-- ইহা দেশের পূজা, ইহা একটি মহান সংকল্পের নিকটে আত্মনিবেদন।
এইরূপে কোনো একটা কর্মের দ্বারা, কাঠিন্যের দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা আত্মনিবেদনের জন্য আমাদের অন্তঃকরণ নিশ্চয়ই অপেক্ষা করিয়া আছে-- আমরা কেবলমাত্র সভা ডাকিয়া, কথা কহিয়া, আবেদন করিয়া নিশ্চয়ই তৃপ্তিলাভ করি নাই। কখনো ভ্রমেও মনে করি নাই ইহার দ্বারাই আমাদের জীবন সার্থক হইতেছে। ইহার দ্বারা আমরা নিজের একটা শক্তি উপলব্ধি করিতে পারি নাই; ইহা আমাদের চিত্তকে, আমাদের পূজার ব্যগ্রতাকে, আমাদের সুখদুঃখনিরপেক্ষ ফলাফলবিচারবিহীন আত্মদানের ব্যাকুলতাকে দুর্নিবার বেগে বাহিরে আকর্ষণ করিয়া আনিতে পারে নাই। কি আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তির প্রকৃতিতে, কি জাতির প্রকৃতিতে, কোনো-একটি মহা-আহ্বানে আপনাকে নিঃশেষে বাহিরে নিবেদন করিবার জন্য প্রতীক্ষা অন্তরের অন্তরে বাস করিতেছে-- সেখানে আমাদের দৃষ্টি পড়ে বা না পড়ে তাহার নির্বাণহীন প্রদীপ জ্বলিতেছেই। যখন কোনো বৃহৎ আকর্ষণে আমরা আপনাদের আরামের, আপনাদের স্বার্থের গহ্বর ছাড়িয়া আপনাকে যেন আপনার বাহিরে প্রবলভাবে সমর্পণ করিতে পারি তখন আমাদের ভয় থাকে না, দ্বিধা থাকে না, তখনই আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত অদ্ভুত শক্তিকে উপলব্ধি করিতে পারি-- নিজেকে আর দীনহীন দুর্বল বলিয়া মনে হয় না। এইরূপে নিজের অন্তরের শক্তিকে এবং সেই শক্তির যোগে বৃহৎ বাহিরের শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করাই আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের এবং জাতিগত সত্তার একমাত্র চরিতার্থতা।
নিশ্চয় জানি, এই বিপুল সার্থকতার জন্য আমরা সকলেই অপেক্ষা করিয়া আছি। ইহারই অভাবে আমাদের সমস্ত দেশকে বিষাদে আচ্ছন্ন ও অবসাদে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছে। ইহারই অভাবে আমাদের মজ্জাগত দৌর্বল্য যায় না, আমাদের পরস্পরের মধ্যে অনৈক্য ঘোচে না, আমাদের আত্মাভিমানের চপলতা কিছুতেই দূর হয় না। ইহারই অভাবে আমরা দুঃখ বহন করিতে, বিলাস ত্যাগ করিতে, ক্ষতি স্বীকার করিতে অসম্মত। ইহারই অভাবে আমরা প্রাণটাকে ভয়মুগ্ধ শিশুর ধাত্রীর মতো একান্ত আগ্রহে আঁকড়িয়া ধরিয়া আছি, মৃত্যুকে নিঃশঙ্ক বীর্যের সহিত বরণ করিতে পারিতেছি না। যিনি আমাদের দেশের দেবতা, যিনি আমাদের পিতামহদের সহিত আমাদিগকে এক সূত্রে বাঁধিয়াছেন, যিনি আমাদের সন্তানের মধ্যে আমাদের সাধনাকে সিদ্ধিদান করিবার পথ মুক্ত করিতেছেন, যিনি আমাদের এই সূর্যালোকদীপ্ত নীলাকাশের নিম্নে যুগে যুগে সকলকে একত্র করিয়া এক বিশেষ বাণীর দ্বারা আমাদের সকলের চিত্তকে এক বিশেষ ভাবে উদ্বোধিত করিতেছেন, আমাদের চিরপরিচিত ছায়ালোকবিচিত্র অরণ্য-প্রান্তর-শস্যক্ষেত্র যাঁহার বিশেষ মূর্তিকে পুরুষানুক্রমে আমাদের চক্ষের সম্মুখে প্রকাশমান করিয়া রাখিয়াছে, আমাদের পুণ্যনদীসকল যাঁহার পাদোদকরূপে আমাদের গৃহের দ্বারে দ্বারে প্রবাহিত হইয়া যাইতেছে, যিনি জাতিনির্বিশেষে হিন্দু-মুসলমান-খ্রীস্টানকে এক মহাযজ্ঞে আহ্বান করিয়া পাশে পাশে বসাইয়া সকলেরই অন্নের থালায় স্বহস্তে পরিবেশন করিয়া আসিতেছেন, দেশের অন্তর্যামী সেই দেবতাকে, আমাদের সেই চিরন্তন অধিপতিকে এখনো আমরা সহজে প্রত্যক্ষ করিতে পারি নাই। যদি অকস্মাৎ কোনো বৃহৎ ঘটনায়, কোনো মহান আবেগের ঝড়ে পর্দা একবার একটু উড়িয়া যায় তবে এই দেবাধিষ্ঠিত দেশের মধ্যে হঠাৎ দেখিতে পাইব, আমরা কেহই স্বতন্ত্র নহি, বিচ্ছিন্ন নহি-- দেখিতে পাইব, যিনি যুগযুগান্তর হইতে আমাদিগকে এই সমুদ্রবিধৌত হিমাদ্রি-অধিরাজিত উদার দেশের মধ্যে এক ধনধান্য, এক সুখদুঃখ, এক বিরাট প্রকৃতির মাঝখানে রাখিয়া নিরন্তর এক করিয়া তুলিতেছেন, সেই দেশের দেবতা দুর্জেয়, তাঁহাকে কোনোদিন কেহই অধীন করে নাই, তিনি ইংরেজি স্কুলের ছাত্র নহেন, তিনি ইংরেজ রাজার প্রজা নহেন, আমাদের বহুতর দুর্গতি তাঁহাকে স্পর্শও করিতে পারে নাই, তিনি প্রবল, তিনি চিরজাগ্রত-- ইঁহার এই সহজমুক্ত স্বরূপ দেখিতে পাইলে তখনই আনন্দের প্রাচুর্যবেগে আমরা অনায়াসেই পূজা করিব, ত্যাগ করিব, আত্মসমর্পণ করিব, কোনো উপদেশের অপেক্ষা থাকিবে না। তখন দুর্গম পথকে পরিহার করিব না, তখন পরের প্রসাদকেই জাতীয় উন্নতিলাভের চরম সম্বল মনে করাকে পরিহাস করিব এবং অপমানের মূল্যে আশু ফললাভের উঞ্ছবৃত্তিকে অন্তরের সহিত অবজ্ঞা করিতে পারিব।
আজ একটি আকস্মিক ঘটনায় সমস্ত বাঙালিকে একই বেদনায় আঘাত করাতে আমরা যেন ক্ষণকালের জন্যও আমাদের এই স্বদেশের অন্তর্যামী দেবতার আভাস পাইয়াছি। সেইজন্য, যাহারা কোনোদিন চিন্তা করিত না তাহারা চিন্তা করিতেছে, যাহারা পরিহাস করিত তাহারা স্তব্ধ হইয়াছে, যাহারা কোনো মহান সংকল্পের দিকে তাকাইয়া কোনোরূপ ত্যাগস্বীকার করিতে জানিত না তাহারাও যেন কিছু অসুবিধা ভোগ করিবার জন্য উদ্যম অনুভব করিতেছে এবং যাহারা প্রত্যেক কথাতেই পরের দ্বারে ছুটিতে ব্যগ্র হইয়া উঠিত তাহারাও কিঞ্চিৎ দ্বিধার সহিত নিজের শক্তি সন্ধান করিতেছে।
একবার এই আশ্চর্য ব্যাপারটা ভালো করিয়া মনের মধ্যে অনুভব করিয়া দেখুন। ইতিপূর্বে রাজার কোনো অপ্রিয় ব্যবহারে বা কোনো অনভিমত আইনে আঘাত পাইয়া আমরা অনেকবার অনেক কলকৌশল, অনেক কোলাহল, অনেক সভা আহ্বান করিয়াছি; কিন্তু আমাদের অন্তঃকরণ বল পায় নাই, আমরা নিজের চেষ্টাকে নিজে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি নাই, এইজন্য সহস্র অত্যুক্তিদ্বারাও রাজার প্রত্যয় আকর্ষণ করিতে পারি নাই, দেশের ঔদাসীন্য দূর করিতে পারি নাই। আজ আসন্ন বঙ্গবিভাগের উদ্যোগ বাঙালির পক্ষে পরম শোকের কারণ হইলেও এই শোক আমাদিগকে নিরুপায় অবসাদে অভিভূত করে নাই। বস্তুত, বেদনার মধ্যে আমরা একটা আনন্দই অনুভব করিতেছি। আনন্দের কারণ, এই বেদনার মধ্যে আমরা নিজেকে অনুভব করিতেছি-- পরকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি না। আনন্দের কারণ, আমরা আভাস পাইয়াছি আমাদের নিজের একটা শক্তি আছে-- সেই শক্তির প্রভাবে আজ আমরা ত্যাগ করিবার, দুঃখ ভোগ করিবার পরম অধিকার লাভ করিয়াছি। আজ আমাদের বালকেরাও বলিতেছে, পরিত্যাগ করো বিদেশের বেশভূষা, বিদেশের বিলাস পরিহার করো-- সে কথা শুনিয়া বৃদ্ধেরাও তাহাদিগকে ভর্ৎসনা করিতেছে না, বিজ্ঞেরাও তাহাদিগকে পরিহাস করিতেছে না; এই কথা নিঃসঙ্কোচে বলিবার এবং এই কথা নিস্তব্ধ হইয়া শুনিবার বল আমরা কোথা হইতে পাইলাম? সুখেই হউক আর দুঃখেই হউক, সম্পদেই হউক আর বিপদেই হউক, হৃদয়ে হৃদয়ে যথার্থভাবে মিলন হইলেই যাঁহার আবির্ভাব আর মুহূর্তকাল গোপন থাকে না তিনি আমাদিগকে বিপদের দিনে এই বল দিয়াছেন, দুঃখের দিনে এই আনন্দ দিয়াছেন। আজ দুর্যোগের রাত্রে যে বিদ্যুতের আলোক চকিত হইতেছে সেই আলোকে যদি আমরা রাজপ্রাসাদের সচিবদেরই মুখমণ্ডল দেখিতে থাকিতাম, তবে আমাদের অন্তরের এই উদার উদ্যমটুকু কখনোই থাকিত না। এই আলোকে আমাদের দেবালয়ের দেবতাকে, আমাদের ঐক্যাধিষ্ঠাত্রী অভয়াকে দেখিতেছি-- সেইজন্যই আজ আমাদের উৎসাহ এমন সজীব হইয়া উঠিল। সম্পদের দিনে নহে, কিন্তু সংকটের দিনেই বাংলাদেশ আপন হৃদয়ের মধ্যে এই প্রাণ লাভ করিল। ইহাতেই বুঝিতে হইবে, ঈশ্বরের শক্তি যে কেবল সম্ভবের পথ দিয়াই কাজ করে তাহা নহে; ইহাতেই বুঝিতে হইবে, দুর্বলেরও বল আছে, দরিদ্রেরও সম্পদ আছে এবং দুর্ভাগ্যকেই সৌভাগ্য করিয়া তুলিতে পারেন যিনি সেই জাগ্রত পুরুষ কেবল আমাদের জাগরণের প্রতীক্ষায় নিস্তব্ধ আছেন। তাঁহার অনুশাসন এ নয় যে, গবর্মেন্ট তোমাদের মানচিত্রের মাঝখানে যে-একটা কৃত্রিম রেখা টানিয়া দিতেছেন তোমরা তাঁহাদিগকে বলিয়া কহিয়া, কাঁদিয়া কাটিয়া, বিলাতি জিনিস কেনা রহিত করিয়া, বিলাতে টেলিগ্রাম ও দূত পাঠাইয়া, তাঁহাদের অনুগ্রহে সেই রেখা মুছিয়া লও। তাঁহার অনুশাসন এই যে, বাংলার মাঝখানে যে রাজাই যতগুলি রেখাই টানিয়া দিন, তোমাদিগকে এক থাকিতে হইবে-- আবেদন-নিবেদনের জোরে নয়, নিজের শক্তিতে এক থাকিতে হইবে, নিজের প্রেমে এক থাকিতে হইবে। রাজার দ্বারা বঙ্গবিভাগ ঘটিতেও পারে, নাও ঘটিতে পারে-- তাহাতে অতিমাত্র বিষণ্ন বা উল্লসিত হইয়ো না-- তোমরা যে আজ একই আকাঙক্ষা অনুভব করিতেছ ইহাতেই আনন্দিত হও এবং সেই আকাঙক্ষা তৃপ্তির জন্য সকলের মনে যে একই উদ্যম জন্মিয়াছে ইহার দ্বারাই সার্থকতা লাভ করো।
অতএব, এখন কিছুদিনের জন্য কেবল মাত্র একটা হৃদয়ের আন্দোলন ভোগ করিয়া এই শুভ সুযোগকে নষ্ট করিয়া ফেলিলে চলিবে না। আপনাকে সংবরণ করিয়া, সংযত করিয়া, এই আবেগকে নিত্য করিতে হইবে। আমাদের যে ঐক্যকে একটা আঘাতের সাহায্যে দেশের আদ্যন্তমধ্যে আমরা একসঙ্গে সকলে অনুভব করিয়াছি-- আমরা হিন্দু-মুসলমান, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্ত্রীলোক ও পুরুষ সকলেই বাঙালি বলিয়া যে এক বাংলার বেদনা অনুভব করিতে পারিয়াছি-- আঘাতের কারণ দূর হইলেই বা বিস্মৃত হইলেই সেই ঐক্যের চেতনা যদি দূর হইয়া যায় তবে আমাদের মতো দুর্ভাগা আর কেহ নাই। এখন হইতে আমাদের ঐক্যকে নানা উপলক্ষে নানা আকারে স্বীকার ও সম্মান করিতে হইবে। এখন হইতে আমরা হিন্দু ও মুসলমান, শহরবাসী ও পল্লীবাসী, পূর্ব ও পশ্চিম, পরস্পরের দৃঢ়বদ্ধ করতলের বন্ধন প্রতিক্ষণে অনুভব করিতে থাকিব। বিচ্ছেদে প্রেমকে ঘনিষ্ঠ করে; বিচ্ছেদের ব্যবধানের মধ্য দিয়া যে প্রবল মিলন সংঘটিত হইতে থাকে তাহা সচেষ্ট, জাগ্রত, বৈদ্যুত শক্তিতে পরিপূর্ণ। ঈশ্বরের ইচ্ছায় যদি আমাদের বঙ্গভূমি রাজকীয় ব্যবসায় বিচ্ছিন্নই হয়, তবে সেই বিচ্ছেদবেদনার উত্তেজনায় আমাদিগকে সামাজিক সদ্ভাবে আরো দৃঢ়রূপে মিলিত হইতে হইবে, আমাদিগকে নিজের চেষ্টায় ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে-- সেই চেষ্টার উদ্রেকই আমাদের পরম লাভ।
কিন্তু অনির্দিষ্টভাবে সাধারণভাবে এ কথা বলিলে চলিবে না। মিলন কেমন করিয়া ঘটিতে পারে? একত্রে মিলিয়া কাজ করিলেই মিলন ঘটে, তাহা ছাড়া যথার্থ মিলনের আর-কোনো উপায় নাই।
দেশের কার্য বলিতে আর ভুল বুঝিলে চলিবে না-- এখন সেদিন নাই-- আমি যাহা বলিতেছি তাহার অর্থ এই, সাধ্যমত নিজেদের অভাব মোচন করা, নিজেদের কর্তব্য নিজে সাধন করা।
এই অভিপ্রায়টি মনে রাখিয়া দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্তৃসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব-- তাঁহাদের নিকটে নিজেকে সম্পূর্ণ অধীন, সম্পূর্ণ নত করিয়া রাখিব; তাঁহাদিগকে কর দান করিব; তাঁহাদের আদেশ পালন করিব; নির্বিচারে তাঁহাদের শাসন মানিয়া চলিব; তাঁহাদিগকে সম্মান করিয়া আমাদের দেশকে সম্মানিত করিব।
আমি জানি, আমার এই প্রস্তাবকে আমাদের বিবেচক ব্যক্তিগণ অসম্ভব বলিয়া উড়াইয়া দিবেন। যাহা নিতান্তই সহজ, যাহাতে দুঃখ নাই, ত্যাগ নাই, অথচ আড়ম্বর আছে, উদ্দীপনা আছে, তাহা ছাড়া আর-কিছুকেই আমাদের স্বাদেশিকগণ সাধ্য বলিয়া গণ্যই করেন না। কিন্তু সম্প্রতি নাকি বাংলায় একটা দেশব্যাপী ক্ষোভ জন্মিয়াছে, সেইজন্যই আমি বিরক্ত ও বিদ্রূপ উদ্রেকের আশঙ্কা পরিত্যাগ করিয়া আমার প্রস্তাবটি সকলের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি এবং আশ্বস্ত করিবার জন্য একটা ঐতিহাসিক নজিরও এখানে উদ্ধৃত করিতেছি। আমি যে বিবরণটি পাঠ করিতে উদ্যত হইয়াছি তাহা রুশীয় গবর্মেন্টের অধীনস্থ বাহ্লীক প্রদেশীয়। ইহা কিছুকাল পূর্বে স্টেট্স্ম্যান পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল। সেই বাহ্লীক প্রদেশে জর্জীয় আর্মানিগণ যে চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছে তাহা যে কেন আমাদের পক্ষে দৃষ্টান্তস্বরূপ হইবে না তাহা জানি না। সেখানে "সকার্ট্ভেলিস্টি' নামধারী একটি জর্জীয় "ন্যাশনালিস্ট' সম্প্রদায় গঠিত হইয়াছে-- ইঁহারা "কার্স' প্রদেশে প্রত্যেক গ্রাম্য জিলায় স্বদেশীয় বিচারকদের দ্বারা গোপন বিচারশালা স্থাপন করিয়া রাজকীয় বিচারালয়কে নিষ্প্রভ করিয়া দিয়াছেন--
The peasants aver that these secret courts work with much greater expedition, accuracy and fairness than the Crown Courts, and that the Judges have the invaluable characteristic of incorruptibility। The Drozhakisti, or Armenian Nationalist party, had previously established a similar system of justice in the rural districts of the province of Erwan and more than that, they had practically supplanted the whole of the government system of rural administration and were employing agricultural experts, teachers and physicians of thier own choosing। It has long been a matter of notoriety that ever since the suppression of Armenian schools by the Rassian minister of Education, Delyanoff, who by the way was himself an Armenian, the Armenian population of the Caucasus has maintained clandestine national schools of its own।
আমি কেবল এই বৃত্তান্তটি উদাহরণস্বরূপে উদ্ধৃত করিয়াছি-- অর্থাৎ ইহার মধ্যে এইটুকুই দ্রষ্টব্য যে, স্বদেশের কর্মভার দেশের লোকের নিজেদের গ্রহণ করিবার চেষ্টা একটা পাগলামি নহে-- বস্তুত, দেশের হিতেচ্ছু ব্যক্তিদের এইরূপ চেষ্টাই একমাত্র স্বাভাবিক।
আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষিতলোক যে গবর্মেন্টের চাকরিতে মাথা বিকাইয়া রাখিয়াছেন, ইহার শোচনীয়তা কি আমরা চিন্তা করিব না? কেবল চাকরির পথ আরো প্রশস্ত করিয়া দিবার জন্য প্রার্থনা করিব? চাকরির খাতিরে আমাদের দুর্বলতা কতদূর বাড়িতেছে তাহা কি আমরা জানি না? আমরা মনিবকে খুশি করিবার জন্য গুপ্তচরের কাজ করিতেছি, মাতৃভূমির বিরুদ্ধে হাত তুলিতেছি এবং যে মনিব আমাদের প্রতি অশ্রদ্ধা করে তাহাকে পৌরুষক্ষয়কর অপমানজনক আদেশও প্রফুল্লমুখে পালন করিতেছি-- এই চাকরি আরো বিস্তার করিতে হইবে? দেশের শিক্ষিতসম্প্রদায়ের বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করিতে হইবে। আমরা যদি স্বদেশের কর্মভার নিজে গ্রহণ করিতাম তবে গবর্মেন্টের আপিস রাক্ষসের মতো আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকদিগকে কি এমন নিঃশেষে গ্রাস করিত? আবেদনের দ্বারা সরকারের চাকরি নহে, পৌরুষের দ্বারা স্বদেশের কর্মক্ষেত্র বিস্তার করিতে হইবে। যাহাতে আমাদের ডাক্তার, আমাদের শিক্ষক, আমাদের এঞ্জিনিয়ারগণ দেশের অধীন থাকিয়া দেশের কাজেই আপনার যোগ্যতার স্ফূর্তিসাধন করিতে পারেন আমাদিগকে তাহার ব্যবস্থা করিতেই হইবে। নতুবা আমাদের যে কী শক্তি আছে তাহার পরিচয়ই আমরা পাইব না। তা ছাড়া, এ কথা আমাদিগকে মনে রাখিতে হইবে যে, সেবার অভ্যাসের দ্বারাই প্রীতির উপচয় হয়; যদি আমরা শিক্ষিতগণ এমন কোথাও কাজ করিতাম যেখানে দেশের কাজ করিতেছি এই ধারণা সর্বদা স্পষ্টরূপে জাগ্রত থাকিত, তবে দেশকে ভালোবাসো-- এ কথা নীতিশাস্ত্রের সাহায্যে উপদেশ দিতে হইত না। তবে এক দিকে যোগ্যতার অভিমান করা, অন্য দিকে প্রত্যেক অভাবের জন্য পরের সাহায্যের প্রার্থী হওয়া, এমনতরো অদ্ভুত অশ্রদ্ধাকর আচরণে আমাদিগকে প্রবৃত্ত হইতে হইত না-- দেশের শিক্ষা স্বাধীন হইত এবং শিক্ষিত সমাজের শক্তি বন্ধনমুক্ত হইত।
জর্জীয়গণ, আর্মানিগণ প্রবল জাতি নহে-- ইহারা যে-সকল কাজ প্রতিকূল অবস্থাতেও নিজে করিতেছে আমরা কি সেই-সকল কাজেরই জন্য দরবার করিতে দৌড়াই না? কৃষিতত্ত্বপারদর্শীদের লইয়া আমরাও কি আমাদের দেশের কৃষির উন্নতিতে প্রবৃত্ত হইতে পারিতাম না? আমাদের ডাক্তার লইয়া আমাদের দেশের স্বাস্থ্যবিধান-চেষ্টা কি আমাদের পক্ষে অসম্ভব? আমাদের পল্লীর শিক্ষাভার কি আমরা গ্রহণ করিতে পারি না? যাহাতে মামলা-মকদ্দমায় লোকের চরিত্র ও সম্বল নষ্ট না হইয়া সহজ বিচারপ্রণালীতে সালিস-নিষ্পত্তি দেশে চলে তাহার ব্যবস্থা করা কি আমাদের সাধ্যাতীত? সমস্তই সম্ভব হয়, যদি আমাদের এই-সকল স্বদেশী চেষ্টাকে যথার্থভাবে প্রয়োগ করিবার জন্য একটা দল বাঁধিতে পারি। এই দল, এই কর্তৃসভা আমাদিগকে স্থাপন করিতেই হইবে-- নতুবা বলিব, আজ আমরা যে-একটা উত্তেজনা প্রকাশ করিতেছি তাহা মাদকতা মাত্র, তাহার অবসানে অবসাদের পঙ্কশয্যায় লুণ্ঠন করিতে হইবে।
একটা কথা আমাদিগকে ভালো করিয়া বুঝিতে হইবে যে, পরের প্রদত্ত অধিকার আমাদের জাতীয় সম্পদ্রূপে গণ্য হইতে পারে না-- বরঞ্চ তাহার বিপরীত। দৃষ্টান্তস্বরূপে একবার পঞ্চায়েৎবিধির কথা ভাবিয়া দেখুন। একসময় পঞ্চায়েৎ আমাদের দেশের জিনিস ছিল, এখন পঞ্চায়েৎ গবর্মেন্টের আফিসে-গড়া জিনিস হইতে চলিল। যদি ফল বিচার করা যায় তবে এই দুই পঞ্চায়েতের প্রকৃতি একেবারে পরস্পরের বিপরীত বলিয়াই প্রতীত হইবে। যে পঞ্চায়েতের ক্ষমতা গ্রামের লোকের স্বতঃপ্রদত্ত নহে, যাহা গবর্মেন্টের দত্ত, তাহা বাহিরের জিনিস হওয়াতেই গ্রামের বক্ষে একটা অশান্তির মতো চাপিয়া বসিবে-- তাহা ঈর্ষার সৃষ্টি করিবে-- এই পঞ্চায়েৎপদ লাভ করিবার জন্য অযোগ্য লোকে এমন-সকল চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইবে যাহাতে বিরোধ জন্মিতে থাকিবে-- পঞ্চায়েৎ ম্যাজিস্ট্রেটবর্গকেই স্বপক্ষ এবং গ্রামকে অপর পক্ষ বলিয়া জানিবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট বাহবা পাইবার জন্য গোপনে অথবা প্রকাশ্যে গ্রামের বিশ্বাসভঙ্গ করিবে-- ইহারা গ্রামের লোক হইয়া গ্রামের চরের কাজ করিতে বাধ্য হইবে এবং যে পঞ্চায়েৎ এ দেশে গ্রামের বলস্বরূপ ছিল সেই পঞ্চায়েৎই গ্রামের দুর্বলতার কারণ হইবে। ভারতবর্ষের যে-সকল গ্রামে এখনো গ্রাম্য পঞ্চায়েতের প্রভাব বর্তমান আছে, যে পঞ্চায়েৎ কালক্রমে শিক্ষার বিস্তার ও অবস্থার পরিবর্তন-অনুসারে স্বভাবতই স্বাদেশিক পঞ্চায়েতে পরিণত হইতে পারিত, যে-গ্রাম্যপঞ্চায়েৎগণ একদিন স্বদেশের সাধারণ কার্যে পরস্পরের মধ্যে যোগ বাঁধিয়া দাঁড়াইবে এমন আশা করা যাইত-- সেই-সকল গ্রামের পঞ্চায়েৎগণের মধ্যে একবার যদি গবর্মেন্টের বেনো জল প্রবেশ করে, তবে পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েতত্ব চিরদিনের মতো ঘুচিল। দেশের জিনিস হইয়া তাহারা যে কাজ করিত গবর্মেন্টের জিনিস হইয়া তাহার সম্পূর্ণ উলটারকম কাজ করিবে।
ইহা হইতে আমাদিগকে বুঝিতে হইবে, দেশের হাত হইতে আমরা যে ক্ষমতা পাই তাহার প্রকৃতি একরকম, আর পরের হাত হইতে যাহা পাই তাহার প্রকৃতি সম্পূর্ণ অন্যরকম হইবেই। কারণ, মূল্য না দিয়া কোনো জিনিস আমরা পাইতেই পারি না। সুতরাং দেশের কাছ হইতে আমরা যাহা পাইব সেজন্য দেশের কাছেই আপনাকে বিকাইতে হইবে-- পরের কাছ হইতে যাহা পাইব সেজন্য পরের কাছে না বিকাইয়া উপায় নাই। এইরূপ বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ যদি পরের কাছে মাগিয়া লইতে হয় তবে শিক্ষাকে পরের গোলামি করিতেই হইবে-- যাহা স্বাভাবিক, তাহার জন্য আমরা বৃথা চীৎকার করিয়া মরি কেন?
দৃষ্টান্তস্বরূপ আর-একটা কথা বলি। মহাজনেরা চাষিদের অধিক সুদে কর্জ দিয়া তাহাদের সর্বনাশ করিতেছে, আমরা প্রার্থনা ছাড়া অন্য উপায় জানি না-- অতএব গবর্মেন্টকেই অথবা বিদেশী মহাজনদিগকে যদি আমরা বলি যে, তোমরা অল্প সুদে আমাদের গ্রামে গ্রামে কৃষি-ব্যাঙ্ক স্থাপন করো, তবে নিজে খদ্দের ডাকিয়া আনিয়া আমাদের দেশের চাষিদিগকে নিঃশেষে পরের হাতে বিকাইয়া দেওয়া হয় না? যাহারা যথার্থই দেশের বল, দেশের সম্পদ, তাহাদের প্রত্যেকটিতে কি পরের হাতে এমনি করিয়া বাঁধা রাখিতে হইবে? আমরা যে পরিমাণেই দেশের কাজ পরকে দিয়া করাইব সেই পরিমাণেই আমরা নিজের শক্তিকেই বিকাইতে থাকিব, দেশকে স্বেচ্ছাকৃত অধীনতাপাশে উত্তরোত্তর অধিকতর বাঁধিতে থাকিব-- এ কথা কি বুঝা এতই কঠিন? পরের প্রদত্ত ক্ষমতা আমাদের পক্ষে উপস্থিত সুবিধার কারণ যেমনই হউক তাহা আমাদের পক্ষে ছদ্মবেশী অভিসম্পাত, এ কথা স্বীকার করিতে আমাদের যত বিলম্ব হইবে আমাদের মোহজাল ততই দুশ্ছেদ্য হইয়া উঠিতে থাকিবে।
অতএব, আর দ্বিধা না করিয়া আমাদের গ্রামের স্বকীয় শাসনকার্য আমাদিগকে নিজের হাতে লইতেই হইবে। সরকারি পঞ্চায়েতের মুষ্টি আমাদের পল্লীর কণ্ঠে দৃঢ় হইবার পূর্বেই আমাদের নিজের পল্লী-পঞ্চায়েৎকে জাগাইয়া তুলিতে হইবে। চাষিকে আমরাই রক্ষা করিব, তাহার সন্তানদিগকে আমরাই শিক্ষা দিব, কৃষির উন্নতি আমরাই সাধন করিব, গ্রামের স্বাস্থ্য আমরাই বিধান করিব এবং সর্বনেশে মামলার হাত হইতে আমাদের জমিদার ও প্রজাদিগকে আমরাই বাঁচাইব। এ সম্বন্ধে রাজার সাহায্য লইবার কল্পনাও যেন আমাদের মাথায় না আসে-- কারণ, এ স্থলে সাহায্য লইবার অর্থই দুর্বলের স্বাধীন অধিকারের মধ্যে প্রবলকে ডাকিয়া আনিয়া বসানো।
একবার বিবেচনা করিয়া দেখিবেন, বিদেশী শাসনকালে বাংলাদেশে যদি এমন কোনো জিনিসের সৃষ্টি হইয়া থাকে যাহা লইয়া বাঙালি যথার্থ গৌরব করিতে পারে, তাহা বাংলা সাহিত্য। তাহার একটা প্রধান কারণ, বাংলা সাহিত্য সরকারের নেমক খায় নাই। পূর্বে প্রত্যেক বাংলা বই সরকার তিনখানি করিয়া কিনিতেন শুনিতে পাই এখন মূল্য দেওয়া বন্ধ করিয়াছেন। ভালোই করিয়াছেন। গবর্মেন্টের উপাধি-পুরস্কার-প্রসাদের প্রলোভন বাংলা সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে নাই বলিয়াই, এই সাহিত্য বাঙালির স্বাধীন আনন্দ-উৎস হইতে উৎসারিত বলিয়াই আমরা এই সাহিত্যের মধ্য হইতে এমন বল পাইতেছি। হয়তো গণনায় বাংলাভাষায় উচ্চশ্রেণীর গ্রন্থ-সংখ্যা অধিক না হইতে পারে, হয়তো বিষয়বৈচিত্র্যে এ সাহিত্য অন্যান্য সম্পৎশালী সাহিত্যের সহিত তুলনীয় নহে, কিন্তু তবু ইহাকে আমরা বর্তমান অসম্পূর্ণতা অতিক্রম করিয়া বড়ো করিয়া দেখিতে পাই-- কারণ, ইহা আমাদের নিজের শক্তি হইতে, নিজের অন্তরের মধ্য হইতে উদ্ভূত হইতেছে। এ ক্ষীণ হউক, দীন হউক, এ রাজার প্রশয়ের প্রত্যাশী নহে-- আমাদের প্রাণ ইহাকে প্রাণ জোগাইতেছে। অপর পক্ষে, আমাদের স্কুল-বইগুলির প্রতি ন্যূনাধিক পরিমাণে অনেক দিন হইতেই সরকারের গুরুহস্তের ভার পড়িয়াছে, এই রাজপ্রাসাদের প্রভাবে এই বইগুলির কিরূপ শ্রী বাহির হইতেছে তাহা কাহারো অগোচর নাই।
এই-যে স্বাধীন বাংলা সাহিত্য যাহার মধ্যে বাঙালি নিজের প্রকৃত শক্তি যথার্থভাবে অনুভব করিয়াছে, এই সাহিত্যই নাড়ীজালের মতো বাংলার পূর্ব-পশ্চিম উত্তর-দক্ষিণকে এক বন্ধনে বাঁধিয়াছে; তাহার মধ্যে এক চেতনা, এক প্রাণ সঞ্চার করিয়া রাখিতেছে; যদি আমাদের দেশে স্বদেশীসভাস্থাপন হয় তবে বাংলা সাহিত্যের অভাবমোচন, বাংলা সাহিত্যের পুষ্টিসাধন সভ্যগণের একটি বিশেষ কার্য হইবে। বাংলা ভাষা অবলম্বন করিয়া ইতিহাস বিজ্ঞান অর্থনীতি প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ে দেশে জ্ঞানবিস্তারের চেষ্টা তাঁহাদিগকে করিতে হইবে। ইহা নিশ্চয় জানিতে হইবে যে, বাংলা সাহিত্য যত উন্নত সতেজ, যতই সম্পূর্ণ হইবে, ততই এই সাহিত্যই বাঙালি জাতিকে এক করিয়া ধারণ করিবার অনশ্বর আধার হইবে। বৈষ্ণবের গান, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরাম দাসের মহাভারত আজ পর্যন্ত এই কাজ করিয়া আসিয়াছে।
আমি জানি, সমস্ত বাংলাদেশ এক মুহূর্তে একত্র হইয়া আপনার নায়ক নির্বাচনপূর্বক আপনার কাজে প্রবৃত্ত হইবে, এমন আশা করা যায় না। এখন আর বাদবিবাদ তর্কবিতর্ক না করিয়া আমরা যে-কয়জনেই উৎসাহ অনুভব করি, প্রয়োজন স্বীকার করি, সেই পাঁচ-দশজনেই মিলিয়া আমরা, আপনাদের অধিনায়ক নির্বাচন করিব, তাঁহার নিয়োগক্রমে জীবনযাত্রা নিয়মিত করিব, কর্তব্য পালন করিব, এবং সাধ্যমতে আপনার পরিবার প্রতিবেশী ও পল্লীকে লইয়া সুখ-স্বাস্থ্য-শিক্ষাবিধান সম্বন্ধে একটি স্বকীয় শাসনজাল বিস্তার করিব। এই প্রত্যেক দলের নিজের পাঠশালা, পুস্তকালয়, ব্যায়ামাগার, ব্যবহার্য দ্রব্যাদির বিক্রয়ভাণ্ডার (কো-অপারেটিভ স্টোর), ঔষধালয়, সঞ্চয় ব্যাঙ্ক, সালিস-নিষ্পত্তির সভা ও নির্দোষ আমোদের মিলনগৃহ থাকিবে।
এমনি করিয়া যদি আপাতত খণ্ড খণ্ড ভাবে দেশের নানা স্থানে এইরূপ এক-একটি কর্তৃসভা স্থাপিত হইতে থাকে, তবে, ক্রমে একদিন এই-সমস্ত খণ্ডসভাগুলিকে যোগসূত্রে এক করিয়া তুলিয়া একটি বিশ্ববঙ্গপ্রতিনিধিসভা প্রতিষ্ঠিত হইতে পারিবে।
আমরা এই সময়ে এই উপলক্ষে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎকে বাংলার ঐক্যসাধনযজ্ঞে বিশেষভাবে আহ্বান করিতেছি। তাঁহারা পরের দিকে না তাকাইয়া, নিজেকে পরের কাছে প্রচার না করিয়া, নিজের সাধ্যমত স্বদেশের পরিচয়লাভ ও তাহার জ্ঞানভাণ্ডারপূরণ করিতেছেন। এই পরিষৎকে জেলায় জেলায় আপনার শাখাসভা স্থাপন করিতে হইবে, এবং পর্যায়ক্রমে এক-একটি জেলায় গিয়া পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন সম্পন্ন করিতে হইবে। আমাদের চিন্তার ঐক্য, ভাবের ঐক্য, ভাষার ঐক্য, সাহিত্যের ঐক্য সম্বন্ধে সমস্ত দেশকে সচেতন করিবার, এই ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে আপন স্বাধীন কর্তব্য পালন করিবার ভার সাহিত্য-পরিষৎ গ্রহণ করিয়াছেন। এখন সময় উপস্থিত হইয়াছে-- এখন সমস্ত দেশকে নিজের আনুকূল্যে আহ্বান করিবার জন্য তাঁহাদিগকে সচেষ্ট হইতে হইবে।
যখন দেখা যাইতেছে বাহির হইতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিবার চেষ্টা নিয়ত সতর্ক রহিয়াছে তখন তাহার প্রতিকারের জন্য নানারূপে কেবলই দল বাঁধিবার দিকে আমাদের সমস্ত চেষ্টাকে নিযুক্ত করিতে হইবে।
যে গুণে মানুষকে একত্র করে তাহার মধ্যে একটা প্রধান গুণ বাধ্যতা। কেবলই অন্যকে খাটো করিবার চেষ্টা, তাহার ত্রুটি ধরা, নিজেকে কাহারো চেয়ে ন্যূন মনে না করা, নিজের একটা মত অনাদৃত হইলেই অথবা নিজের একটুখানি সুবিধার ব্যাঘাত হইলেই দল ছাড়িয়া আসিয়া তাহার বিরুদ্ধাচরণ করিবার প্রয়াস-- এইগুলিই সেই শয়তানের প্রদত্ত বিষ যাহা মানুষকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দেয়, যজ্ঞ নষ্ট করে। ঐক্যরক্ষার জন্য আমাদিগকে অযোগ্যের কর্তৃত্বও স্বীকার করিতে হইবে-- ইহাতে মহান্ সংকল্পের নিকট নত হওয়া হয়, অযোগ্যতার নিকট নহে। বাঙালিকে ক্ষুদ্র আত্মাভিমান দমন করিয়া নানারূপে বাধ্যতার চর্চা করিতে হইবে, নিজে প্রধান হইবার চেষ্টা মন হইতে সম্পূর্ণরূপে দূর করিয়া অন্যকে প্রধান করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। সর্বদাই অন্যকে সন্দেহ করিয়া, অবিশ্বাস করিয়া, উপহাস করিয়া, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় না দিয়া, বরঞ্চ নম্রভাবে বিনা বাক্যব্যয়ে ঠকিবার জন্যও প্রস্তুত হইতে হইবে। সম্প্রতি এই কঠিন সাধনা আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে-- আপনকে খর্ব করিয়া আপনাদিগকে বড়ো করিবার এই সাধনা, খর্বকে বিসর্জন দিয়া গৌরবকে আশ্রয় করিবার এই সাধনা-- ইহা যখন আমাদের সিদ্ধ হইবে তখন আমরা সর্বপ্রকার কর্তৃত্বের যথার্থ যোগ্য হইব। ইহাও নিশ্চিত, যথার্থ যোগ্যতাকে পৃথিবীতে কোনো শক্তিই প্রতিরোধ করিতে পারে না। আমরা যখন কর্তৃত্বের ক্ষমতা লাভ করিব তখন আমরা দাসত্ব করিব না-- তা আমাদের প্রভু যত বড়োই প্রবল হউন। জল যখন জমিয়া কঠিন হয় তখন সে লোহার পাইপকেও ফাটাইয়া ফেলে। আজ আমরা জলের মতো তরল আছি, যন্ত্রীর ইচ্ছামত যন্ত্রের তাড়নায় লোহার কলের মধ্যে শত শত শাখাপ্রশাখায় ধাবিত হইতেছি-- জমাট বাঁধিবার শক্তি জন্মিলেই লোহার বাঁধনকে হার মানিতেই হইবে।
আমাদের নিজের দিকে যদি সম্পূর্ণ ফিরিয়া দাঁড়াইতে পারি, তবে নৈরাশ্যের লেশমাত্র কারণ দেখি না। বাহিরের কিছুতে আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিবে, এ কথা আমরা কোনোমতেই স্বীকার করিব না। কৃত্রিম বিচ্ছেদ যখন মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইবে তখনই আমরা সচেতনভাবে অনুভর করিব যে, বাংলার পূর্ব-পশ্চিমকে চিরকাল একই জাহ্নবী তাঁহার বহু বাহুপাশে বাঁধিয়াছেন; একই ব্রহ্মপুত্র তাঁহার প্রসারিত আলিঙ্গনে গ্রহণ করিয়াছেন; এই পূর্ব-পশ্চিম, হৃৎপিণ্ডের দক্ষিণ-বাম অংশের ন্যায়, একই পুরাতন রক্তস্রোতে সমস্ত বঙ্গদেশের শিরা-উপশিরায় প্রাণবিধান করিয়া আসিয়াছে; এই পূর্ব-পশ্চিম, জননীর বাম-দক্ষিণ স্তনের ন্যায়, চিরদিন বাঙালির সন্তানকে পালন করিয়াছে। আমাদের কিছুতেই পৃথক করিতে পারে এ ভয় যদি আমাদের জন্মে তবে সে ভয়ের কারণ নিশ্চয়ই আমাদেরই মধ্যে আছে এবং তাহার প্রতিকার আমাদের নিজের চেষ্টা ছাড়া আর-কোনো কৃত্রিম উপায়ের দ্বারা হইতে পারে না। কর্তৃপক্ষ আমাদের একটা-কিছু করিলেন বা না করিলেন বলিয়াই যদি আমাদের সকল দিকে সর্বনাশ হইয়া গেল বলিয়া আশঙ্কা করি, তবে কোনো কৌশললব্ধ সুযোগে কোনো প্রার্থনালব্ধ অনুগ্রহে আমাদিগকে অধিক দিন রক্ষা করিতে পারিবে না। ঈশ্বর আমাদের নিজের হাতে যাহা দিয়াছেন তাহার দিকে যদি তাকাইয়া দেখি তবে দেখিব, তাহা যথেষ্ট এবং তাহাই যথার্থ। মাটির নীচে যদি বা তিনি আমাদের জন্য গুপ্তধন না দিয়া থাকেন, তবু আমাদের মাটির মধ্যে সেই শক্তিটুকু দিয়াছেন যাহাতে বিধিমত কর্ষণ করিলে ফললাভ হইতে কখনোই বঞ্চিত হইব না। বাহির হইতে সুবিধা এবং সম্মান যখন হাত বাড়াইলেই পাওয়া যাইবে না, তখনই ঘরের মধ্যে যে চিরসহিষ্ণু চিরন্তন প্রেম লক্ষ্মীছাড়াদের গৃহপ্রত্যাবর্তনের জন্য গোধূলির অন্ধকারে পথ তাকাইয়া আছে তাহার মূল্য বুঝিব। তখন মাতৃভাষায় ভ্রাতৃগণের সহিত সুখদুঃখ-লাভক্ষতি আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিতে পারিব-- এবং সেই শুভদিন যখন আসিবে তখনই ব্রিটিশ শাসনকে বলিব ধন্য; তখনই অনুভব করিব বিদেশীর এই রাজত্ব বিধাতারই মঙ্গলবিধান। আমরা যাচিত ও অযাচিত যে-কোনো অনুগ্রহ পাইয়াছি তাহা যেন ক্রমে আমাদের অঞ্জলি হইতে স্খলিত হইয়া পড়ে এবং তাহা যেন স্বচেষ্টায় নিজে অর্জন করিয়া লইবার অবকাশ পাই। আমরা প্রশ্রয় চাহি না-- প্রতিকূলতার দ্বারাই আমাদের শক্তির উদ্বোধন হইবে। আমাদের নিদ্রার সহায়তা কেহ করিয়ো না-- আরাম আমাদের জন্য নহে, পরবশতার অহিফেনের মাত্রা প্রতিদিন আর বাড়িতে দিয়ো না -- বিধাতার রুদ্রমূর্তিই আজ আমাদের পরিত্রাণ। জগতে জড়কে সচেতন করিয়া তুলিবার একইমাত্র উপায় আছে-- আঘাত অপমান ও অভাব, সমাদর্শ নহে, সহায়তা নহে, সুভিক্ষা নহে।
দেশভাগ কি আরও কম রক্তস্নাত হতে পারতো? # রামচন্দ্র গুহ
২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৭ রাত ৮:৪৪ |
১৯৪৭ এর ফেব্র"য়ারিতে লন্ডনের লেবার সরকারে ঘোষণা দেয়, তারা ১৯৪৮ এর জুনের মধ্যে ভারত ছাড়বে। তিনমাস পর নতুন ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন প্রায় নাটকীয় ভাবে ভারত ত্যাগের সময় সংপ্তি করে আগস্ট ১৯৪৭-এ এগিয়ে আনেন। তার দরবারি জীবনীকার ফিলিপ জিয়েগলার এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিক দিক তুলে ধরেছেন, 'যখনই দেশভাগের নীতি গৃহীত হয়েছে, তখনই বোঝা গেছে সাম্প্রদায়িকতা এখন মুক্তভাবে ঘৃণার উদ্গীরণ ঘটাবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘকালীন অপেক্ষা সবচেয়ে খারাপ ঘটনাগুলোকেই উৎসাহিত করবে, উদ্বেগ ও হানাহানি বিস্তৃত হবে। আজ এটা পাঞ্জাবে, কাল বাংলা কিংবা হায়দরাবাদে অথবা উপমহাদেশের অগণন সমাজের যে কোনো স্থানে ঘটতে পারে। এটা ঘটতে পারে সেখানেই, যেখানে হিন্দু ও মুসলমানরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অবস্থান করছে। দুই শত বা দুই হাজার মৃত্যু সেখানে দুই মিলিয়ন বা বিশ মিলিয়নে পরিণত হতে পারে।
১৯৮৫ সালে জিয়েগলার জীবনীটি লিখলেও বাস্তবতা হলো, দেশবিভাগের মূল্য হিসাবে এক মিলিয়ন মৃতদেহ গুনতে হয়েছিল। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে, এটা ছিল আরও বেশি। প্রায় দুই মিলিয়নের কাছাকাছি। যেভাবে পরিকল্পিত হয়েছিল, সেভাবে সেই জুন ১৯৪৮-এ ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করলে এই সংখ্যা কততে দাঁড়াতো? মাউন্টব্যাটেনের কাজের একটি আক্রমণাত্বক সমালোচনায় অ্যান্ড্রিউ রবার্টস তাকে নমনীয়তা ও দোদুল্যমানতার জন্য অভিযুক্ত করেছেনÑ
'যখনই শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলার সময় এসেছে, তখনই মাউন্টব্যাটেন মেরুদণ্ডহীনের পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন'Ñ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কার্যকর হস্তক্ষেপ করার অনিচ্ছায়, আরও স্পষ্ট করে বললে পাঞ্জাব সীমান্ত বাহিনীকে কাজে না লাগিয়ে এবং একে বিমান বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট না করে। জিয়েগলারের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েও রবার্টস মনে করেন 'তাড়াহুড়ার প্রত্যাহার' তবু 'কিছু কম প্রাণক্ষয় সম্ভব করে তুলেছে।
মাউন্টব্যাটেনের কর্মকর্তারা তাকে আগেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল, পাঞ্জাবই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। সেখানে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হতে পারে। কিন্তু সময় যখন এলো তখন দাঙ্গা দমনে যথেষ্ট সৈন্য মোতায়েন করা হলো না। এর পেছনে ছিল একটাই কারণ, শাসক ব্রিটিশরা চলে যাচ্ছে এ ঘোষণা জনসম্মুখে প্রচারিত হলে তারা আক্রমণের শিকার হবে। এই ভয় তাদের মনে গেঁড়ে বসেছিল। এই ধারণাটি বহুলভাবে ব্রিটিশ কর্মকর্তা, জাজক, বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল। ১৯৪৬ এর গ্রীষ্মে একজন তরুণ ব্রিটিশ কর্মকর্তা তার পরিবারের কাছে লেখা চিঠিতে বলেছিল সে কোন দৃষ্টিতে ব্রিটিশদের ভারত ত্যাগকে দেখছে, 'ঘটনা শুরুর পূর্বে পুরো দেশটাই ভাবগতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে গেছে (যা আমাদের ছড়ানো-ছিটানো ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীকে সবখান থেকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম)। কিন্তু যখন তা সত্যিই ঘটতে শুরু করবে তখন তা হিন্দু-মুসলমানদের সাম্প্রদায়িকতার বাইপ্রোডাক্টে পরিণত হবে।'
শেষ দিনগুলোতে শাসকের নীতিই ছিলÑ সর্বাগ্রে ব্রিটিশ জীবনের সুরা নিশ্চিত করা। ১৯৪৭ সালের ফেব্র"য়ারিতে বেঙ্গলের গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক বারোজ বলেছিলেন, 'ব্রিটিশ মতা প্রত্যাহারের তারিখ ঘোষণার পর তার প্রথম পদক্ষেপ হবে...সেনাসদস্যদের সতর্ক রাখা এবং জনতা সহিংস হওয়ার আগেই যথাসম্ভব কম সময়ে ছড়ানো-ছিটানো ইউরোপীয়দের একত্রিত করা।'
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ১৯৪৭-এর গ্রীষ্মে একজন শ্বেতকায় নারী বা পুরুষই ছিল ভারতের সবচেয়ে নিরাপদ লোক। তাদের হত্যা করে কারও কোনও ফায়দা হতো না। কিন্তু তাদের কল্পনাপ্রসূত নিরাপত্তাহীনতার কারণে অন্য স্থানে দাঙ্গা প্রতিরোধে নিয়োজিত না রেখে ইউরোপীয় আবাসগুলোর পাশে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল।
নিজেদের সুরার নীতি থেকে স্বাধীনতার তারিখ ঘোষণার পর পর্র্যন্ত পাঞ্জাব সীমান্ত চিহ্নিতকরণও বন্ধ রাখা হয়েছিল। পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার ইউয়ান্স জেনকিনস নিশ্চিত ছিলেন, নির্ধারিত হওয়ার পরই সীমান্ত সংক্রান্ত ঘোষণা দেয়া হবেÑ এতে ডিস্ট্রিক্ট অফিসাররা ডমিনিয়নের পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তানে এবং ভারতীয়দের ভারতে রাখতে সম হবেন। অন্যদিকে সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে একত্রিত করা হচ্ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে। সীমান্তরেখা চিহ্নিতকরণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ৯ আগস্টেই প্রস্তুত ছিলেন। তারপরও পনের আগস্টের পরই ঘোষণা দিতে চেয়েছেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ভাইসরয়ের তরফে দেরির কারণ হিসাবে ব্যাখ্যা ছিল অদ্ভূত, 'প্রশ্নহীনভাবে বলা চলে, আগেই যদি এটা প্রকাশিত হতো তবে ব্রিটিশদেরকেই এ অপ্রতিরোধ্য ফলের দায় বহন করতে হতো।' এতদসঙ্গে ' এর প্রকাশনা স্থগিত হওয়ায় ব্রিটিশদের ওপর কম বিক্ষোভ প্রদর্শিত হবে।' অর্থাৎ স্থানীয় পুলিশের ওপরই দেশভাগ এবং স্বাধীনতা জনিত ভয়ংকর পরিস্থিতির দায় চাপাও।
রীতি অনুসারে, ইতিহাস সেভাবেই লেখা উচিত যেভাবে তা ঘটেছে, সেভাবে নয় যেভাবে ঘটা উচিত ছিল। আরও বর্ধিত সময়ের কলেবরে একবছর সময় হাতে নিয়ে যদি ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে দেশত্যাগের ঘোষণা দেয়া হতো তবে কি তা কম বেদনাদায়ক হতো? পাঞ্জাব সীমান্তে বেশি সংখ্যক সক্রিয় সেনা মোতায়েন করলে এবং র্যাডকিফের সীমান্ত রেখা চিহ্নিতকরণের ঘোষণা আগেভাগে দিলে কি পাঞ্জাবে কম রক্তপাত হতো? হয়তো, হয়তো নয়।
পাঞ্জাবের একজন কর্মকর্তা অক্সফোর্ডের এক সমাজকর্মীকে যা বলেছিলেন তা-ই হয়তো ব্রিটিশ রাজের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে মোক্ষম এপিটাফ, 'তোমরা ব্রিটিশরা পরিচ্ছন্ন লেনদেনে বিশ্বাস করো। তোমরা ভারত ত্যাগ করেছিলে একে সেই গোলযোগপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছে দিয়ে ঠিক যে অবস্থায় একে পেয়েছিলে তোমরা।'
সূত্র : দি হিন্দু
অনুবাদ : মাহবুব মোর্শেদ
'দশ বছর পরে কেউ মোদীর নাম উল্লেখ করবে না'
আনন্দবাজার – ২৩ ঘন্টা আগেশীতের দুপুরে রোদে পিঠ দিয়ে বসে পড়া যায়, গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে এমন বই লেখা সম্ভব কি আদৌ? রামচন্দ্র গুহ-র নতুন বই, 'প্যাট্রিয়টস অ্যান্ড পার্টিজানস'-এর দুটি ভাগ প্রথমটা ভারতের গণতন্ত্র, রাজনীতি নিয়ে। দ্বিতীয় ভাগে নিছকই কিছু ব্যক্তিগত গদ্য। কোনওটিতে বেঙ্গালুরুর বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা বইয়ের দোকান আর তার মালিকের কথা, কোনও লেখার বিষয় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, কোনওটি 'ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি'র মতো আদ্যন্ত কাঠখোট্টা একটা পত্রিকার বিষয়ে প্রেমগাথা! এই দ্বিতীয় ভাগের লেখাগুলো বড্ড শীতের দুপুরে পড়ার মতো। উপভোগ্য।
কথাটা শুনে খানিক খুশিই হলেন রামচন্দ্র। বললেন, 'মোটামুটি জটিল একটা জিনিসকে যদি শীতের দুপুরে পড়ার মতো করে লিখে থাকতে পারি, সেটা তো সাফল্যই। সহজ করে লেখা ব্যাপারটা আসলে সচিন তেন্ডুলকরের স্ট্রেট ড্রাইভের মতো। সচিন যখন মারেন, বেশ সহজ দেখতে। আড়ালে আছে অনেক দিনের অনেক হাড়ভাঙা খাটুনি, প্র্যাকটিস।'
লেখক জীবনের ব্যাখ্যায় তাঁর ক্রিকেট ঢুকে আসবে, প্রত্যাশিতই। এগারো থেকে একুশ, জীবনের দশ বছর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি ভারতের হয়ে টেস্ট খেলার স্বপ্ন। নিজেই হাসতে হাসতে বললেন, 'মুশকিল ছিল, আমার মতো আরও ছ'কোটি কিশোর একই স্বপ্ন দেখত তখন। প্রথম এগারো জনে ঢোকার মতো প্রতিভা নেই বুঝতে পেরে সেই চেষ্টা ছাড়লাম। ও দিকে অর্থনীতি নিয়ে এম এ পাশ করার পর বুঝলাম, তাতেও হবে না। তেত্রিশ বছর আগের এক জানুয়ারিতে কলকাতায় এসেছিলাম আইআইএম-এ পিএইচ ডি করতে। যে দিন মাদ্রাজ থেকে ট্রেনে চাপলাম, চিপক স্টেডিয়ামে সে দিন ভারত-পাকিস্তান টেস্টের দ্বিতীয় দিন ছিল। দিনের শেষে গাওস্কর ৯২ নট আউট। পর দিন সেঞ্চুরি করলেন, আমি তখন ট্রেনে। তার পর আর কোনও দিন স্টেডিয়ামে বসে গাওস্করের সেঞ্চুরি দেখা হল না।' খানিক বিষাদ, গলায়?
তাঁর বইয়ে অবশ্য বিষাদ সংশয়াতীত। 'সভ্যতা' বলতে কিছু বছর আগেও যা বুঝত সবাই, সেটা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাওয়ার বিষাদ। বহু ভাষায় সমান স্বচ্ছন্দ মানুষরা প্রায় 'বিপন্ন প্রজাতি'-তে পরিণত হয়েছেন, সেই বিষাদ। বিদ্যাচর্চা ক্রমেই কমে আসছে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও, সেই বিষাদ। স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত তিনি? পুরোপুরি মানতে নারাজ রামচন্দ্র গুহ। বললেন, 'আগের সবই ভাল ছিল, আর এখন সবই খারাপ এমন কথা বলিনি কোথাও। কিন্তু এটা তো সত্যিই, এখন আর গভীর বিদ্যাচর্চার সময় নেই কারও। সবাই চটজলদি কথা বলতে ব্যস্ত। মতামত দিতেই সময় কেটে যায়। আমি ঠিক করেছি, নেহাত অনিবার্য না হলে আর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে যাব না। বড্ড সময় নষ্ট হয় ওই সব করতে গিয়ে।'
একুশ বছর আগে এমনই এক শীতে যে শহরে তিনি এসেছিলেন জীবনের কাছে আর একটা নতুন সুযোগের প্রার্থনা নিয়ে, সেই কলকাতাও তো হারিয়ে ফেলছে তার বিদ্যাচর্চার সংস্কৃতি। 'আমি যদি স্মৃতিমেদুর হই, কলকাতা আমার বহু গুণ বেশি স্মৃতিমেদুর। এখনও কলকাতা বিভূতিভূষণ, সত্যজিৎ আর রবিশঙ্করের স্মৃতি নিয়েই বাঁচে। এ দিকে এই শহরের প্রতিষ্ঠানগুলো যে সব একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেটা খেয়ালও করে না। এখন বাঙালিরা কলকাতা ছেড়ে পালায়। আগেও তো কলকাতার বাইরে যেত। কিন্তু ফিরেও আসত। পার্থ চট্টোপাধ্যায় রচেস্টার থেকে পিএইচ ডি করে কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন, রুদ্রাংশ মুখোপাধ্যায় অক্সফোর্ড থেকে ফিরেছিলেন। এখন বাঙালি ছেলেরা আর ফেরে না। কোথায় ফিরবে? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা প্রতিষ্ঠানকে সিপিএম হাতে ধরে নষ্ট করে ফেলল। রুদ্রাংশু ছাড়তে বাধ্য হলেন, শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় নিউজিল্যান্ড চলে গেলেন। অকল্পনীয় অপচয়।'
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় কি হয়ে উঠতে পারে কলকাতার একুশ শতকের বিদ্যাচর্চার প্রাণকেন্দ্র? রামচন্দ্র গুহ আশাবাদী। বললেন, 'এখনও অবধি প্রেসিডেন্সি যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে সম্ভাবনা আছে। বেশি কিছু নয়, জনা পনেরো বিশ্বমানের মেধাবী বাঙালিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর হ্যাঁ, মমতাকে বুঝতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতির আখড়া নয়।' এই আরাবুল-শঙ্কুদেব অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গে তাঁর আশাবাদ নিতান্ত অলীক শোনায় যদিও।
প্রশ্ন করি, আজকের এই ইন্টারনেটের যুগেও বিদ্যাচর্চার জন্য, মেধার ব্যবহারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে কেন? ফেসবুকের মতো স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইট কি তার জায়গা নিতে পারে না? রামচন্দ্র গুহ সংশয়ী। বললেন, 'ইন্টারনেট এসে অনেকগুলো ভাল ব্যাপার হয়েছে ঠিকই কথা বলার জায়গাটা অনেক গণতান্ত্রিক হয়েছে এখন যে কেউ নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সেখানেও মুশকিলটা হল, ভাবার সময় কম। সবাই দ্রুত মতামত দিতে ব্যস্ত। ঠিক এই কারণেই আমি মনে করি, 'অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয়' জিনিসটাই অলীক। হতেই পারে না। বিদ্যাচর্চার জন্য একটা ফিজিকাল স্পেস দরকার, যেখানে লোকে শুনবে, পড়বে, আলোচনা করবে, বুঝবে। কলকাতায় এখনও কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান দ্বীপের মতো টিকে আছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ যেমন।'
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় বলতে তো ছাত্রদেরও বোঝায়। গত দশ-পনেরো বছরে তারাও কি মেধার চর্চা ছেড়ে সরে আসেনি শুধু চাকরির পাখির চোখ বেঁধানোর লক্ষ্যে? জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও তো আজ আর গ্রামশি বুঝতে চায় না কবে কোন বহুজাতিক সংস্থা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে আসবে, তার অপেক্ষায় থাকে। আর রামচন্দ্র নিজেই তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন 'ইন্টারনেট হিন্দু'-দের কথা, যারা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, এবং ইন্টারনেটের পরিসরে নরেন্দ্র মোদী ব্র্যান্ডের 'উন্নয়ন' আর উগ্র হিন্দুত্বের মিশেলের প্রচার চালায় বেঙ্গালুরু বা বস্টন, মুম্বই বা মেলবোর্ন থেকে। এরাই দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা কি আর বিদ্যাচর্চায় আগ্রহী?
'ইন্টারনেট হিন্দু'-দের কথা বলেছি বটে, কিন্তু এটাও সত্যি যে তারা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। নরেন্দ্র মোদী তাদের আরাধ্য উন্নয়নের সঙ্গে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার যে কোনও যোগ নেই, সেটা তারা বুঝতে পারে না। নরেন্দ্র মোদীর আসলে এক ধরনের কর্তৃত্ববাচক ব্যক্তিত্ব আছে, যেটার প্রতি অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা আকৃষ্ট হতে পারে। সেটা চারু মজুমদারেরও ছিল। তাঁকে দেখেই অনেকে নকশালপন্থী হয়ে গিয়েছিল। স্তালিনেরও ছিল, বাল ঠাকরেরও। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী আসলে সারবত্তাহীন। আমার অনুমান, আর দশ বছর পরে কেউ মোদীর নামও উল্লেখ করবে না।' রামচন্দ্র গুহ বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন। এবং প্রায় একই শ্বাসে জানিয়ে রাখলেন, কংগ্রেসের 'রাজবংশ'ও চিরস্থায়ী নয়। আগামী কোনও নির্বাচনে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ধরাশায়ী হলে হয়তো দলের ভিতরেই তৈরি হবে গণতান্ত্রিক বিদ্রোহ। 'রাহুল গাঁধী বা নরেন্দ্র মোদী, কেউই ভারতের ভবিষ্যৎ নন।'
কিন্তু তাঁর কথার পিঠেই আর একটা প্রশ্ন উঠে আসে মোদী থাকুন আর না-ই থাকুন, তরুণদের মধ্যে উগ্র হিন্দুত্ব কি ক্রমেই বাড়বে? তাঁর বই জুড়ে যে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের জন্য আকুতি রয়েছে, সেই ভারত কি সম্ভব? 'অবশ্যই সম্ভব', বললেন রামচন্দ্র। 'যারা উগ্র, তারা উগ্রতার কারণেই অনেক বেশি প্রকাশ্য। কিন্তু ভারতের ওপর তাদের প্রভাব এখনও প্রান্তিক। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ, অন্তত অপর ধর্মের প্রতি সহনশীল। তাদের ছাপিয়ে উগ্রদের মতামতই প্রধান হয়ে দাঁড়াবে, সেই সম্ভাবনা কম।'
আনন্দবাজার পত্রিকা
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। 'পঞ্চায়েত' শব্দটির উৎপত্তি পঞ্চ বা পাঁচ থেকে।প্রাচীন ভারতে পাঁচজন সদস্য নিয়ে যে স্বশাসিত স্বনির্ভর গ্রামীণ পরিষদ গঠিত হত, তাকেই বলা হত পঞ্চায়েত। আধুনিককালে এই শব্দটির সঙ্গে যুক্ত হয় এক সমষ্টিগত চেতনা। 'পঞ্চায়েত' শব্দটির লোকপ্রচলিত অর্থ হয়ে দাঁড়ায় 'পাঁচ জনের জন্য'। সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর বর্তমানে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের তৃতীয় স্তরের সরকার। বর্তমানে গ্রামবাংলাকে কেন্দ্র করে যে প্রশাসনিক, জনকল্যাণমূলক, বিচারবিভাগীয় ও প্রতিনিধিত্বমূলক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত, তাকেই পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নামে অভিহিত করা হয়। ১৮৭০ সালে প্রথম বঙ্গীয় গ্রাম চৌকিদারি আইনের মাধ্যমে আধুনিক গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর গণতান্ত্রিক ভারতে এই ব্যবস্থা তৃণমূলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন পাস হয় ও সংবিধান সংশোধন করা হয়। ১৯৫৭ সালে সর্বপ্রথম পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত আইন বিধিবদ্ধ হয়। ১৯৫৭ ও১৯৬৩ সালের আইন অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। এরপর ১৯৭৩ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে চালু হয় ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। ১৯৯১ সালে ভারতীয় সংবিধানের ৭২তম সংশোধনী অনুসারে ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত আইনটিকেও পুনরায় সংশোধিত করা হয়।
পরিচ্ছেদসমূহ[আড়ালে রাখো] |
[সম্পাদনা]ইতিহাস
প্রাচীন ভারতের গ্রামীণ শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি ছিল পাঁচজন নির্বাচিত বা মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠান পঞ্চায়েত। এই প্রতিষ্ঠানের হাতে ন্যস্ত ছিল গ্রামগুলির প্রশাসন, আইন প্রণয়ণ ক্ষমতা ও বিচারব্যবস্থা পরিচালনের দায়িত্ব। মুঘল আমল পর্যন্ত ভারতের গ্রামগুলি এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হত। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাটি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের এই সুমহান ঐতিহ্যশালী শাসনব্যবস্থার সম্পূর্ণ অবসান ঘটে। তার বদলে ভারতের রাজশক্তি নিজ কায়েমি স্বার্থ টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে ভারতের গ্রাম ও নগরাঞ্চলে ব্রিটিশ ধাঁচের এক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। আধুনিক 'পঞ্চায়েতি রাজ' শাসনব্যবস্থা মহাত্মা গান্ধীর মস্তিষ্কপ্রসূত এক ধারণা। তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠুক গ্রামকে কেন্দ্র করে। স্বাধীনতার পরে মূলত তাঁর আদর্শ অনুসরণ করেই ভারতে গ্রামোন্নয়ন ও পঞ্চায়েত শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এর পরে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ব্যবস্থাকে আধুনিক যুগের উপযোগী ও আরও বেশি কার্যকরী করে তোলার জন্য ভারতে ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপ গৃহীত হয়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের রাজত্বকালে (১৯৭৭-বর্তমান) পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধিত হয়। মনে করা হয়ে থাকে, এই সরকারের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য পঞ্চায়েত সংস্কার ও এই ব্যবস্থা থেকে প্রাপ্ত সুফলগুলি অনেকাংশে দায়ী। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ডক্টর অশোক মিত্রের উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য, "...যদি পঞ্চায়েত ব্যর্থ হয়, সিপিআই(এম)-এর পরীক্ষানিরীক্ষাও ব্যর্থ হবে।" [১]
[সম্পাদনা]ব্রিটিশ যুগ
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। এর ১০৫ বছর পর ১৮৭০ সালে বঙ্গীয় গ্রাম চৌকিদারি আইন বা বেঙ্গল ভিলেজ চৌকিদারি অ্যাক্ট পাস হয়। এই আইন অনুসারে গ্রামাঞ্চলের অপরাধ দমনের লক্ষ্যে বাংলার গ্রামাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসাবে চৌকিদারি পঞ্চায়েত নামে একটি কৃত্রিম সংস্থা চালু হয়। জেলাশাসক এই সংস্থার সদস্যদের নিয়োগ করতেন আর গ্রামবাসীদের কাছ থেকে আদায় করা করে এর কাজকর্ম সম্পাদিত হত। বৃহত্তর গ্রামোন্নয়নের সঙ্গে এর প্রত্যক্ষ কোনও যোগাযোগ ছিল না।
লর্ড রিপন (দপ্তরকাল ১৮৮০-৮৪) প্রথম ভাইসরয় যিনি ভারতে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী হন। এই ব্যবস্থাকে 'রাজনৈতিক ও জনশিক্ষার হাতিয়ার' আখ্যা দিয়ে তিনি এর একটি বিস্তারিত রূপরেখা রচনা করেন। ১৮৮২ সালে এই ব্যাপারে রিপনের প্রস্তাব গৃহীতও হয়। ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ সরকার দেশে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করেন। পাস হয় বঙ্গীয় স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন আইন বা বেঙ্গল সেল্ফ-গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট। এই আইনবলে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের তিনটি সংস্থা কার্যকর হয় – গ্রাম স্তরে ইউনিয়ন কমিটি, মহকুমা স্তরে স্থানীয় পরিষদ এবং জেলা স্তরে জেলা বোর্ড।
এক বা একাধিক গ্রামের জন্য ইউনিয়ন কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির হাতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বিদ্যালয়, পুকুর ও রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয়। অর্থের জন্য এই কমিটিগুলি জেলাবোর্ডের উপর নির্ভরশীল থাকত ও বোর্ডের অধীনেই নিজের কাজ সম্পাদনা করত। এই ব্যবস্থার ফলে গ্রাম স্তরে দুটি প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে – চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি।
মহকুমা স্তরে গঠিত স্থানীয় পরিষদেরও কোনও স্বতন্ত্র ক্ষমতা বা আয় ছিল না এবং এই সংস্থাও সর্ব ব্যাপারে জেলা বোর্ডের উপরেই নির্ভরশীল থাকত। জেলা বোর্ড এদের হাতে কোনও ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব অর্পণ করলে, তবেই তারা তা প্রয়োগ করতে সমর্থ হত। তাই বলা যেতে পারে এই পরিষদগুলি জেলা বোর্ডের কমিটি হিসাবেও কাজ করত। [২] ১৯৩৬ সালে একটি আইন সংশোধনী বলে স্থানীয় পরিষদ বিলুপ্ত করা হয়।
প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা বোর্ড গঠিত হয়। বোর্ডের কার্যক্ষেত্র হয় জেলার সমগ্র গ্রামাঞ্চল। চার বছরের মেয়াদকালযুক্ত এই বোর্ডগুলি নয় থেকে ছত্রিশ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হত এবং এর সদস্যরা সকলেই নির্বাচিত হতেন। সদস্যদের মধ্য থেকে একজন সভাপতি ও একজন সহসভাপতি নির্বাচিত হতেন। এই জেলা বোর্ডগুলির হাতে বহু দায়িত্ব ন্যস্ত থাকত। এদের প্রধান কাজ ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যাতায়াত ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ। জেলা বোর্ডগুলির আয়ের উৎসও ছিল বিভিন্ন। আয়ের প্রধান উৎস ছিল পথ, সেতু, খেয়াঘাট, ডাকবাংলো, খোঁয়াড় প্রভৃতি থেকে প্রাপ্ত কর। সরকারি অনুদানও বোর্ডগুলি পেত। এছাড়া সাধারণের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষমতাও তাদের দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনোত্তর কালে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রবর্তনের আগে অবধি এই বোর্ডগুলি কাজ করে গিয়েছে।
১৮৯৯ সালে লর্ড কার্জন ভারতের ভাইসরয় পদে অভিষিক্ত হলে তিনি শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ ঘটান। কার্জন ভারতবাসীর স্বাধিকারের তীব্র বিরোধী ছিলেন এবং ভারতবাসীকে তিনি আদৌ গণতন্ত্রের উপযুক্ত বলে মনে করতেন না; তা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মতো যত সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই হোক না কেন। তাঁর প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীকরণ রোধ করার জন্য লর্ড মর্লি ১৯০৭ সালে রাজকীয় বিকেন্দ্রীকরণ কমিশন বা রয়্যাল কমিশন অন ডিসেন্ট্রালাইজেশন গঠন করেন। ১৯০৯ সালে এই কমিশন তার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে চৌকিদারি ও অন্যান্য স্থানীয় কাজের দায়িত্ব একটি একক গ্রামীণ সংস্থার হাতে অর্পণ করার প্রস্তাব রাখা হয় এবং বলা হয় এক-একটি গ্রামকে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি করতে না পারলে এই শাসনব্যবস্থায় গ্রামবাসীদের আগ্রহ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।
এরপর ১৯১৪ সালে তদনীন্তন বাংলা সরকার একটি জেলা প্রশাসন কমিটি বা ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি সুপারিশ করেন গ্রামাঞ্চলে এমন এক শাসন কর্তৃপক্ষ গড়ে তুলতে যার মধ্যে একাধারে ইউনিয়ন কমিটি ও চৌকিদারি পঞ্চায়েতের কাজ করবে এবং একটি গ্রামীণ বিচারব্যবস্থাও তার অন্তর্ভুক্ত হবে। মূলত এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯১৯ সালে পাস হয় বঙ্গীয় গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন আইন বা বেঙ্গল ভিলেজ সেল্ফ-গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট। এই আইনবলে চৌকিদারি পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি অবলুপ্ত করা হয় এবং উভয়ের ক্ষমতা একাধিক গ্রাম নিয়ে গঠিত ইউনিয়ন বোর্ডের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এই বোর্ডগুলি গ্রামবাসীদের প্রয়োজনে নিজ নিজ এলাকায় কর ধার্য করার ক্ষমতা রাখত। এছাড়া এই আইনের ছোটোখাটো দেওয়ানি মামলা বিচারের জন্য ইউনিয়ন কোর্ট ও ছোটোখাটো ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য ইউনিয়ন বেঞ্চও গঠন করা হয়। এই বিচারব্যবস্থার বিচারকগণও ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্যদের মধ্য থেকেই নিযুক্ত হতেন।
তবে এইসব ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ডের কাজকর্ম প্রাথমিক শিক্ষা, জল সরবরাহ, সড়ক ও সেতু নির্মান এবং জনস্বাস্থ্যরক্ষা মতো কাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থ ও কর্মীর অভাবে এগুলির দ্বারা গ্রামীণ জীবনের ন্যূনতম চাহিদাগুলি পূরণ করা সম্ভব হত না। যদিও গ্রামবাংলার জনসাধারণকে ভাবী গণতন্ত্রের পথে অনেকটাই শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল এগুলি।
[সম্পাদনা]স্বাধীনোত্তর কাল - 'প্রথম প্রজন্ম' (১৯৪৭-১৯৭৭)
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয় ও দেশের সংবিধান রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু খসড়া সংবিধানে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি যথোচিত গুরুত্ব না পাওয়ায় গান্ধীজি মনোক্ষুণ্ণ হন। তিনি চেয়েছিলেন, ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা হবে গ্রামকেন্দ্রিক আর তাই গ্রাম ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করবে। বস্তুত, আধুনিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল ধারণাটি তিনিই প্রথম ভারতবাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। এরপর সংবিধানের ৪০ নং ধারায় উল্লেখ করা হয়ঃ রাজ্য গ্রাম পঞ্চায়েত গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং পঞ্চায়েতগুলি যাতে স্বায়ত্তশাসনের ইউনিট হিসাবে কাজ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের হাতে অর্পণ করবে। [৩] কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার, ভারতের সংবিধান প্রণেতাগণ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে ভারতের প্রশাসনিক কাঠামোটি গড়ে তোলেননি। তাই পঞ্চায়েতের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মিললেও এই ধারাটি নির্দেশমূলক নীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর বাস্তবায়নে রাজ্য বা কেন্দ্র কেউই বাধ্য ছিল না।
তবে এই নির্দেশ অনুসরণ করে ভারতের কোনও কোনও রাজ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গেও পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়বারুইপুর, মহম্মদবাজার, সাঁইথিয়া, নলহাটি, শক্তিগড়, গুসকরা, ঝাড়গ্রাম ও ফুলিয়া ব্লক এলাকায়। পরীক্ষামূলক পঞ্চায়েতে কোনও আইনগত সংস্থা না থাকায় এগুলির কাজ চলতে থাকে ইউনিয়ন বোর্ডের অধীনেই। গ্রামবাসীরা এক জায়গায় মিলিত হয়ে হাত তুলে ভোট দিয়ে সদস্য নির্বাচন করতেন ও কার্যালয়ের ব্যয় ও গ্রামোন্নয়ন বাবদ পঞ্চায়েতগুলিকে ১০০ টাকা করে দেওয়া হত। কাজ হত গ্রামবাসীদের দান আর কায়িক শ্রমে।
১৯৫৭ সালে প্রকাশিত বলবন্তরাই মেহতা কমিটির সুপারিশক্রমে ভারতের সব রাজ্যেই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গে ১৯১৯ সাল থেকে প্রচলিত ইউনিয়ন বোর্ডকে বাদ দিয়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করা সম্ভবপর ছিল না। সেই কারণে এ রাজ্যে চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৫৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন বা ওয়েস্ট বেঙ্গল পঞ্চায়েত অ্যাক্টের মাধ্যমে চালু হয় দ্বিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় গ্রাম স্তরে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পুরনো ইউনিয়ন বোর্ড স্তরে অঞ্চল পঞ্চায়েত গঠিত হয়। ১৯৫৮ সালে এই আইন অনুসারে প্রথম নির্বাচন হয়। এরপর ১৯৬৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ জেলা পরিষদ আইন বা ওয়েস্ট বেঙ্গল জিলা পরিষদ অ্যাক্টের মাধ্যমে ১৯৬৪ সালে ব্লক স্তরে আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা স্তরে জেলা পরিষদ গঠিত হয়। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামোন্নয়নে স্থানীয় নির্বাচিত সংস্থাকে যুক্ত করা এবং উন্নয়ন ও পরিকল্পনার কাজে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা। এইভাবে গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গের চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাঃ
- চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা –
- গ্রাম পঞ্চায়েত – এক বা একাধিক গ্রাম নিয়ে গঠিত হত গ্রাম পঞ্চায়েত। প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য সংখ্যা ছিল ৯ থেকে ১৫। এঁরা সকলেই এলাকার ভোটদাতাদের দ্বারা চার বছরের জন্য নিযুক্ত হতেন। নির্বাচিত সদস্যবর্গ নিজেদের মধ্যে থেকে একজন অধ্যক্ষ ও একজন উপাধ্যক্ষকে নির্বাচন করতেন। সরকার মনোনীত সদস্যরা অবশ্য এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষের দপ্তরের মেয়াদ ছিল চার বছর। গ্রাম পঞ্চায়েতের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের গৃহীত প্রস্তাববলে এঁদের অপসারিত করা যেত। অধ্যক্ষই ছিলেন পঞ্চায়েতের মুখ্য কার্যনির্বাহী। পঞ্চায়েতের কাজকর্মের সকল দিকেই তাঁকে নজর রাখতে হত। এছাড়াও গ্রাম পঞ্চায়েতের সভায় তাঁকেই সভাপতিত্ব করতে হত।
গ্রাম পঞ্চায়েত এক্তিয়ারভুক্ত এলাকার বাসিন্দাদের নিয়ে গ্রাম সভা গঠিত হত। গ্রাম সভার বৈঠক বসত বছরে দু-বার। অধ্যক্ষ এই বৈঠকগুলিতে সভাপতিত্ব করতেন। সাধারণ বাৎসরিক বৈঠকে পরবর্তী বছরের ব্যয়বরাদ্দ ও পূর্ববর্তী বছরের কাজের প্রতিবেদন বিবেচনা করা হত। গ্রাম সভা গ্রাম পঞ্চায়েতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা ভোগ করত, কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না।
গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষমতা ও কার্যাবলি ছিল তিন ধরনের – বাধ্যতামূলক, অর্পিত ও ঐচ্ছিক। মূলত পৌর দায়িত্বসংক্রান্ত কাজগুলি ছিল বাধ্যতামূলক কাজ ও উন্নয়ন ও পল্লি পুনর্গঠন সংক্রান্ত কাজগুলি অর্পিত ও স্বেচ্ছাধীন ও অর্পিত কাজের মধ্যে পড়ত।
তবে গ্রাম পঞ্চায়েতের নিজস্ব আয়ের কোনও উৎস ছিল না। এই ব্যাপারে তাদের নির্ভর করতে হত অঞ্চল পঞ্চায়েতের অনুদানের উপর। এছাড়াও নিজস্ব কোনও কর্মচারীও এদের ছিল না। অধ্যক্ষকেই সব দায়দায়িত্ব বহন করতে হত। - অঞ্চল পঞ্চায়েত – অঞ্চল পঞ্চায়েত গঠিত হত কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে। মূল আইনবলে এই পঞ্চায়েতের সদস্যগণ গ্রাম সভা কর্তৃক নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হত। পরবর্তীকালে দুই প্রকার সদস্য নিয়ে অঞ্চল পঞ্চায়েত গঠিত হতে থাকে – (১) অঞ্চল পঞ্চায়েতের অধীন গ্রাম পঞ্চায়েতের অধ্যক্ষগণ ও (২) গ্রাম পঞ্চায়েতের এলাকা থেকে নির্বাচিত সদস্যগণ। অঞ্চল পঞ্চায়েতগুলি প্রথম বৈঠকে একজন প্রধান ও একজন উপপ্রধান নির্বাচিত করে নিত। অঞ্চল পঞ্চায়েত, প্রধান ও উপপ্রধানের দপ্তরের মেয়াদকাল ছিল চার বছর। এছাড়াও অঞ্চল পঞ্চায়েতে একজন সচিব থাকতেন; যিনি প্রধানকে পঞ্চায়েতের কাজকর্ম ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন ও সহায়তা করতেন। আর থাকতেন কয়েকজন চৌকিদার ও দফাদার।
অঞ্চল পঞ্চায়েত মূলত এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিল। এজন্য দফাদার ও চৌকিদারকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা অঞ্চল পঞ্চায়েতের হাতেই অর্পণ করা হয়েছিল। এছাড়াও ন্যায় পঞ্চায়েত গঠন, কর ধার্য ও সংগ্রহ করাও অঞ্চল পঞ্চায়েতের অন্যতম কাজ ছিল।
অঞ্চল পঞ্চায়েতের আয়ের মূল উৎস ছিল কর, অভিকর ও মাশুল। এছাড়া এরা কিছু সরকারি অনুদানও পেত। তবে অঞ্চল পঞ্চায়েতের আয় এতই কম ছিল যে নিজেদের ব্যয় বহনের পর গ্রাম পঞ্চায়েতকে উন্নয়নকাজের অনুদান হিসাবে দেবার মতো খুব কম টাকাই তাদের হাতে থাকত। - আঞ্চলিক পরিষদ – প্রত্যেকটি সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক এলাকায় একটি করে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদে সরাসরি নির্বাচিত কোনও সদস্য ছিলেন না। পরোক্ষভাবে নির্বাচিত সদস্য, পদাধিকার বলে সদস্য ও একজন সহযোগী সদস্য নিয়ে এই পরিষদ গঠিত হত। স্থানীয় সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক বা ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার (বিডিও) হতেন সহযোগী সদস্য। অন্যান্যরা ছিলেন – (১) সংশ্লিষ্ট অঞ্চল পঞ্চায়েতের প্রধানগণ (এঁরা পদাধিকার বলে সদস্য হতেন); (২) প্রত্যেক অঞ্চল পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত অধ্যক্ষদের মধ্য থেকে নির্বাচিত একজন অধ্যক্ষ; (৩) এলাকা থেকে নির্বাচিত অথচ মন্ত্রী নন এমন সাংসদ ও বিধায়ক এবং এলাকায় বসবাস করেন অথচ মন্ত্রী নন এমন রাজ্যসভা ও বিধান পরিষদের সদস্য; (৪) রাজ্য সরকার মনোনীত দুজন মহিলা ও দুজন অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্য; (৫) আঞ্চলিক পরিষদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত দুজন সমাজসেবী ও গ্রামোন্নয়ন ব্যাপারে অভিজ্ঞ ব্যক্তি।
আঞ্চলিক পরিষদগুলিতে একজন সভাপতি ও একজন সহকারী সভাপতি পরিষদ সদস্যদের দ্বারা চার বছরের জন্য নির্বাচিত হতেন। স্থানীয় বিডিও পদাধিকার বলে পরিষদের কার্যনির্বাহী আধিকারিকের কাজ করতেন। কয়েকটি স্থায়ী সমিতির মাধ্যমে পরিষদ তার কার্য সম্পাদনা করত।
আঞ্চলিক পরিষদের প্রধান কাজগুলি ছিল প্রধানত সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণমূলক। কিছু কৃষি, সমবায়, জল সরবরাহ, জনস্বাস্থ্য ও অপরাপর কিছু জনকল্যাণমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও অর্থ সাহায্যদানের ক্ষমতা পরিষদগুলিকে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও অঞ্চল পঞ্চায়েতগুলির বাজেট অনুমোদন করত আঞ্চলিক পরিষদগুলি।
নিজস্ব আয়ের সূত্র থাকলেও কোনও আঞ্চলিক পরিষদই সেগুলি ব্যবহার করত না; ফলে এই পরিষদগুলি রাজ্য সরকার ও জেলা পরিষদের অনুদানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। - জেলা পরিষদ – পূর্বতন জেলা বোর্ড বাতিল করে গঠিত হয় জেলা পরিষদ। একমাত্র কোচবিহার জেলায় কোনও জেলা বোর্ড না থাকায় সেখানে নতুন করে জেলা পরিষদ গঠন করা হয়।
এই জেলা পরিষদ সদস্য ও সহযোগী সদস্য নিয়ে চার বছরের জন্য গঠিত হত। সহযোগী সদস্যদের মধ্যে থাকতেন মহকুমা শাসক, জেলা পঞ্চায়েত আধিকারিক প্রমুখ সরকারি প্রশাসক ও কর্মচারী আর সদস্যদের মধ্যে থাকতেন – (১) আঞ্চলিক পরিষদের সভাপতিগণ (এঁরা পদাধিকার বলে সদস্য হতেন); (২) প্রত্যেক মহকুমা থেকে অধ্যক্ষদের দ্বারা নির্বাচিত দু-জন সদস্য; (৩) জেলায় বসবাসকারী অথবা জেলা থেকে নির্বাচিত অথচ মন্ত্রী নন এমন সাংসদ ও বিধায়ক; (৪) সরকার মনোনীত পুরসভা বা পৌরসংস্থার চেয়ারম্যান বা মেয়র; (৫) জেলা স্কুল বোর্ডের সভাপতি এবং (৬) সরকার মনোনীত অনধিক দু-জন মহিলা।
জেলা পরিষদের প্রথম সভায় একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস-চেয়ারম্যানকে নির্বাচিত করা হত। চেয়ারম্যানের উপর ন্যস্ত থাকত আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার দায়িত্ব। তবে পরিষদের নীতি ও প্রস্তাবগুলি রূপায়ণের দায়িত্ব অর্পিত ছিল একটি প্রশাসনিক যন্ত্রের উপর; যার শীর্ষে থাকতেন কার্যনির্বাহী আধিকারিক। এছাড়াও পরিষদের সচিবের দায়িত্ব সামলাতেন অপর একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক। এঁরা দুজনেই পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসনিক কৃত্যক বা ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস (ডাবলিউবিসিএস)-এর সদস্য ছিলেন।
জেলা পরিষদের প্রধান কাজ ছিল উন্নয়নমূলক। অন্যান্য কাজের মধ্যে ছিল আঞ্চলিক পরিষদের বাজেট অনুমোদন এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিষদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলির সমন্বয় সাধন।
- গ্রাম পঞ্চায়েত – এক বা একাধিক গ্রাম নিয়ে গঠিত হত গ্রাম পঞ্চায়েত। প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য সংখ্যা ছিল ৯ থেকে ১৫। এঁরা সকলেই এলাকার ভোটদাতাদের দ্বারা চার বছরের জন্য নিযুক্ত হতেন। নির্বাচিত সদস্যবর্গ নিজেদের মধ্যে থেকে একজন অধ্যক্ষ ও একজন উপাধ্যক্ষকে নির্বাচন করতেন। সরকার মনোনীত সদস্যরা অবশ্য এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারতেন না। অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষের দপ্তরের মেয়াদ ছিল চার বছর। গ্রাম পঞ্চায়েতের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের গৃহীত প্রস্তাববলে এঁদের অপসারিত করা যেত। অধ্যক্ষই ছিলেন পঞ্চায়েতের মুখ্য কার্যনির্বাহী। পঞ্চায়েতের কাজকর্মের সকল দিকেই তাঁকে নজর রাখতে হত। এছাড়াও গ্রাম পঞ্চায়েতের সভায় তাঁকেই সভাপতিত্ব করতে হত।
চার-স্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় গ্রামোন্নয়নের মূল দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে ন্যস্ত থাকলেও সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি দুর্বলই থেকে যায় এবং স্বভাবতই এদের কাজকর্ম অবহেলিত হতে থাকে। পূর্বতন ইউনিয়ন বোর্ডের যেসব কাজ ছিল অঞ্চল পঞ্চায়েতকে তার চেয়ে বেশি কাজ করতে হত না। বরং উন্নয়নমূলক কাজকর্মের হাত থেকে অঞ্চল পঞ্চায়েতগুলি রেহাই পেয়েছিল। বাস্তব ক্ষেত্রে গ্রাম ও অঞ্চল পঞ্চায়েত চালাবার মতো দক্ষ কর্মীর অভাবে ভুগছিল বাংলার গ্রামাঞ্চল। তা সত্ত্বেও ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা চালু হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গে। সরকার এদের হাতে কিছু প্রকল্পও অর্জন করেন। কিন্তু ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে সেসব প্রকল্প প্রত্যাহার করে নেন। এদিকে প্রথম নির্বাচনের পর আর নির্বাচন না হওয়ায় পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলিও নিষ্ক্রিয় ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে পঞ্চায়েত সংক্রান্ত আইনদুটি প্রণীত হওয়ায় পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। [৪]
এই কারণে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে পাস হয় পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন বা ওয়েস্ট বেঙ্গল পঞ্চায়েত অ্যাক্ট। এই আইনবলে চার-স্তর পঞ্চায়েতের পরিবর্তে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত প্রবর্তিত হয় – পূর্বতন অঞ্চল পঞ্চায়েত স্তরে গ্রাম পঞ্চায়েত, ব্লক স্তরে পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা স্তরে জেলা পরিষদ।
[সম্পাদনা]বামফ্রন্ট আমল - 'দ্বিতীয় প্রজন্ম' (১৯৭৭-বর্তমানকাল)
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এলে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষেত্রে বিপ্লব সূচিত হয়। ১৯৭৩ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবার পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন সংশোধিত করা হয়। এই আইন অনুসারে ১৯৭৮ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গের নবগঠিত ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতে এই প্রথমবার দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে একই দিনে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরে নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনের ফলে ১৫টি জেলা পরিষদ, ৩২৪টি পঞ্চায়েত সমিতি ও ৩২৪২টি গ্রাম পঞ্চায়েত গঠিত হয়। ১৯৮৮ সালে দার্জিলিং জেলার পার্বত্য মহকুমাগুলিতে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল হওয়ায় ওই জেলার জেলা পরিষদ অবলুপ্ত হয়। তার পরিবর্তে শিলিগুড়ি মহকুমায় একটি মহকুমা পরিষদ গঠিত হয়, যা একটি স্বতন্ত্র জেলা পরিষদের ক্ষমতা ও মর্যাদা ভোগ করে। ১৯৭৮ সাল থেকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নিয়ম করে পঞ্চায়েতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০০৮ সালে।
অধ্যাপক প্রভাত দত্ত পশ্চিমবঙ্গের এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে 'দ্বিতীয় প্রজন্মের পঞ্চায়েত' আখ্যা দিয়েছেন। [৫] এই পঞ্চায়েত সংস্কার ও নিয়মিত নির্বাচন ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটিকে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করে তোলে। এর ফলে ব্যাপক হারে জনসাধারণ সরকারি কাজে অংশগ্রহণের সুবিধা অর্জন করে। ফলে তাদের মধ্যে উৎসাহ ও সাহস অনেক বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপক অমলকুমার মুখোপাধ্যায়ের মূল্যায়নে, "সাধারণ গ্রামবাসীরা আর সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কাছে দাক্ষিণ্য প্রার্থনা করতে যান না, বরং যান যা তাঁদের প্রাপ্য তার দাবি নিয়ে। নয়া গণতন্ত্রে মানুষের রাজনৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি কম গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব নয়।" [৬]
[সম্পাদনা]গঠন
বর্তমান পঞ্চায়েত আইন অনুসারে ১৯৭৮ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু আছে, তার তিনটি স্তর হল – গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে গ্রাম স্তরে। এই 'গ্রাম' শব্দটি প্রচলিত গ্রামের ধারণার থেকে একটু আলাদা। সরকারিভাবে, গ্রাম বলতে বোঝায় কোনও মৌজা বা মৌজার অংশ অথবা পাশাপাশি অবস্থিত কয়েকটি মৌজা। সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতের এলাকা নির্ধারণ করে দেন। সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক স্তরে গঠিত হয় পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা স্তরে জেলা পরিষদ।
[সম্পাদনা]গ্রাম পঞ্চায়েত
গ্রাম পঞ্চায়েত পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সর্বনিম্ন স্তর। একটি গ্রাম পঞ্চায়েত গঠন করার জন্য রাজ্য সরকার কোনও একটি মৌজা, বা তার অংশবিশেষ, বা তার সংলগ্ন একাধিক মৌজা, বা তার অংশবিশেষকে 'গ্রাম' ঘোষণা করে থাকেন। প্রত্যেক গ্রামের নামে গ্রাম পঞ্চায়েতের নামকরণ হয়ে থাকে। ১৯৯২ সালের পঞ্চায়েত আইনের সংশোধনী অনুসারে পূর্বতন অঞ্চল পঞ্চায়েতের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকাকেই গ্রাম পঞ্চায়েতের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা বলে ঘোষিত হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি প্রতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। এগুলি এক-একটি নিগমবদ্ধ সংস্থা বা কর্পোরেট বডি হিসাবে কাজ করে, যাদের একটি করে সাধারণ সিল থাকে এবং এরা মামলা করতে পারেন বা এদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে।
- সদস্য – গ্রাম পঞ্চায়েত গঠিত হয় দু-ধরনের সদস্য নিয়ে – নির্বাচিত ও পদাধিকার বলে সদস্য। গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্যসংখ্যা ন্যূনতম পাঁচ ও সর্বাধিক ৩০। নির্বাচিত সদস্যগণ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আইনসম্মত নির্বাচক বা ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হন। এছাড়া পদাধিকার বলে সদস্যদের মধ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকে পঞ্চায়েত সমিতিতে নির্বাচিত হয়েছেন অথচ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বা সহকারী সভাপতি নন এমন সদস্যগণ।
নির্বাচনের সুবিধার জন্য প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাকে কয়েকটি নির্বাচনক্ষেত্রে বিভক্ত করা হয়েছে। সাধারণত প্রতি ৫০০ ভোটদাতা পিছু একজন সদস্য ও ৫০০-এর বেশি ভোটদাতা হলে অতিরিক্ত একজন সদস্য গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হন। পার্বত্য এলাকায় অবশ্য প্রতি ১০০ ভোটদাতা পিছু একজন সদস্য ও ১০০-এর বেশি ভোটদাতা হলে একজন অতিরিক্ত সদস্য নির্বাচত হয়ে থাকেন।
এছাড়াও ১৯৯২ সালের সংশোধনীতে বলা হয়েছে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে। তাছাড়া তফশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষিত আসনের ১/৩ ভাগ আসন তফশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য এবং সর্বমোট আসনের ১/৩ ভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অসংরক্ষিত আসনগুলিতেও তফশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলারা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করতে পারবেন। - প্রধান ও উপ-প্রধান – গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রথম সভায় সদস্যগণ নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে প্রধান ও একজনকে উপ-প্রধান নির্বাচিত করেন। এই ভোটাভুটি হয় গোপন ব্যালটে। এঁদের উভয়ের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। পঞ্চায়েত সমিতি সদস্য এমন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যরা অবশ্য এই দুই পদের জন্য প্রার্থী হতে পারেন না।
জেলায় অবস্থিত প্রধান ও উপ-প্রধানের পদগুলি তফশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলা জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত এবং সংরক্ষিত আসনের ২/৩ অংশ আবার ওই সম্প্রদায়গুলির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। তাছাড়া সর্বমোট প্রধান ও উপ-প্রধান পদের ১/৩ অংশ আবার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
প্রধান বা উপ-প্রধান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন অথবা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধিকাংশ সদস্য প্রস্তাব গ্রহণ করে তাঁদের অপসারিত করতে পারেন। রাজ্য সরকারও নির্দিষ্ট কারণে কোনও প্রধান বা উপ-প্রধানকে অপসারিত করার ক্ষমতা রাখেন। প্রধান বা উপ-প্রধান পদচ্যূত হলে, পদত্যাগ করলে বা মারা গেলে যদি ওই পদদুটি শূন্য হয়, তবে গ্রাম পঞ্চায়েত নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে নতুন প্রধান বা উপ-প্রধান নির্বাচিত করেন; যিনি পূর্ববর্তী প্রধান বা উপ-প্রধানের অবশিষ্ট কার্যকাল পর্যন্ত দপ্তরে অধিষ্ঠিত থাকেন। - সদস্যপদের অযোগ্যতা ও সীমাবদ্ধতা – কোনও ব্যক্তি একই সঙ্গে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের নির্বাচন প্রার্থী হতে পারেন না। সরকারি বা পঞ্চায়েতি সংস্থার কর্মচারী, পঞ্চায়েতের ঠিকাদারের কর্মচারী, দেউলিয়া, অপ্রকৃতিস্থ, পঞ্চায়েতের বকেয়া কর বাকি আছে যার এমন কেউ, একুশ বছর বয়স হয়নি এমন কেউ, দণ্ডপ্রাপ্ত প্রধান বা উপ-প্রধান, অডিটর প্রদত্ত নির্দেশ অমান্য করার কারণে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং রাজ্য সরকার দ্বারা অপসৃত পঞ্চায়েতের যেকোনও স্তরের চেয়ারপার্সন গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন না। গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য হওয়ার পরে কোনও ব্যক্তিকে গ্রাম পঞ্চায়েত বা ভোটদাতারা অপসারিত করতে পারেন না। একমাত্র মহকুমা শাসকই এই কাজ করতে পারেন। তাছাড়া দলীয় ভিত্তিতে পঞ্চায়েতের নির্বাচন হয়ে থাকে বলে রাজনৈতিক দল পরিবর্তন করলে সদস্যপদের অযোগ্যতা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও কোনও ব্যক্তি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন।
- গ্রাম পঞ্চায়েতের সভা – প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে মাসে একবার সভা অনুষ্ঠিত হয়। তিনজন সদস্য সাপেক্ষে মোট সদস্যসংখ্যার ১/৩ অংশ উপস্থিত থাকলেই সভা করা যায়। মুলতুবি বৈঠকের জন্য কোনও কোরামের প্রয়োজন হয় না। প্রধান বা তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-প্রধান এই সভার সভাপতিত্ব করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সভায় উত্থাপিত সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা হয়। তবে সমসংখ্যক ভোট পড়লে সভাপতি দ্বিতীয় বা মীমাংসাসূচক ভোটদান করতে পারেন।
[সম্পাদনা]গ্রাম সংসদ
গ্রাম পঞ্চায়েতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গ্রামবাংলার তৃণমূল স্তরে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় যে দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হল গ্রাম সংসদ। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যেক নির্বাচনক্ষেত্রে একটি করে গ্রাম সংসদ আছে। এই গ্রাম সংসদগুলি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটারতালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। সংসদের দুটি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় – ষান্মাসিক ও বাৎসরিক। গ্রাম সংসদের সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান, উপ-প্রধান অথবা সংসদক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত সদস্যরা। সদস্যসংখ্যার ১/১০ অংশ উপস্থিত থাকলেই সভার কোরাম হয়। তবে মুলতুবি সভার জন্য কোরাম কোরামের প্রয়োজন পড়ে না।
- কাজ – গ্রাম সংসদের কাজ গ্রাম পঞ্চায়েতকে পরামর্শ দেওয়া ও গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজে সহায়তা করা। এলাকার মধ্যে আর্থিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার সংক্রান্ত গৃহীত বা প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলির সম্পর্কে গ্রাম সংসদ গ্রাম পঞ্চায়েতকে পরামর্শ দিয়ে থাকে। এছাড়া গ্রামের আর্থিক উন্নতির জন্য প্রকল্পের অগ্রাধিকারদান ও উপযুক্ত নীতিগ্রহণ, দারিদ্র-দূরীকরণ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির উপভোক্তা নির্ণয়, সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির আয়ব্যয়ের হিসাব ও অডিটরের প্রতিবেদন আলোচনা, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য গণসমাবেশের আয়োজন, এলাকায় সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠীগত সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ, প্রধান বা অন্যান্য পঞ্চায়েত সদস্যের কাজের বিরুদ্ধে আপত্তি থাকলে তা নথিভুক্তকরণও গ্রাম সংসদের কাজ।
[সম্পাদনা]গ্রাম সভা
গ্রাম পঞ্চায়েতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গ্রামবাংলার তৃণমূল স্তরে সম্প্রসারিত করার লক্ষ্যে গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় যে দুটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে, তার মধ্যে দ্বিতীয় সংগঠনটি হল গ্রাম সভা। সমগ্র গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার জন্য একটি করে গ্রাম সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। পঞ্চায়েত এলাকায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটার তালিকায় নাম আছে এমন সকলেই গ্রাম সভার সদস্য। গ্রাম সভার অধিবেশনও বছরে দু-বার অনুষ্টিত হয় – ষান্মাসিক ও বাৎসরিক। এই অধিবেশনের জন্য মোট সদস্যসংখ্যার ১/২০ অংশ উপস্থিত থাকা আবশ্যক। এখানেও মুলতুবি সভার জন্য কোরামের প্রয়োজন পড়ে না। গ্রাম সভার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান বা উপ-প্রধান।
- কাজ – গ্রাম সভার কাজগুলি হল (১) গ্রাম সংসদগুলির প্রস্তাব বিবেচনা করা; (২) অধিবেশনে উত্থাপিত প্রশ্নগুলি আলোচনা করা ও সেগুলি গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে বিবেচনার জন্য প্রেরণ; (৩) এলাকায় গৃহীত আর্থিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার সংক্রান্ত প্রকল্পগুলি আলোচনা ও এ বিষয়ে সুপারিশ; (৪) প্রকল্পের অগ্রাধিকার নিরূপন; (৫) প্রধান বা অন্য সদস্যের বিরুদ্ধে আনীত নথিভুক্ত অভিযোগগুলির বিবেচনা; (৬) গ্রাম পঞ্চায়েতের আয়ব্যয়ের হিসাব বিবেচনা; (৭) গ্রাম পঞ্চায়েতের অডিটের প্রতিবেদন বিবেচনা; এবং (৮) সভায় উত্থাপিত সকল বিষয় আলোচনা করে গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে প্রেরণ।
[সম্পাদনা]পঞ্চায়েত সমিতি
পঞ্চায়েত সমিতি পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী স্তর। এই স্তর সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক স্তরে গঠিত। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ব্লকের নামানুসারে প্রত্যেক ব্লকে একটি করে পঞ্চায়েত সমিতি গঠন করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে মোট ৩৪১টি ব্লক ও পঞ্চায়েত সমিতি বিদ্যমান। পঞ্চায়েত সমিতিগুলি গ্রাম পঞ্চায়েতের মতোই এক-একটি নিগমবদ্ধ সংস্থা, যার একটি সাধারণ সিল রয়েছে ও যারা মামলা করতে পারে বা যার বিরুদ্ধে মামলা করা যেতে পারে।
- সদস্য – পাঁচ প্রকার সদস্য নিয়ে পঞ্চায়েত সমিতি গঠিত। এঁরা হলেন (১) ব্লকের অন্তর্গত গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানগণ (এঁরা পদাধিকার বলে সদস্য); (২) প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা থেকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত অনধিক তিনজন সদস্য; (৩) ব্লক এলাকা থেকে নির্বাচিত সভাধিপতি বা সহকারী সভাধিপতি নন এমন জেলা পরিষদ সদস্য; (৪) ব্লক এলাকা থেকে নির্বাচিত মন্ত্রী নন এমন লোকসভা বা বিধানসভা সদস্য; এবং (৫) মন্ত্রী নন অথচ ভোটার তালিকায় নাম আছে এমন রাজ্যসভা সদস্য। এঁরা প্রতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তবে সরকারি কর্মচারী বা পঞ্চায়েতের কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্মী বা পুরসভায় চাকুরিরত ব্যক্তিরা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য হতে পারেন না।
এছাড়াও মোট জনসংখ্যার অনুপাতে প্রত্যেক পঞ্চায়েত সমিতিতে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং তফশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষিত আসনের ১/৩ ভাগ আসন তফশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য এবং সর্বমোট আসনের ১/৩ ভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। - সভাপতি ও সহকারী সভাপতি – পঞ্চায়েত সমিতির প্রথম সভায় নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে থেকে একজন সভাপতি ও একজন সহকারী সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁদের দপ্তরের মেয়াদ পাঁচ বছর। তবে সাংসদ, বিধায়ক, গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বা জেলা পরিষদের সদস্য এমন পঞ্চায়েত সমিতি সদস্যরা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করতে পারেন না। এছাড়াও সভাপতি ও সহকারী সভাপতির পদগুলি তফশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলা জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত এবং সংরক্ষিত আসনের ২/৩ অংশ আবার ওই সম্প্রদায়গুলির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। তাছাড়া সর্বমোট সভাপতি ও সহকারী সভাপতি পদের ১/৩ অংশ আবার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
সভাপতি বা সহকারী সভাপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন অথবা পঞ্চায়েত সমিতির অধিকাংশ সদস্য প্রস্তাব গ্রহণ করে তাঁদের অপসারিত করতে পারেন। এছাড়াও রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট কারণে তাঁদের অপসারিত করার ক্ষমতা রাখেন। অপসারণ, পদত্যাগ, মৃত্যু বা অন্য কোনও কারণে তাঁদের পদ শূন্য হলে পঞ্চায়েত সমিতি নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে অপর কাউকে শূন্যপদে অধিষ্ঠিত করতে পারেন। সেক্ষেত্রে নবনিযুক্ত সভাপতি বা সহকারী সভাপতি তাঁর পূর্বতনের অবশিষ্ট মেয়াদকালের জন্য পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। - পঞ্চায়েত সমিতির সভা – প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার পঞ্চায়েত সমিতির সভা ডাকা হয়। এই সভায় মোট সদস্যসংখ্যার ১/৪ অংশের উপস্থিতি প্রয়োজন। তবে মুলতুবি সভার জন্য কোরামের প্রয়োজন হয় না। সভাপতি বা তাঁর অনুপস্থিতিতে সহকারী সভাপতি সভা পরিচালনা করেন। সভাইয় উত্থাপিত প্রশ্নগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুসারে মীমাংসিত হয়। এক্ষেত্রেও সমসংখ্যক ভোট পড়লে তবেই সভাপতি ব্যক্তি মীমাংসক ভোটটি দিতে পারেন।
[সম্পাদনা]জেলা পরিষদ
জেলা পরিষদ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার তৃতীয় তথা সর্বোচ্চ স্তর। জেলা পরিষদের নামকরণ করা হয় সংশ্লিষ্ট জেলার নামানুসারে। কলকাতা ওদার্জিলিং জেলা বাদে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় জেলা পরিষদ বর্তমান। দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমায় জেলা পরিষদের সমক্ষমতা ও মর্যাদা সম্পন্ন একটি মহকুমা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত। পশ্চিমবঙ্গে সেই কারণে বর্তমানে মোট ১৭টি জেলা পরিষদ রয়েছে।
- সদস্য – প্রত্যেক জেলা পরিষদে চার প্রকার সদস্য রয়েছেন। এঁরা হলেন, (১) জেলার অন্তর্গত পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি (এঁরা পদাধিকার বলে সদস্য); (২) জেলার প্রত্যেক ব্লক থেকে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত অনধিক তিনজন সদস্য; (৩) জেলা থেকে নির্বাচিত অথচ মন্ত্রী নন এমন লোকসভা ও বিধানসভা সদস্য; এবং জেলার ভোটারতালিকায় নাম আছে অথচ মন্ত্রী নন এমন রাজ্যসভা সদস্য।
এছাড়া জনসংখ্যার অনুপাতে প্রত্যেক জেলা পরিষদে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষিত থাকে। তাছাড়াও তফশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষিত আসনের ১/৩ ভাগ আসন তফশিলি জাতি ও উপজাতির মহিলাদের জন্য এবং সর্বমোট আসনের ১/৩ ভাগ মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। - সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতি – পঞ্চায়েতের প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচনের পর জেলা পরিষদ সদস্যদের মধ্যে থেকে একজন সভাধিপতি ও একজন সহকারী সভাধিপতি পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। সাংসদ, বিধায়ক, জেলা পরিষদ সদস্য অথচ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি এমন ব্যক্তিরা এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করতে পারেন না। গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির মতোই সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতির পদে তফসিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই পদগুলিতে তফশিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলা জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষিত এবং সংরক্ষিত আসনের ২/৩ অংশ আবার ওই সম্প্রদায়গুলির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। তাছাড়া সর্বমোট সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতি পদের ১/৩ অংশ আবার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন অথবা রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট কারণে কোনও তাঁদের অপসারিত করতে পারেন। সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতি পদচ্যূত হলে, পদত্যাগ করলে বা মারা গেলে যদি ওই পদদুটি শূন্য হয়, তবে পরিষদ নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে নতুন সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতি নির্বাচন করেন এবং তিনি পূর্ববর্তী সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতির অবশিষ্ট কার্যকাল পর্যন্ত দপ্তরে অধিষ্ঠিত থাকেন। - জেলা পরিষদের অধিবেশন – প্রতি তিন মাস অন্তর জেলা পরিষদের অধিবেশন বসে। পরিষদের মোট সদস্যসংখ্যার ১/৪ অংশ অনুপস্থিত থাকলেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারে। এক্ষেত্রেও মুলতুবি বৈঠকের জন্য কোনও কোরামের প্রয়োজন হয় না। সভায় উত্থাপিত সমস্ত সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গৃহীত হয়। উভয় পক্ষের সমসংখ্যক ভোট পড়লে সভাধিপতি নির্ণায়ক বা কাস্টিং ভোট প্রদান করে সমস্যা সমাধান করেন।
[সম্পাদনা]কমিটি ব্যবস্থা
পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির সঙ্গে জড়িত সদস্যদের সময়ের স্বল্পতা, পঞ্চায়েত প্রশাসনের কাজকর্মের ধারাকে অব্যাহত রাখা, মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন রোধ ও গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কমিটি ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়েছে। মুখ্যত পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ স্তরে কমিটি ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি এককভাবে বা যৌথভাবে কমিটি গঠনের অধিকারী হলেও, গ্রাম পঞ্চায়েত ক্ষেত্রে অবশ্য কমিটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।
জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিতে এই সকল উদ্দেশ্য রূপায়ণে মোট দশটি স্থায়ী সমিতি বা স্ট্যান্ডিং কমিটি রয়েছে। তবে প্রয়োজনবোধে রাজ্য সরকারের অনুমতি নিয়ে আরও কমিটি এঁরা গঠন করতে পারেন। বর্তমানে কার্যকর কমিটিগুলি হলঃ (১)অর্থ, সংস্থা, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা স্থায়ী সমিতি; (২)জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ স্থায়ী সমিতি; (৩)পুর্তকার্য ও পরিবহন স্থায়ী সমিতি; (৪)কৃষি, সেচ ও সমবায় স্থায়ী সমিতি;(৫)শিক্ষা, সংস্কৃতি, তথ্য ও ক্রীড়া স্থায়ী সমিতি; (৬)ক্ষুদ্রশিল্প, ত্রাণ ও জনকল্যাণ স্থায়ী সমিতি; (৭)বন ও ভূমি সংস্কার স্থায়ী সমিতি; (৮)মৎস্য ও প্রাণীসম্পন বিকাশ স্থায়ী সমিতি; (৯)খাদ্য ও সরবরাহ স্থায়ী সমিতি; এবং (১০)বিদ্যুত ও অচিরাচরিত শক্তি স্থায়ী সমিতি।
পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের স্থায়ী সমিতিগুলির গঠনপদ্ধতি মোটামুটি একই রকম। এই কমিটিগুলির সদস্যগণ হন –
- সভাধিপতি/সভাপতি এবং সহকারী সভাধিপতি/ সহকারী সভাপতি (পদাধিকার বলে)
- জেলা পরিষদ/পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত ৩ থেকে ৫ জন সদস্য
- রাজ্য সরকার বা কোনও বিধিবদ্ধ সংস্থা বা নিগমের আধিকারিক বা প্রখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে রাজ্য সরকার কর্তৃক মনোনীত কয়েকজন ব্যক্তি।
সদস্যদের সকলেই কোনও না কোনও কমিটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তবে সভাধিপতি/সভাপতি ও সহকারী সভাধিপতি/ সহকারী সভাপতি ছাড়া কেউই দুটি (জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে) বা তিনটির (পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রে) বেশি কমিটির সদস্য হতে পারেন না। প্রত্যেক সমিতি নিজেদের মধ্যে থেকে একজনকে কর্মাধ্যক্ষ বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। তবে এই নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার মনোনীত ব্যক্তিগণ অংশগ্রহণ বা প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করতে পারেন না। এই পদগুলির ক্ষেত্রেও তফসিলি জাতি, উপজাতি ও মহিলাদের আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে অপরাপর পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির নীতিই অনুসৃত হয়। তবে সভাপতি বা সভাধিপতিই নিজ নিজ সংস্থার অর্থ, সংস্থা, উন্নয়ন ও পরিকল্পনা স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ হয়ে থাকেন।
প্রত্যেক কমিটি নিজ নিজ সংস্থাগুলি দ্বারা অর্পিত ক্ষমতার প্রয়োগ ও কার্য সম্পাদনা করে থাকে। এদের এক্তিয়ার নিয়মানুযায়ী বিধিবদ্ধ এবং এই এক্তিয়ারের কর্মসূচি, প্রকল্প সম্পাদন ও আর্থিক প্রশাসনের জন্য কর্মাধ্যক্ষ দায়ী থাকেন।
প্রত্যেক কমিটিতে একজন সচিব থাকেন। পঞ্চায়েত সমিতিতে পঞ্চায়েত সম্প্রসারণ আধিকারিক এই পদটি অলংকৃত করেন। অন্যত্র সদস্যদের মধ্যে থেকেই সচিব নির্বাচিত হন। সরকার মনোনীত সদস্যগণ এই পদে যোগ দিতে পারেন না। জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে পরিষদ সচিব সকল স্থায়ী কমিটির সচিব হিসাবে কাজ করেন। এখানে উল্লেখ্য, কর্মাধ্যক্ষ সর্বক্ষণের কর্মী হন। তিনি অন্য কোথাও বেতনভোগী কর্মীরূপে কাজ করতে পারেন না।
এছাড়া দশটি সমিতির কাজকর্মের সমন্বয়ের জটিল দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য একটি সমন্বয় সমিতিও কাজ করে থাকে। এই কমিটির কাজ কতকটা মন্ত্রিসভার ক্যাবিনেটের মতো। এই সমিতিগুলি গঠিত হয় সভাধিপতি/সভাপতি, কর্মাধ্যক্ষগণ এবং পরিষদের কার্যনির্বাহী আধিকারিক ও অতিরিক্ত কার্যনির্বাহী আধিকারিক/ পঞ্চায়েত সমিতির কার্যনির্বাহী আধিকারিককে নিয়ে। নিজ সংস্থার সচিবগণ জেলা পরিষদ/পঞ্চায়েত সমিত্র সমন্বয় কমিটির সচিব হন। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি/ জেলা পরিষদের সভাধিপতি সমন্বয় কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন।
[সম্পাদনা]নির্বাচন ব্যবস্থা
সংবিধান অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের সমস্ত নির্বাচন পরিচালনা, তত্ত্বাবধান, নির্দেশদান ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। তবে এই নির্বাচন পঞ্চায়েত আইন অনুসারেই নির্বাচিত হয়ে থাকেন।
গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। আইন অনুসারে পাঁচ বছর শেষ হবার আগেই এই তিন সংস্থায় নির্বাচন করতে হয়। তাছাড়া কোনও পঞ্চায়েত সংস্থা ভেঙে দিলে ছয় মাসের মধ্যে ভোটের আয়োজন করাও বাধ্যতামূলক।
নির্বাচনের সুবিধার জন্য প্রত্যেক পঞ্চায়েত সংস্থাকে কয়েকটি নির্বাচন ক্ষেত্রে ভাগ করা হয়েছে। এই এলাকার ভোটদাতারা অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ভোটাররাই। গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটার সংখ্যার নিরিখে কোনও কোনও গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনি এলাকা একাধিক সদস্যবিশিষ্ট। অন্যান্য ক্ষেত্রে অবশ্য এই এলাকা এক সদস্যবিশিষ্টই। প্রত্যেক পঞ্চায়েত সংস্থার মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই রাজ্য সরকার যে-কোনও পঞ্চায়েত সংস্থা ভেঙে দিতে পারেন। এছাড়া কোনও সদস্য পদত্যাগ করলে বা পদচ্যূত হলে বা মারা গেলে তাঁর নির্বাচনি এলাকায় পুনরায় নির্বাচন করা যায়।
[সম্পাদনা]কার্যাবলি
স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসাবে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের হাতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সম্পাদনের জন্য বিবিধ ক্ষমতা ও কাজের দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে।
[সম্পাদনা]গ্রাম পঞ্চায়েতের কার্যাবলি
গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজগুলি ত্রিবিধ – বাধ্যতামূলক, ন্যস্ত ও ঐচ্ছিক।
- গ্রাম পঞ্চায়েতের বাধ্যতামূলক কাজগুলি মূলর গ্রামোন্নয়ন সংক্রান্ত। এর মধ্যে রয়েছে – পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, পৌর এলাকার সুযোগসুবিধার জন্য বাৎসরিক ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রস্তুতিকরণ, আর্থিক উন্নয়ন ও ন্যায়বিচার সংক্রান্ত প্রকল্পগুলির রূপায়ন, জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ, জলনিষ্কাশন ব্যবস্থাকরণ, মহামারি প্রতিরোধ, পানীয় জল সরবরাহ, লোকব্যবহার্য পুকুর খনন, রাস্তাঘাট রক্ষণাবেক্ষণ, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠিতকরণ, কর ধার্য ও সংগ্রহ, গ্রাম পঞ্চায়েতের তহবিল পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি।
- অন্যদিকে গ্রাম পঞ্চায়েতের উপর ন্যস্ত ও ঐচ্ছিক কাজগুলি সাধারণ উন্নয়ন ও গ্রাম পুনর্গঠন সংক্রান্ত। রাজ্য সরকারও কিছু কিছু দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির উপর ন্যস্ত করে থাকেন। সেক্ষেত্রে এই কাজগুলির সম্পাদনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারই গ্রাম পঞ্চায়েতকে দিয়ে থাকেন। এই কাজগুলি হল, প্রাথমিক, সামাজিক, বৃত্তিমূলক ও বয়স্ক শিক্ষা, মাতৃ ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, খেয়াঘাট পরিচালনা, সেচ, কৃষি, জ্বালানি, পশু চিকিৎসা, ভূমি সংস্কার, সমবায়, গ্রামীণ গৃহ প্রকল্প ইত্যাদি। তবে এই সকল কাজের গতিপ্রকৃতি দেখে সন্তুষ্ট না হলে সরকার এই কাজগুলি প্রত্যাহার করে নিতে পারেন।
- গ্রাম পঞ্চায়েতের স্বেচ্ছাধীন কাজগুলি হল – রাস্তার আলোর ব্যবস্থা, বৃক্ষরোপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, কূপ খনন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমবায় প্রথার প্রবর্তন, হাট-বাজার স্থাপন, দারিদ্র দূরীকরণ প্রকল্প গ্রহণ, গ্রন্থাগার স্থাপন, সাংস্কৃতিক কাজকর্ম, সামাজিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে অনগ্রসর শ্রেণির কল্যাণসাধন ইত্যাদি। স্থানীয় জনহিতকর যে-কোনও প্রকল্প গ্রাম পঞ্চায়েত স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে পারে।
- এছাড়াও গৃহনির্মান, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতিকরণ, রাস্তা ও জলপথ রক্ষণাবেক্ষণ, দূষিত জলসরবরাহ নিয়ন্ত্রণ, সংক্রামক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হলে তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণের ক্ষমতাও গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে ন্যস্ত রয়েছে।
[সম্পাদনা]পঞ্চায়েত সমিতির কার্যাবলি
ব্লক তথা পঞ্চায়েত সমিতি এলাকার উন্নয়ন সাধন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পঞ্চায়েত সমিতির হাতে বিবিধ ক্ষমতা ও দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে।
- পঞ্চায়েত সমিতির প্রাথমিক কাজ সামগ্রিকভাবে সমষ্টির উন্নয়ন ও সমাজের প্রতিটি মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে ব্লক এলাকার জন্য একটি পঞ্চবার্ষিকী উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং একটি বার্ষিক পরিকল্পনা রচনা করা। কৃষি, কুটির শিল্প, সমবায় আন্দোলন, গ্রামীণ ঋণ, জল সরবরাহ, শিক্ষা, সামাজিক বনসৃজন, নারী ও শিশুর কল্যাণ, লোকহিতকর কাজের জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান ইত্যাদি বিষয়েও পঞ্চায়েত সমিতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখে।
- এছাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতগুলির বাজেট অনুমোদন, একই ব্লকের গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি রচিত পরিকল্পনাগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন, এলাকার রাস্তার দিক পরিবর্তন বা রাস্তা বন্ধ করা, দূষনীয় ও বিপজ্জন ব্যবসা বন্ধ করা, হাট ও বাজারের লাইসেন্স দেওয়া ও গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ তদারক করার ক্ষমতাও পঞ্চায়েত সমিতির হাতে ন্যস্ত। তাছাড়া ব্লকের সামগ্রিক পরিকল্পনা রচনা ও রূপায়ণের জন্য গঠিত ব্লক পরিকল্পনা কমিটিতে পঞ্চায়েত সমিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
[সম্পাদনা]জেলা পরিষদের কার্যাবলি
পঞ্চায়েত সমিতির মতো জেলা পরিষদের হাতেও আর্থিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু কিছু দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পন করা হয়েছে।
- জেলা পরিষদের প্রাথমিক কাজ হল সামগ্রিকভাবে সমষ্টির উন্নয়ন ও সমাজের প্রতিটি মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে জেলার জন্য একটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং একটি বাৎসরিক পরিকল্পনা রচনা করা। এছাড়া পঞ্চায়েত সমিতিগুলির বাজেট অনুমোদন, একই জেলার পঞ্চায়েত সমিতিগুলি রচিত পরিকল্পনাগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন, এলাকার ও তাদের কাজকর্ম তদারক করাও জেলা পরিষদের অন্যতম কাজ বলে বিবেচিত হয়।
- জেলা পরিষদের অন্যান্য কাজগুলির মধ্যে প্রধান হল – জল সরবরাহ, সেচ, জনস্বাস্থ্য, হাসপাতাল, সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, কৃষি, পশুপালন, শিল্প, সমবায় আন্দোলন, গ্রামীণ ঋণব্যবস্থা প্রভৃতি খাতে পরিকল্পনা ও অর্থসংস্থান এবং গ্রামীণ হাট-বাজারের রক্ষণাবেক্ষণ, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতকে অনুদান প্রদান, প্রকৌশলগত শিক্ষাপ্রসারে বৃত্তিপ্রদান, ত্রাণ, জল সরবরাহ ও মহামারি প্রতিরোধে অর্থবরাদ্দ করা। এগুলি ছাড়া সরকার প্রদত্ত কাজ ও পরিকল্পনার দায়িত্বও জেলা পরিষদগুলিকে পালন করতে হয়।
- এই সব কাজকর্ম ছাড়াও কিছু সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণমূলক কাজও জেলা পরিষদকে করতে হয়। এর মধ্যে আছে পঞ্চায়েত সমিতিগুলি কর্তৃক গৃহীত বা পরিকল্পিত প্রকল্পগুলির সমন্বয়সাধন, পঞ্চায়েত সমিতিগুলির বাজেট পরীক্ষা ও অনুমোদন। এছাড়াও ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের উন্নয়নমূলক কার্যাবলি সম্পর্কে জেলা পরিষদ রাজ্য সরকারকে যথাযথ ও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শদানের অধিকারী।
[সম্পাদনা]পঞ্চায়েত প্রশাসন
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির সুষ্টু পরিচালনার দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে ন্যস্ত। এই কাজের জন্য রাজ্য সরকারের অধীনে একটি পঞ্চায়েত বিভাগ এবং পঞ্চায়েত অধিকার প্রতিষ্ঠিত আছে।
- পঞ্চায়েত বিভাগ – পঞ্চায়েত বিভাগ ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর অধীনস্থ একটি বিভাগ। এর প্রধান হলেন সচিব। এই বিভাগের কাজ হল পঞ্চায়েত সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণ করা।
- পঞ্চায়েত অধিকার – পঞ্চায়েত অধিকার পঞ্চায়েত বিভাগের নীতিগুলি রূপায়িত করে থাকে। এর ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক হলেন পঞ্চায়েত অধিকর্তা। তাঁকে সাহায্য করার জন্য দুজন যুগ্ম-অধিকর্তা, তিনজন সহ-অধিকর্তা এবং অন্যান্য আধিকারিক ও কর্মীরাও রয়েছেন।
এছাড়া পঞ্চায়েতের তিনটি স্তরের জন্য তিন জন আঞ্চলিক সহ-অধিকর্তা, প্রত্যেক জেলায় একজন জেলা পঞ্চায়েত আধিকারিক বা ডিস্ট্রিক্ট পঞ্চায়েত অফিসার (ডিপিও) এবং পঞ্চায়েতের সর্বনিম্ন যোগসূত্র হিসাবে একজন পঞ্চায়েত সম্প্রসারণ আধিকারিক (ইওপি) রয়েছেন। ডিপিও গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধান করেন ও তাঁদের পরামর্শ দেন; ইওপি ব্লক স্তরে সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের অধীনে কাজ করেন।
প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ এক-একটি 'আবদ্ধ ইউনিট'। [৭] সেজন্য পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত কর্মচারীদের পদোন্নতির সুযোগ ভিন্ন ভিন্ন রকমের
[সম্পাদনা]গ্রাম পঞ্চায়েত প্রশাসন
গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রশাসনিক ব্যবস্থার শীর্ষে আছেন প্রধান ও উপ-প্রধান। এছাড়া প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে একজন করে সচিব থাকেন যিনি পঞ্চায়েতের দৈনিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন। তাঁকে নিয়োগ করেন পঞ্চায়েত অধিকর্তা। এছাড়া থাকেন একজন কর্মসহায়ক বা জব অ্যাসিস্টেন্স। তাঁকে নিয়োগ করেন প্রধান। তিনি মূখ্যত প্রকল্প সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখাশোনা করেন।
এছাড়া পূর্বে প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে যে একজন করে দফাদার ও কয়েকজন চৌকিদার থাকতেন, তাঁদের বদলে পঞ্চায়েতের সর্বক্ষণের জন্য কর্মী নিয়োগ শুরু হয়েছে। এঁদের নতুন নামকরণ করা হয়েছে 'গ্রাম পঞ্চায়েত কর্মী'।
এছাড়া প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েতে এক বা একাধিক কর আদায়কারী বা কালেক্টর আছেন, যাঁরা গ্রাম পঞ্চায়েতের ধার্য করা কর আদায় করে থাকেন। এজন্য তিনি মাসিক ভাতা ও কর আদায়ের পরিমাণের উপর কমিশন পেয়ে থাকেন।
[সম্পাদনা]পঞ্চায়েত সমিতি প্রশাসন
পঞ্চায়েত সমিতি প্রশাসনের শীর্ষে থাকেন সভাপতি ও সহকারী সভাপতি। এছাড়া প্রত্যেক কর্মাধ্যক্ষের হাতেও কিছু কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। এঁরা প্রত্যেকেই নির্বাচিত প্রশাসক।
এছাড়া পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাহী আধিকারিক হিসাবে কাজ করেন সংশ্লিষ্ট সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক বা ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসার (বিডিও)। পঞ্চায়েত সম্প্রসারণ আধিকারিক পঞ্চায়েত সমিতি এবং অর্থ কমিটির সচিব। এছাড়া অপরাপর কমিটিগুলিতেও একজন করে সচিব থাকেন। সংশ্লিষ্ট ব্লকের আধিকারিক ও কর্মীবর্গকে পঞ্চায়েত সমিতির হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়াও রাজ্য সরকার প্রয়োজনে অন্যান্য আধিকারিক ও কর্মচারী দিয়ে পঞ্চায়েত সমিতিকে সাহায্য করে থাকেন।
[সম্পাদনা]জেলা পরিষদ প্রশাসন
জেলা পরিষদের নীতিপ্রণয়ন ও কার্যসম্পাদনের জন্য জেলা পরিষদের সভাধিপতি বা তাঁর অনুপস্থিতিতে সহকারী সভাধিপতি নেতৃত্বে একটি প্রশাসন যন্ত্র কাজ করে। সভাধিপতি পরিষদের আর্থিক ও কার্যনির্বাহী প্রশাসনের সাধারণ দায়িত্বে বহাল থাকেন ও পরিষদের দলিলপত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দায়ী থাকেন। পরিষদের কাজকর্ম কয়েকটি কমিটির দ্বারা সম্পাদিত হয়ে থাকে। এই কমিটিগুলির অধ্যক্ষগণ জেলা পরিষদ প্রশাসনে নির্দিষ্ট দায়িত্ব বহন করে থাকেন।
প্রত্যেক জেলার জেলা-শাসক জেলা পরিষদের কার্যনির্বাহী আধিকারিকের পদে আসীন থাকেন। তাঁকে সহায়তা করেন একজন অতিরিক্ত কার্যনির্বাহী আধিকারিক; তিনি অতিরিক্ত জেলা-শাসকের মর্যাদাসম্পন্ন আধিকারিক। এছাড়াও অপর একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক পরিষদের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এঁরা সকলেই রাজ্য সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন।
এঁরা ছাড়াও প্রত্যেক জেলা পরিষদে একজন করে জেলা প্রযুক্তিবিদ বা ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার, মেডিক্যাল অফিসার, উচ্চপদস্থ কারিগরি কর্মী এবং করণিক ও আরদালি থাকেন। রাজ্য সরকারও কিছু কর্মচারীকে পরিষদে ন্যস্ত করে থাকেন।
[সম্পাদনা]তহবিল ও সম্পত্তি
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান পঞ্চায়েত আইন, নিয়মাবলি ও সরকারি আদেশনামা অনুসারে হয়ে থাকে। এই সংস্থাগুলির আয়ের উৎস দুভাগে বিভক্ত – অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক। অভ্যন্তরীন উৎসগুলির মধ্যে আছে কর (ট্যাক্স), অভিকর (রেট), মাশুল (ফি), উপশুল্ক (টোল), জরিমানা ও এগুলির নিজস্ব লগ্নি ও লাভজনক উদ্যোগ থেকে আয়। বাহ্যিক উৎসের মধ্যে পড়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার, জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতি কর্তৃক দত্ত অনুদান বা ন্যস্ত অর্থ, সরকার আরোপিত করের অংশ, স্থানান্তরিত রাজস্ব, সরকারি আর্থিক সাহায্য ইত্যাদি।
[সম্পাদনা]গ্রাম পঞ্চায়েতের নিজস্ব আয়
গ্রাম পঞ্চায়েতের নিজস্ব আয়ের উৎস তিন ভাগে বিভক্ত – (১) বাধ্যতামূলকভাবে বসানো কর, মাশুল ইত্যাদি; (২) স্বেচ্ছাধীনক্ষেত্রে বসানো কর, মাশুল ইত্যাদি; এবং (৩) সরকার কর্তৃক হস্তান্তরিত বিষয়।
[সম্পাদনা]বাধ্যতামূলক বিষয়গুলি
- গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জমি ও বাড়ির মালিক ও দখলকারীর থেকে আদায়ীকৃত কর। জমি বা বাড়ির বার্ষিক মূল্য ১০০০ টাকার মধ্যে হলে ১% হারে ও ১০০০ টাকার বেশি হলে ২% হারে কর বসানো বা সংগ্রহ করা হয়। তবে বার্ষিক ২৫০ টাকা কম মূল্যের বাড়ি বা জমি, জনস্বার্থে ব্যবহৃত বা ধর্মীয় বা শিক্ষাগত বা দাতব্য উদ্দেশ্যে নির্মিত ক্ষেত্রে গ্রাম পঞ্চায়েত কর বসানোর অধিকারী নয়।
- এলাকার মধ্যে যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর, দান, বন্ধক, ইজারা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ২% হারে শুল্ক; প্রমোদানুষ্ঠান যথা প্রদর্শনী, সিনেমা, নাটক ও খেলাধুলার প্রবেশমূল্যের উপর ১০% হারে অতিরিক্ত স্ট্যাম্প ডিউটি বসাতে পারে গ্রাম পঞ্চায়েত।
- এলাকায় গৃহনির্মান, গৃহসংস্কার ও সম্প্রসারণের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমতি প্রয়োজন। এই অনুমোদনের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত নির্দিষ্ট হারে মাশুল আদায় করতে পারে।
- নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত আইন বা বিধি লঙ্ঘিত হলে গ্রাম পঞ্চায়েত জরিমানাও আদায় করতে পারে।
[সম্পাদনা]ঐচ্ছিক বিষয়গুলি
- রিকশা, ঠেলা, গোরুর গাড়ি ও অন্যান্য পশুবাহিত যানবাহন নিবন্ধীকরণের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত মাশুল বসাতে পারে। এজন্য এই সকল যানে লাইসেন্স প্রদান করে পঞ্চায়েত। তাছাড়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও নিবন্ধীকৃত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাশুল আদায় করতে পারে পঞ্চায়েত।
- দেবস্থান, তীর্থস্থান ও মেলায় জনস্বাস্থ্যমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত মাশুল বসাতে ও আদায় করতে পারে।
- পানীয় জল, সেচের জল বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে সরবরাহকৃত জলের উপর অভিকর বা জলকর বসাতে পারে গ্রাম পঞ্চায়েত।
- রাস্তা বা সর্বজনীন স্থানে আলোর ব্যবস্থা করলে পঞ্চায়েত অভিকর বসাতে পারে।
- ব্যক্তিবিশেষের বা জনসাধারণের শৌচাগার ও আবর্জনা ফেলার স্থানের ব্যবস্থা করলে তার উপর গ্রাম পঞ্চায়েত অভিকর বসাতে পারে।
- গ্রাম পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠিত বা তার ব্যবস্থাধীন খেয়াঘাট ব্যবহারের উপর গ্রাম পঞ্চায়েত উপশুল্ক আদায় করতে পারে।
- কুকুর, পাখি বা অন্যান্য গৃহপালিত জন্তুর উপর গ্রাম পঞ্চায়েত মাশুল বসাতে পারে।
- গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে স্থিত জমিতে পশুচারণের উপর গ্রাম পঞ্চায়েত মাশুল বসাতে পারে।
- গ্রাম পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে স্থিত শ্মশানঘাট ব্যবহারের উপর গ্রাম পঞ্চায়েত মাশুল বসাতে পারে।
- বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহৃত মোটরচালিত শ্যালো টিউবওয়েল ব্যবহারের উপর পঞ্চায়েত নিবন্ধীকরণ মাশুল আরোপ করতে পারে।
[সম্পাদনা]সরকার কর্তৃক হস্তান্তরিত উৎস
গ্রাম পঞ্চায়েতের আয় বৃদ্ধির জন্য এলাকাধীন খোঁয়াড়, সরকারি পুরুর, ডোবা ও দিঘি এবং সকল প্রকার খাস জমি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রাম পঞ্চায়েতের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এছাড়া পঞ্চায়েতগুলি নিজেরা কোনও উদ্যোগ পরিচালনা করে আয় বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। এই উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকার, ব্যাঙ্ক বা অপর কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ সংগ্রহ করতে পারে তারা।
[সম্পাদনা]পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের নিজস্ব আয়
পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের নিজস্ব আয়ের উৎসগুলি মোটামুটি একই রকমের। রাজ্য সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ হারে এরা কর, অভিকর, মাশুল ও উপশুল্ক বসাতে পারে। উভয় সংস্থাই নিজ পরিচালনাধীনে থাকা সড়ক ও সেতুর উপর চলাচলকারী মানুষ, যানবাহন ও মালিকানাধীন পশুর উপর উপশুল্ক; খেয়াঘাটে উপশুল্ক; যানবাহন নিবন্ধীকরণ, তীর্থ ও মেলায় স্বাস্থ্যসম্পর্কিত ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য, মেলার লাইসেন্স বাবদ মাশুল; জল সরবরাহ, সর্বজনীন স্থানে আলোর উপর অভিকর বসাতে পারে। পঞ্চায়েত সমিতি হাট ও বাজারের লাইসেন্স বাবদ মাশুল ও জেলা পরিষদ নৌকা নিবন্ধীকরণের জন্য মাশুল আদায় করতে পারে। নির্দিষ্ট আইন বা বিধিভঙ্গ করলে এরা জরিমানাও আদায় করতে পারে। তবে একটি বিষয়ের উপর একটি পঞ্চায়েত সংস্থাই কর বা মাশুল ধার্য করতে পারে।
এছাড়াও জেলা পরিষদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হল পুর্ত ও সড়ক উপকর। এই কর রাজ্য সরকার নির্ধারিত হারে জেলা পরিষদ আদায় করে ও তারাই ভোগ করে। এছাড়াও জেলা পরিষদের হাতে রাজ্য সরকার দ্বারা ন্যস্ত ডাক-বাংলো, হাসপাতাল, খাস জমি ও পুকুর-দিঘি থেকে প্রাপ্ত আয়ও পরিষদের আয়ের অন্যতম উৎস।
এছাড়াও পরিষদ নিজ উদ্যোগে আয় বাড়াতে পারে বা সরকার, ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ তুলতে পারে।
[সম্পাদনা]সরকারি অনুদান
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির আয়ের উৎস যথেষ্ট নয়। সেই কারণে এদের সরকারি অনুদানের উপর অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। এই সরকারি অনুদানই গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের আয়ের প্রধান উৎস। এই অনুদান প্রধানত দুই ধরনের – সাধারণ অনুদান ও বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প রূপায়নে বরাদ্দ বিভাগীয় অর্থ।
গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি কর্মচারী, প্রধান ও উপ-প্রধানের বেতন, সদস্যদের রাহাখরচ ও দৈনিক ভাতা বাবদ সরকারি অনুদান; ম্যাচিং গ্রান্ট ও প্রকল্প রূপায়নের জন্য বরাদ্দ অর্থ পেয়ে থাকে।
পঞ্চায়েত সমিতিগুলিকেও রাজ্য সরকার বিভিন খাতে অনুদান ও কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা বাবদ অর্থ; প্রশাসনিক ব্যয়বরাদ্দ ও প্রকল্প রূপায়নের অর্থ দিয়ে থাকে।
জেলা পরিষদ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে অনুদান পেয়ে থাকে। এই অনুদানে কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা প্রদান; প্রশাসনিক ব্যয় ও প্রকল্প রূপায়নের ব্যয় নির্বাহিত হয়। ১৯৯৫ সালে গঠিত অর্থ কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে প্রমোদ কর থেকে সংগৃহীত সমস্ত অর্থ; অন্যান্য সব রকমের সংগৃহীত কর থেকে ১৬% রাজ্য সরকার স্থানীয় পঞ্চায়েত সংস্থা ও পুরসভাগুলিকে দিয়ে থাকেন এবং সেচ কর বাবদ আদায়ীকৃত অর্থ জেলা পরিষদকে দিয়ে থাকেন।
[সম্পাদনা]নিরীক্ষা বা অডিট
পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন অনুসারে পঞ্চায়েত সংস্থাগুলি আয়ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতির আয়ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব সরকারি সংস্থা একজামিনার অব লোকাল অ্যাকাউন্টস দ্বারা নিরীক্ষিত হয়। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে এই কাজ করেন পঞ্চায়েত সম্প্রসারণ আধিকারিক।
পঞ্চায়েত সংস্থাগুলির নিরীক্ষক সংস্থার কর্মচারীরা হলেন –
- গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে ব্লক স্তরে পঞ্চায়েত অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড অডিট অফিসার;
- পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষেত্রে জেলা স্তরে সমিতি অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড অডিট অফিসার;
- জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে জেলা স্তরে পরিষদ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড অডিট অফিসার।
এঁদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য প্রত্যেক বিভাগীয় কমিশনারের অধীনে একজন করে রিজিওনাল অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড অডিট অফিসার আছেন। রাজ্য স্তরে পঞ্চায়েত ও সমষ্টি উন্নয়ন বিভাগের অধীনে একজন বিশেষ আধিকারিকও আছেন। এঁদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি পঞ্চায়েত আইন অনুসারে বিধিবদ্ধ।
আয়ব্যয় নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এরা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। দুর্নীতিরোধে এদের হাতে বিশেষ দায়িত্ব ও ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি আইনবিরুদ্ধভাবে অর্থব্যয় করলে সংস্থার কোনও সদস্যকে অপসারিতও করা যাবে।
অডিট রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট সংস্থার অধিবেশনে আলোচিত হয়ে থাকে। এই রিপোর্ট রাজ্য সরকারের কাছেও জমা করতে হয়।
এছাড়াও দূর্নীতিরোধে জেলা কাউন্সিলের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়েছে। জেলা বা মহকুমা পরিষদে বিরোধী দলনেতা এই কাউন্সিলের অধ্যক্ষ হয়ে থাকেন।
[সম্পাদনা]পঞ্চায়েত ও বিকেন্দ্রীকরণ
ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই সুবৃহৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটির সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য সেই কারণে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এছাড়াও এই ব্যবস্থা ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর পক্ষে আদর্শগতভাবেও অত্যন্ত জরুরি।
পঞ্চায়েত ভারত অথা পশ্চিমবঙ্গে দায়িত্বশীল স্থানীয় সরকারের কাজ সম্পাদনা করে থাকে। এরা অবশ্যই সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হয় না; নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই কার্যকরী স্বাধিকার বা ফাংশনাল অটোনমি হিসাবে কাজ করে থাকে। এই উপায়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবিগুলির নিরূপণ সম্ভব। স্থানীয় সমস্যার সমাধান যা কেন্দ্র বা রাজ্য রাজধানী থেকে করা সম্ভব নয় – তার সমাধানও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমেই সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব।
[সম্পাদনা]গ্রামোন্নয়নে পঞ্চায়েতের ভূমিকা
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গ্রামোন্নয়ন সংক্রান্ত সব কর্মসূচির সঙ্গেই পঞ্চায়েত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত। গ্রামোন্নয়নে পঞ্চায়েতের কাজগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে –
- আর্থ-সামাজিক কাঠামোগত উন্নয়ন (যেমন সড়ক, কার্লভার্ট, প্রাথমিক বিদ্যালয়, গৃহনির্মান ও সংস্কার ইত্যাদি)।
- মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন (যেমন ভূমি সংস্কার, উদ্বৃত্ত জমি বণ্টন, বর্গাদার রেকর্ড ও ঋণের ব্যবস্থা)।
- কেন্দ্র, রাজ্য সরকার ও স্বগৃহীত বিভিন্ন মানবসম্পদ উন্নয়নগত পরিকল্পনা রূপায়ন।
- বিশেষ এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা (যেমন দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চল উন্নয়ন কর্মসূচি)।
- সম্পদ সংগ্রহ (যেমন খেয়াঘাট ও হাটবাজার পরিকল্পনা ও ন্যস্ত পুকুরগুলিতে মৎসচাষ করে সম্পদ সংগ্রহ করা)। [৮]
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
- পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত, অসিতকুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৮
- ভারতীয় প্রশাসন, শিউলি সরকার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ২০০৫
- ভারতে সরকারী প্রশাসন, পদ্মা রামচন্দ্রন, বাংলা অনুবাদ- সন্তোষকুমার অধিকারী, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ২০০১
- জনপ্রশাসন, রাজশ্রী বসু, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ২০০৫
[সম্পাদনা]পাদটীকা
- ↑ ডঃ অশোক মিত্রের সাক্ষাৎকার, কলকাতা, মার্চ ১৬, ১৯৭৯; ভারতীয় প্রশাসন, শিউলি সরকার, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ২০০৫ থেকে উদ্ধৃত
- ↑ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত, অসিতকুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ১৭
- ↑ ভারতীয় সংবিধান, ধারা ৪০
- ↑ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত, অসিতকুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ.২৩
- ↑ The Second Generation Panchayets in India, Prabhat Dutta, Calcutta Book House Pvt Ltd, preface
- ↑ The Panchayet Administration in West Bengal, Ashok Kumar Mukhopadhyay, The World Press Pvt Ltd, Third Edition, Calcutta, 1991, p.152
- ↑ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত, অসিতকুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ.৪২
- ↑ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত, অসিতকুমার বসু, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ.৫৫
[সম্পাদনা]আরও দেখুন
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ১৭৯৩ সনে কর্নওয়ালিস প্রশাসন কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকার ও বাংলার জমি মালিকদের (সকল শ্রেণীর জমিদার ও স্বতন্ত্র তালুকদারদের) মধ্যে সম্পাদিত একটি যুগান্তকারী চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় জমিদার ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির নিরঙ্কুশ স্বত্বাধিকারী হন। জমির স্বত্বাধিকারী হওয়া ছাড়াও জমিদারগণ স্বত্বাধিকারের সুবিধার সাথে চিরস্থায়ীভাবে অপরিবর্তনীয় এক নির্ধারিত হারের রাজস্বে জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন। চুক্তির আওতায় জমিদারদের কাছে সরকারের রাজস্ব-দাবি বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়ে গেলেও জমিদারদের তরফ থেকে প্রজাদের ওপর রাজস্বের দাবি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধ আরোপিত হয় নি। জমিদারদের জমি বিক্রয়, বন্ধক, দান ইত্যাদি উপায়ে অবাধে হস্তান্তরের অধিকার থাকলেও তাদের প্রজা বা রায়তদের সে অধিকার দেওয়া হয় নি। নিয়মিত খাজনা পরিশোধ সাপেক্ষে উত্তরাধিকারক্রমে জমির মালিক থাকার প্রথাগত অধিকার রায়তদের থাকলেও জমি হস্তান্তরের অধিকার তাদের ছিল না। সরকারের বেলায় জমিদারদের অবশ্য একটি দায়দায়িত্ব কঠোরভাবে পালনীয় ছিল। সেটি হচ্ছে নিয়মিত সরকারের রাজস্ব দাবি পরিশোধ করা। জমিদারগণকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয় যে, তাদের কেউ নির্ধারিত তারিখে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি ব্যক্তির সকল জমি বা এসব জমির এমন এক অংশ যা বকেয়া দাবি পূরণের জন্য যথেষ্ট গণ্য হতে পারে, তা অবশ্যই নিলামে বিক্রয় করা হবে।
পরিচ্ছেদসমূহ[আড়ালে রাখো] |
[সম্পাদনা]পটভূমি
প্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনার পর প্রণীত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে আদৌ রাজস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থামাত্র রূপে গণ্য করা যায় না। বরং এটি ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থারই একটি প্রধান অংশ। প্রশাসনের নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ ও পুলিশ বিভাগকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যকরীকরণের উপযুক্ত করে তোলা হয়। তবে, এ ব্যবস্থা বজায় রাখার সকল সযত্ন প্রয়াস সত্ত্বেও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ভূমি রাজস্ব আইন-এর প্রভাব, এই শতকের শেষের দিকে সাম্রাজ্যবাদের উত্থান, বিশ শতকে জাতীয়তাবাদের প্রচার-প্রসার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো নানা কারণে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতির চাপে এতে অবক্ষয়ের সূচনা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ হওয়ার পর থেকে এ ব্যবস্থার কয়েক দফা সংশোধন ও পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তিত বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অবশেষে ১৯৫০ সনে সমগ্র ব্যবস্থাই বিলুপ্ত করা হয়।
কলকাতায় জমিদারি (১৬৯৮) প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ক্রমাগত বাড়তে থাকে। পলাশীর যুদ্ধে(১৭৫৭) নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের পর কোম্পানি সর্বাপেক্ষা আধিপত্যশীল হয়ে ওঠে। তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেশের প্রকৃত শাসক হয়ে উঠার সত্যিকার প্রক্রিয়া শুরু হয় বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার (১৭৬৫) দেওয়ানির দায়িত্ব গ্রহণের পর। দেওয়ানি ব্যবস্থায় কোম্পানি বাংলার কার্যত অধীশ্বর হয়ে ওঠে।
নানা বাধাবিঘ্নের কারণে বাংলার এই নতুন অধীশ্বর গোড়া থেকেই রাজ্য শাসনের জন্য প্রস্তুত ছিল না। কোম্পানির বণিক ও হিসাবরক্ষক হিসেবে বাংলায় কোম্পানির কর্মকর্তারা পণ্যের কেনাবেচা, ব্যবসায়ের সুদীর্ঘ স্থিতিপত্র ইত্যাদি তৈরিতে দক্ষ ছিল বটে, তবে শাসনকাজে তারা ছিল একেবারেই অজ্ঞ। জনবলের অভাব, ভাষার সমস্যা, দেশজ ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অজ্ঞতা, বাংলায় অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী বৈদেশিক সমুদ্রচারী জাতির উপস্থিতি ইত্যাদি কারণ বাংলায় উপনিবেশ রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে তাদের শ্লথ গতিতে অগ্রসর হতে বাধ্য করে। একেবারেই গোড়ার দিকে কোম্পানি তাই দেশীয় সহযোগীদের যোগসাজসে এই নতুন উপনিবেশ শাসনের পন্থা গ্রহণ করে। নব্য শাসকদের সমস্যাটি ছিল এই যে, এটি আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো নতুন বসতি স্থাপনের উপনিবেশ ছিল না, মূলদেশের (ইংল্যান্ডের) আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী এটির শাসন পরিচালনাও সম্ভব ছিল না। আবার বাংলার অধিবাসীরা আফ্রিকা বা প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপদেশগুলির আদিবাসীদের মতো কোন অর্ধসভ্য জনসমাজও ছিল না, যে কারণে এখানে বেত্রশাসন ছিল অবাস্তব।
সবচেয়ে বড় সমস্যাটি দেখা দেয় আইন-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে। কোম্পানি বাংলার নিজস্ব আইন-কানুন বা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী দেশ শাসনের অবস্থায় ছিল না, কেননা তা হতো উপনিবেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যেরই পরিপন্থী। বলাবাহুল্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য ছিল, প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্য পরিচালনায় বাংলার রাজস্ব আয়কে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা। এই পরিস্থিতিতে পলাশী প্রান্তরের ঘটনার নায়ক ও দেওয়ানি চুক্তির (১৭৬৫) প্রণেতা রবার্ট ক্লাইভ এর অন্তত সাময়িকভাবে হলেও পরিকল্পনা ছিল দেশটি দেশীয় লোকদের দ্বারাই শাসিত হবে। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশী লোকেরা তাদের নিজস্ব আইন-কানুন ও রীতি অনুসারে দেশ শাসন করবে, আর কোম্পানির কাজ হবে শুধু এক উপরিশক্তি হিসেবে মুর্শিদাবাদেনওয়াবের দরবারে নিযুক্ত কোম্পানির একজন প্রতিনিধির মারফত উদ্বৃত্ত রাজস্ব সংগ্রহ করা। সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজা খান (১৭১৭? -১৭৯১) নামে ইরান থেকে ভাগ্যানুসন্ধানে আগত ও বাংলায় দীর্ঘকাল নিবাসী এক ব্যক্তিকে নায়েব দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করে তার উপর দেশশাসন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। রেজা খানকে নাবালক নওয়াবের (নাজমুদ-দাওলা) নায়েব নাজিম বা অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়। নায়েব নাজিম রূপে মুহাম্মাদ রেজা খান ছিলেন নিজামত বা অসামরিক প্রশাসন প্রধান আর নায়েব দেওয়ান হিসেবে তিনি ছিলেন দেওয়ানি বা রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান। তাকে দেশীয় আইন-কানুন ও প্রথা অনুযায়ী দেশ শাসন করার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।
ক্লাইভ প্রণীত এই শাসনপদ্ধতিকে সাধারণত দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা বলে পাঠ্যগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থাটি ১৭৬৭ সন অবধি ভালভাবেই কার্যকর ছিল। ঐ বছরেই ক্লাইভ এদেশ থেকে চূড়ান্তভাবে বিদায় নেন। ক্লাইভের সমর্থনে রেজা খান দক্ষতার সাথেই কোম্পানির রাজ্য শাসনে সক্ষম হন। তবে পৃষ্ঠপোষক ক্লাইভ-এর নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের পর রেজা খানকে ফোর্ট উইলিয়ামের উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাদের চরম বিরোধিতা মোকাবেলা করতে হয়। ফোর্ট উইলিয়ামের এসব কর্মকর্তা রাতারাতি ধনী হবার বাসনায় রেজা খানের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাসে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন। তারা পর্যায়ক্রমে রেজা খানের হাত থেকে প্রশাসন নিজেদের হাতে তুলে নেন। তাদের এ হস্তক্ষেপের বিষয় প্রথম স্পষ্ট হয়ে ওঠে বিভিন্ন জেলায় ইউরোপীয় তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের মাধ্যমে। তাদেরকে আপাতদৃশ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু রেজা খান অভিযোগ করতে থাকেন যে এই নবনিযুক্ত কর্মকর্তারা পল্লী অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছেন। সরাসরি দেশ শাসনের ক্ষেত্রে পরের ব্যবস্থাটি ছিল মুর্শিদাবাদে (বাংলার জন্য) ও পাটনায় (বিহার ও উড়িষ্যার জন্য) দুটি রাজস্ব পরিষদ (Revenue Councils) প্রতিষ্ঠা। ইউরোপীয় তত্ত্বাবধায়করা এই দুই পরিষদের আওতায় কাজ করতে থাকেন। রেজা খান ফোর্ট উইলিয়ম পরিষদের কাছে এই মর্মে অভিযোগ করতে থাকেন যে, অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যের নামে কোম্পানি কর্মকর্তারা দেশের পল্লী জনপদগুলিতে লুটপাট চালাচ্ছে। কিন্ত প্রতিকারের পরিবর্তে এসব অভিযোগ ফোর্ট উইলিয়ম কর্তাদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে আরও ক্ষিপ্ত করে তোলে। এর পরিণতিতে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে মন্দা দেখা দেয়, ফলে ১৭৬৯/৭০ সনের মহাদুর্ভিক্ষ সংঘটিত হয়। এ দুর্ভিক্ষে বাংলার মোট জনসমষ্টির এক তৃতীয়াংশ প্রাণ হারায়। বাংলার দুই-তৃতীয়াংশ ফসলি জমি লোকের অভাবে ঝোপ-জঙ্গলময় হয়ে ওঠে।
এ ধরনের ধ্বংসলীলার কারণে নতুন এই রাজ্যে প্রশাসনের ধরন সম্পর্কে শাসকদের আগের ধ্যানধারণা পুরোপুরি বদলে যায়। দেশীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে কোম্পানির দেওয়ানি প্রশাসন পরিচালনার ধারণাটি পরিত্যক্ত হয়। কোম্পানির পরিচালক সভার নির্দেশের (২৮ই আগস্ট, ১৭৭১) আওতায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিল দেওয়ানি প্রশাসনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সুবা বাংলার জন্য সর্বোচ্চ সরকার ঘোষণা করে। নায়েব দেওয়ান রেজা খানকে পদচ্যুত করে দুর্নীতি ও অনিয়মের দায়ে কারারুদ্ধ করা হয়।
কোম্পানির আঞ্চলিক বিষয়াদি প্রশাসনের জন্য ১৭৭২ সনে কলকাতায় রাজস্ব কমিটি নামে এক কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রেসিডেন্ট হন গভর্নর এবং বাংলার ফোর্ট উইলিয়মের প্রেসিডেন্ট। আর এভাবেই কলকাতা নীরবে ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী নগরীতে পরিণত হয়। ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস ঘোষণা করেন যে, ক্লাইভের দেওয়ানি ও নিজামত দ্বৈত-প্রশাসন ব্যবস্থা এখন আবার ১৭৬৫-র আগের ব্যবস্থার মতোই সমম্বিত ব্যবস্থায় পরিণত হবে। এই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ১৭৭২ সনে কয়েক দফা ইস্তেহার জারি হয়। এসব ইস্তেহার অনুযায়ী রাজস্ব চাষীদের প্রকাশ্য নিলামে পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য জমি ইজারা দেওয়া হয়। এই পাঁচসালা বন্দোবস্ত স্থির করার দায়িত্ব দেওয়া হয় গভর্নর ও কাউন্সিলের চার সদস্যের নেতৃত্বে এক সার্কিট কমিটিকে। এই কমিটির আরও দায়িত্ব ছিল ইজারাদারদের কাছ (চাষীদের) থেকে রাজস্ব আদায় করা। দেশীয় জেলা কর্মকর্তা তথা ফৌজদার, কানুনগো আর আমিলদের জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হলো ব্রিটিশ কালেক্টর বা রাজস্ব আদায়কর্তা।
পাঁচসালা রাজস্ব বন্দোবস্ত সবার জন্য ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়। রাজস্ব নিলামদাররা অত্যুচ্চ হারে খাজনা আদায় করতে থাকে। এহেন পরিস্থিতিতে অনেক রায়ত জমি ছেড়ে পালিয়ে যায়, কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ করে কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে উভয় পন্থাই অবলম্বন করে এবং বহু জায়গায় বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তবে যেহেতু খোদ সরকারই অধিক থেকে অধিকতর রাজস্ব আদায়ে ছিল অনমনীয় সেহেতু নিপীড়িত রায়ত বা প্রজাকে স্বস্তি দেওয়ার মতো সদিচ্ছা ছিল না, তাদের সেরূপ প্রশাসনিক সামর্থ্যও ছিল না। ফলে, পল্লী জনপদে অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। বন্দোবস্ত সম্পাদনের পর থেকে ক্রমেই বর্ধিত হারে বকেয়া রাজস্বের জের পুঞ্জীভূত হতে থাকে। সরকারের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে যে, পাঁচসালা বন্দোবস্তের বিষয়টি ছিল এক মহা প্রমাদ। সরকার উপলব্ধি করে যে, জমি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারভিত্তিক জমিদারদের একটা সামাজিক স্বার্থ জড়িত ছিল যা অস্থায়ী ইজারাদারদের বেলায় ছিল না। তাই ধরে নেওয়া হয় যে, জমিদারদের তাদের পুরানো মর্যাদা ফিরিয়ে দিলে ও তালুকের সম্পদ অনুযায়ী রাজস্ব ধার্য করা হলে একদিকে যেমন রাজস্ব আদায় সহজতর হবে অপরদিকে তা কৃষককুলকেও ইজারাদারের অত্যাচার থেকে রেহাই দেবে। কিন্তু পাঁচসালা বন্দোবস্তের শর্তাবলীর কারণে এক্ষেত্রে সরকারের হাত বাঁধা ছিল।
উদ্ভুত পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য একমাত্র বিকল্প ছিল এই সর্বনাশা ব্যবস্থার মেয়াদ ১৭৭৭ সনে শেষ হওয়ার পর রাজস্ব আদায়ের সর্বোত্তম পদ্ধতি কি হবে তা নিয়ে আগেভাগেই বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এ বিষয়ে কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব করা হয়। ১৭৭৫-এর ২৮শে মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য রিচার্ড বারওয়েল জমিদারদেরকে দীর্ঘমেয়াদে ভূমি বন্দোবস্ত দানের প্রস্তাব করেন। ১৭৭৬-এর ২২শে জানুয়ারিকাউন্সিলের আরেক সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস এক তত্ত্ব উপস্থাপন করেন যাকে তিনি 'চিরস্থায়ী ভূমি রাজস্ব পরিকল্পনা ১৭৭৬' বলে অভিহিত করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, জমিদারই জমির মালিক। অতএব তাদেরকে চিরস্থায়িভাবে জমির বন্দোবস্ত দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। জমিদারদের সাথে ভূমি বন্দোবস্তের ব্যাপারে ওয়ারেন হেস্টিংস বারওয়েলকে সমর্থন দেন। তাঁর মতে, ভূমি বন্দোবস্তের মেয়াদ নির্ধারণ করার আগে দেশের সম্পদের বিস্তারিত হিসাব নিরূপণ করা আবশ্যক। এসব অভিমতের ওপর কোম্পানির পরিচালক সভা যে নির্দেশ প্রদান করে তা হেস্টিংসের অভিমতের অত্যন্ত কাছাকাছি। পাঁচসালা বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবসানের প্রাক্কালে ১৭৭৬ সনের ২৪শে ডিসেম্বর কোম্পানির পরিচালক-সভা নির্দেশ দেয় যে, নিলামে জমি ইজারা দানের রীতি বাদ দিয়ে কেবল জমিদারদের সঙ্গে জমির স্বল্পমেয়াদি বন্দোবস্ত দিতে হবে। সভা ভূমি বন্দোবস্তের লক্ষ্যে জমির সম্পদ সঠিকভাবে নিরূপণের জন্য প্রয়োজনীয় জরিপ পরিচালনা করতে কাউন্সিলকে পরামর্শ দেয়। এভাবে কাউন্সিল ১৭৭৭ সন ও পরবর্তী তিন বছরের জন্য বার্ষিক ভিত্তিতে জমিদারদের সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্তের সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে নতুন ব্যবস্থাটি রাজস্ব আদায়ে অবক্ষয় প্রবণতা রোধ করতে পারে নি। রাজস্ব বকেয়া ক্রমেই পুঞ্জীভূত হতে থাকে। রাজস্ব শাসনের দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে গোটা দেশকে অনেকগুলি জেলায় বিভক্ত করা হয়। জেলা কালেক্টরকে জেলার সর্বেসর্বা প্রশাসকে পরিণত করা হয়। কালেক্টরকে সকল নির্বাহী ও বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কেন্দ্রায়ন ও হস্তক্ষেপের প্রতীক রাজস্ব কমিটিকে বিলুপ্ত করে স্থাপন করা হয় রাজস্ব বোর্ড, যার দায়িত্ব হলো রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয়াবলির সাধারণ বা সার্বিক নিয়ন্ত্রণ। জমিদারগণকে তাদের জমির ন্যায্য রাজস্ব নির্ধারণের জন্য এই কালেক্টরের মুখাপেক্ষী হতে হয়। রাজস্ব বোর্ডও রাষ্ট্রের রাজস্বের জন্য কালেক্টরের ওপর নির্ভরশীল হয়। ১৭৮৬ সনের সংস্কার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রকৃত প্রশাসনিক বুনিয়াদ রচনা করে। সরকার তখন থেকে আগেকার যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস ও দৃঢতার সঙ্গে জমিদারদের সঙ্গে বোঝাপড়ার জন্য প্রস্তুত হয়। তবে সরকারের এই প্রস্তুতি রাজস্ব আদায়ে খুব বেশি নিয়ম-শৃঙ্খলা নিয়ে আসেনি, কেননা রাজস্ব আদায়ে এর পরেও অনিশ্চয়তা বিরাজমান ছিল।
পিট-এর ভারত আইন ১৭৮৪-এর একটি দফায় কলকাতা সরকারকে অনতিবিলম্বে রাজস্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধ করা এবং সরকার ও জমিদার উভয় তরফের জন্য সুবিধাজনক শর্তের আওতায় জমিদারদের সাথে রাজস্ব প্রশ্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের নির্দেশ দেওয়া হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের জন্য স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে ১৭৮৬ সনে ব্রিটিশ ভূস্বামী শ্রেণীর অন্যতম সদস্য লর্ড কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হয়। একটি চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তাঁর রাজস্ব উপদেষ্টা জন শোরের (রাজস্ব বোর্ডের সভাপতি ও কাউন্সিল সদস্য) প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হন। উল্লেখ্য, জন শোর ছিলেন বাংলার রাজস্ব বিষয়ে সেরা বিশারদ। শোরের বিশ্বাস ছিল যে, অনতিবিলম্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদন করার মতো যথেষ্ট তথ্য তাদের হাতে নেই। অবশ্য নীতিগতভাবে তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ধারণার বিরোধী ছিলেন না। তাঁর কেবল আপত্তি ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় নিয়ে। তাঁর যুক্তি ছিল এই যে, একেকটি স্বতন্ত্র তালুকের প্রকৃত সম্পদ এবং জমিতে রায়তসহ যাদের স্বার্থ জড়িত রয়েছে তাদের প্রকৃত অধিকার ও দায়দায়িত্বের বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদন করা হলে তাতে এ চুক্তির সকল পক্ষেরই স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। শোর তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ করা আরও দুই বা তিন বছর স্থগিত রাখার অনুকূলে ছিলেন, যাতে করে ইত্যবসরে জমির সম্পদ ও জমিতে অধিকার সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যাপারে এহেন প্রশ্নে কর্নওয়ালিস ও শোরের মধ্যে প্রবল মতপার্থক্য দেখা দেয়। কর্নওয়ালিস যুক্তি দেন যে, গত বিশ বছরে সংগৃহীত তথ্যই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের জন্য যথেষ্ট। তাঁর আরও যুক্তি ছিল, কোন এক বা একাধিক তরফের বেলায় কোন গলদ-ত্রুটি ধরা পড়লে সেগুলি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সু-প্রভাবে অচিরেই দূর হয়ে যাবে। কর্নওয়ালিস বিশ্বাস করতেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা জমিদারদের নিজেদেরকে উন্নয়নকামী জমিদার ও কৃষি পুঁজিবাদী করে তোলার ব্যাপারে যথেষ্ট প্রেরণা যোগাবে।
কর্নওয়ালিস ও শোর তাদের নিজ নিজ অভিমত ও এতদসংক্রান্ত অন্যান্য দলিলপত্র কোম্পানির পরিচালক সভার কাছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য পাঠাতে সম্মত হন। তারা আরও একমত হন যে, ইত্যবসরে সরকারের উচিত হবে ১৭৯০ থেকে ১০ বছর মেয়াদের জন্য জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যার সাথে এই মর্মেও বিজ্ঞপ্তি থাকবে যে, যদি পরিচালক সভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকূলে মত প্রকাশ করেন তাহলে এই দশসালা বন্দোবস্তই অবিলম্বে চিরস্থায়ী বলে ঘোষিত হবে। কাউন্সিলের সকল সদস্যের সভার কার্যবিবরণী সমীক্ষার পর কোম্পানির পরিচালক-সভা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকূলে অভিমত প্রদান করে। ১৭৯৩ সনের ২৩শে মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিস ঘোষণা করেন যে, দশসালা বন্দোবস্তের মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর জমিদারদেরকে তাদের নিজ নিজ জমিদারির বেলায় প্রদেয় যে রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল তাতে কোনপ্রকার রদবদল করা হবে না; উপরন্তু, তাদের ওয়ারিশ ও আইনগতভাবে অন্যান্য উত্তরাধিকারীদেরকে এই পরিমাণ প্রদেয় রাজস্বের ভিত্তিতে চিরস্থায়িভাবে তালুকের ভোগদখল করার অনুমতি দেওয়া হবে (ইস্তাহার অনুচ্ছেদ ৩, ধারা ৪, প্রবিধান ১, ১৭৯৩)।
[সম্পাদনা]জমিদারদের প্রতিক্রিয়া
জমিদারদের প্রতিক্রিয়া সম্ভবত যুক্তিসিদ্ধ কারণেই কর্নওয়ালিস প্রশাসনের প্রত্যাশা ছিল যে, তাদের এই নতুন ভূমি ব্যবস্থাটিকে জমিদাররা বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নজিরবিহীন সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় স্বাগত জানাবে এ কারণে যে, এই ব্যবস্থার আওতায় ভূ-সম্পত্তির ক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকানা সৃষ্টির এই সুযোগটি ইতোপূর্বে আর কখনও ছিল না। এই নবসৃষ্ট ভূ-সম্পত্তি বিনামূল্যে জমিদারদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় জমিদারগণ চিরকালের মতো নির্ধারিত হারে সরকারি রাজস্ব পরিশোধের ব্যতিক্রমধর্মী সুবিধা লাভ করে। বস্তুত এ সিদ্ধান্তটি সরকারের দিক থেকে রাজস্বের নিরিখে নিশ্চিতভাবেই একটি ত্যাগ স্বীকার। আর তাই স্পষ্টতই সরকার গভীর আগ্রহে আশা করছিলেন যে, এক সুবিধাভোগী পক্ষ হিসেবে জমিদারগণ এই বন্দোবস্ত ব্যবস্থা বিপুল আগ্রহ-উদ্দীপনা সহকারে গ্রহণ করবে ও ব্রিটিশ সরকারের সুশাসনের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে। কিন্তু সরকার পরম বিস্ময়ে ও আশাহত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে, জমিদাররা বরং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় অসন্তোষ ও ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করছে। এমনকি বহু হতাশ জমিদার এই ভূমি বন্দোবস্ত ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে, অনেকে এর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিরোধও গড়ে তোলে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাদি সম্পর্কে জমিদারদের অসন্তোষের অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। এ পদ্ধতিতে পূর্ববর্তী দশ বছরের প্রকৃত খাজনা আদায়ের এক স্থূল গড়পরতার ওপর ভিত্তি করে জমিদারদের ওপর রাজস্ব নিরূপণ করা হয়। এ ধরনের অনির্ভরযোগ্য পদ্ধতির কারণে কোন তালুকের ওপর করের হার যেমন খুব কম হতে পারে আবার কোন তালুকের ওপর তা অত্যন্ত বেশিও হতে পারে। কাজেই যেসব তালুক-জমিদারি বিপুল করভারে ন্যুব্জ থাকবে তাদের জমি বকেয়া বাবদ প্রকাশ্য নিলামে উঠা অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া, ভবিষ্যতে 'খরা, প্লাবন, নদীভাঙন জনিত ক্ষয়ক্ষতি, রায়ত বা প্রজার মৃত্যু বা পলায়নের বেলায়' কোনরকম খাজনা মওকুফ করা হবে না বলে সরকারের দৃঢ ঘোষণা জমিদারগণ একান্তই অবাস্তব বলে মত প্রকাশ করেন। তারা যুক্তি দেখান যে, বৃষ্টিনির্ভর যেকোন কৃষি অর্থনীতিতে মাঝে মাঝেই ফসলহানি ঘটা স্বাভাবিক, আর সে কারণে রাজস্ব বাকি পড়া অনিবার্য। তারা জোরালো যুক্তি দেখান যে, কর্তৃপক্ষ যদি একান্ত নিয়মিত ও রুটিনমাফিক বৃষ্টিপাতের নিশ্চয়তা বিধান না করতে পারেন তাহলে তারা কেমন করে তাদের প্রজাদেরকে যথাসময়ে ও নিয়মিতভাবে প্রদেয় ভূমি রাজস্ব পরিশোধের জন্য চাপ দেবেন? জমির মালিকগণ ভূমি বন্দোবস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে তাদের বক্তব্যের সপক্ষে সনাতন ঐতিহ্যিক প্রথার বিষয় তুলে ধরেন, যার আওতায় প্রাকৃতিক কারণে ইতঃপূর্বে ফসলহানি ঘটলে তাদেরকে সরকারি রাজস্ব মওকুফ করা হতো। ১৭৯০ সন থেকে পরের তিন বছর রাজস্বের ক্রমবৃদ্ধি ছিল জমিদারদের আরও একটি অভিযোগের কারণ। জমিদারগণ কর্তৃক এই নীতিকে অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করার কারণ হচ্ছে, রাজস্ব ক্রমবৃদ্ধির প্রত্যাশাই ছিল যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সংশ্লিষ্ট তালুকের আয় বেড়ে যাবে এ ধরনের অনুমান নিছক কল্পনাসুলভ ও অযৌক্তিক।
জমিদারদের আরও একটি অভিযোগ ছিল তালুক নীতির প্রশ্নে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধিবিধান অনুযায়ী, যেসব তালুক এ যাবৎ জমিদারদের মাধ্যমে রাজস্ব প্রদান করে আসছে সেসব তালুকের প্রত্যেকটিকে একেকটি স্বতন্ত্র জমিদারি হিসেবে গণ্য করতে হবে। সকল বড় আকারের জমিদারির নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের বহু তালুক ছিল। এসব তালুককে কোনরকম ক্ষতিপূরণ না দিয়েই সংশ্লিষ্ট জমিদারি থেকে সেগুলিকে আলাদা করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। তালুকগুলি এভাবে আলাদা করে ফেলার কারণে বহু জমিদারি, যেগুলি ব্যবস্থাপনা বা অন্য কারণে তালুকের সৃষ্টি করেছিল, কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
জমিদারদের জন্য আরেকটি অসুবিধাজনক আইন ছিল পাট্টা রেগুলেশন। এই আইনের আওতায় জমিদারদেরকে তাদের প্রজাদের পাট্টা প্রদানের নিয়ম করা হলো যাতে বন্দোবস্তের শর্তাবলি সংজ্ঞায়িত হয়। এ আইনটি এই মর্মে জমিদারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যে, তারা নির্ধারিত অঙ্কের খাজনার অতিরিক্ত আবওয়াব বা এ ধরনের কোন কর আরোপ করতে পারবে না। জমিদারদের বিবেচনা ও দাবি অনুযায়ী, এ শর্তটি ছিল জমিদারি ব্যবস্থাপনা ও মালিকানায় সরাসরি হস্তক্ষেপ।
জমিদারদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ, সূর্যাস্ত আইন প্রয়োগের আওতায় বিপুল হারে জমি মালিকানার হস্তান্তর, সরকারি রাজস্বের ক্রমহ্রাস প্রবণতা, স্তূপাকারে জমে উঠা দেওয়ানি মামলা নিস্পত্তিতে বিচার বিভাগীয় ব্যর্থতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি আর সেই সাথে আনুষঙ্গিক অন্যান্য সকল বিষয় সরকারের জন্য বেশ অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এমন আশঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে যে, এই প্রবণতাকে ঠেকাতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে বাধ্য। তবে কর্তৃপক্ষের জন্য স্বস্তির বিষয় ছিল এই যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অপারেশন পুরানো ভূমধ্যধিকারী অভিজাত শ্রেণীর ঐতিহ্যিক আর্থসামাজিক কাঠামোকে যথেষ্ট বিঘি³ত করলেও, নয়া শাসকগোষ্ঠী এর বিপরীতে এক পাঁচমিশালি সামাজিক শ্রেণী গঠন করতে সমর্থ হয়। এদের মধ্যে ছিল তালুকদার , জোতদার, স্বল্প রাজস্ব আরোপ করা হয়েছে এমন মালিক, নতুন জমিদার, উদীয়মান বেনিয়া, ইঙ্গ-ভারতীয় সওদাগর সম্প্রদায় ইত্যাদি ছাড়াও আরও অনেকে। কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা সামাজিকভাবে তখনও তেমন মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী হয় নি যাতে তারা সঙ্কটকালে সরকারের সমর্থনে জনসমাজকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
লর্ড ওয়েলেসলির শাসনামলে (১৭৯৭ - ১৮০৫) চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-পরবর্তী পট পরিবর্তনকে অত্যন্ত উদ্বেগের চোখে দেখা হয়। ওয়েলেসলি সরকার ছিল সাম্রাজ্য গড়ে তোলায় অঙ্গীকারা বদ্ধ। এই সময়ে প্রতি মাসে শত শত জমিদারি নিলামে বিক্রয় করা হয়। ১৭৯৩ সনের পূর্বেকার মতো রাজস্ব আদায় অনিয়মিত ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে, প্রশাসনিক ব্যয় বেড়ে যায়, রাজস্ব আয় কমে আসে, দেশের অভ্যন্তরভাগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। জমিদারি-হারা পুরানো ভূস্বামীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ ধরনের দৃশ্যপট সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলে।
ওয়েলেসলি তাই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পর্কিত মূল বিধিগুলির কিছু সংশোধন করে জমিদার শ্রেণীর সঙ্গে একটা আপসে উপনীত হবার সিদ্ধান্ত নেন। এরই প্রেক্ষাপটে প্রণীত হয় ১৭৯৯ সনের ৭ নং রেগুলেশন যা সাধারণত হফতম বা সপ্তম আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। এ আইনের ফলে রায়তদের ওপর জমিদারদের লাগামহীন ক্ষমতা দেওয়া হয়। জমিদারগণ বকেয়া আদায়ের নামে প্রজাদের ফসল, গবাদি ও সম্পত্তি ক্রোক এবং বিক্রয় করে বকেয়া আদায়ের অধিকার লাভ করে। স্বত্বাধিকারী হিসেবে তারা খেলাপি রায়তদের তাদের নিজ নিজ কাচারিতে তলব করার ও বকেয়া পরিশোধ না করা পর্যন্ত তাদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে আটকে রাখার, কোন খেলাপি রায়ত তার পরিবার ও সহায়-সম্পত্তি নিয়ে অন্য কোন নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে গেলে ঐ রায়তের গ্রামের সকলের ওপর পাইকারি জরিমানা আরোপের ক্ষমতা লাভ করে। পরগনাপ্রথা অগ্রাহ্য করে জমিদাররা যথেচ্ছভাবে খাজনা বৃদ্ধির ক্ষমতা লাভ করে। সংক্ষেপে, রায়তগণ এতকাল যাবৎ ঐতিহ্যগতভাবে যেসব প্রথাগত অধিকার ভোগ করে আসছিল হফতম সেসব অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে। রায়ত অসহায় কোর্ফা প্রজায় পরিণত হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল আইনের পরবর্তী সংশোধন হয় ১৮১২ সনের ৫নং রেগুলেশনের অধীনে। আইনটি সাধারণ্যে পানজাম বা পঞ্চম নামে পরিচিত। এই রেগুলেশনের আওতায় জমিদারগণ যে কোন মেয়াদের জন্য তাদের জমি ইজারা দেওয়ার অধিকার লাভ করে। ইজারার মেয়াদ ১৭৯৩ সনের আইনে সর্বাধিক দশ বছরের মধ্যে সীমিত ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে বদলে দেয় ১৮১৯ সনের ৮নং রেগুলেশন যা সাধারণভাবে পত্তনি আইন নামে পরিচিত লাভ করে। এই আইনবলে জমিদার ও রায়তের মধ্যবর্তী একটি বহুস্তরবিশিষ্ট মধ্যস্বত্ব শ্রেণী সৃষ্টি করার অধিকার লাভ করে। বাস্তবিকপক্ষে, এ ছিল জমিদারি ক্ষমতার চরম শিখর এবং একই সঙ্গে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল উদ্দেশ্যের ব্যর্থতা। এই আইনের আওতায় জমিদারগণ তাদের খেলাপি পত্তনিদারদের জমি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করার অধিকার লাভ করে, ঠিক যেভাবে সূর্যাস্ত আইনের আওতায় খেলাপি জমিদারের জমি নিলাম হয়ে যেতো।
[সম্পাদনা]উদ্দেশ্য ও ফলাফল
জমিদারদের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদনের কিছু আশু উদ্দেশ্য ছিল। এগুলি হচ্ছে:
- রাজস্ব প্রদায়ক শ্রেণীকে একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি বা বুনিয়াদ দেওয়া এবং রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত করা;
- সরকারকে প্রদেয় একটি নূ্যনতম রাজস্ব সংগ্রহ নিশ্চিত করা;
- রাজস্ব-সংক্রান্ত বিষয় থেকে কর্মকর্তাদেরকে দায়মুক্ত করে তাদেরকে প্রশাসনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত করা; এবং
- জমিদার শ্রেণী ও ঔপনিবেশিক শাসকদের মধ্যে মৈত্রী গড়ে তোলা।
সরকার পুরোপুরি না পারলেও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যগুলি অর্জনে সক্ষম হয়। রাজস্ব প্রদায়ক জমিদার শ্রেণী একটি নির্দিষ্ট ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যায়। সরকার এখন থেকে জানত জমি থেকে বছরে তাদের সঠিক কত রাজস্ব আসছে আর জমিদারও জানতেন সরকারের প্রতি তার চুক্তিগত কি দায়দায়িত্ব রয়েছে। এর আগে অবশ্য সরকার বা রাজস্ব প্রদানকারী কোন তরফই জানত না রাজস্ব সংগ্রহ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে তাদের সঠিক অবস্থানটি কোথায়। রাজস্ব বিক্রয় আইন একটি নূ্ন্যতম পরিমাণ রাজস্ব আদায় সুনিশ্চিত করে যা ইতোপূর্বে ছিল না।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জমিদারদের সাথে আঁতাত গড়ার কাজে আশু সাফল্য আসেনি। এর কারণ, বন্দোবস্তের মূল শর্তাদি জমিদারদেরকে তুষ্ট করতে পারেনি। তবে পরে তাদেরকে অপরিসীম ক্ষমতা দেওয়ার পর এবং দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতির আলোকে সরকারের রাজস্ব দাবি অনেক লঘু হয়ে আসায় ভূ-স্বামী শ্রেণী সূর্যাস্ত আইনের কবল থেকে রক্ষা পায়। এর ফলে সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য বৃদ্ধি পায়। এর প্রমাণ সিপাহী বিপ্লব, স্বদেশী আন্দোলন ও জঙ্গি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকালে সরকারকে জমিদার শ্রেণীর অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদান।
তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দীর্ঘমেয়াদি মহত্তর উদ্দেশ্য ছিল। এই আইন পাশ হওয়ার প্রাক্কালে কাউন্সিল সভার বিভিন্ন কার্যবিবরণী ও পত্রযোগাযোগ লক্ষ্য করলে বিষয়টি পরিষ্পার হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থার প্রণেতারা অনুমান করেছিলেন, এই নতুন পদ্ধতি বলবৎ হলে তা প্রথমে কৃষিখাত ও কৃষিকাজ সংশ্লিষ্ট শিল্পে পুঁজিবাদী পরিবর্তনের সূচনা করবে এবং এর ফলে দেশে একটি শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হবে। আশা করা হয়েছিল, জমিতে স্বত্বাধিকার ও সরকারের চির অপরিবর্তনীয় রাজস্ব দাবির কারণে স্থানীয় জমিদারগণ ব্রিটেনের ভূস্বামীদের মতো উন্নয়নকামী ভূস্বামী হয়ে উঠবেন। মুনাফার প্রেষণা তাদেরকে তাদের উদ্বৃত্ত পুঁজি কৃষির বিভিন্ন খাতে যেমন, আবাদ বা বনজঙ্গল থেকে জমি উদ্ধার, সেচ, নিষ্পাশন ব্যবস্থা নির্মাণ, যোগাযোগ খাত, কৃষিঋণ, উন্নততর বীজ, হাট-বাজার নির্মাণ, মাছ চাষ, গবাদি পালন ইত্যাদিতে বিনিয়োগে উৎসাহ যোগাবে। প্রত্যাশা ছিল, কৃষিখাতে পরিবর্তন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে রূপান্তরের সূচনা করবে আর এভাবে এসব পরিবর্তন সম্মিলিতভাবে অভিশুল্ক ও করের আকারে সরকারের আয় বরাবর বাড়াতে থাকবে। মনে করা হয়েছিল, জমিদারদের কাছে রাজস্ব দাবি চিরকালের মতো নির্দিষ্ট করে দিয়ে সরকার আগে দীর্ঘমেয়াদে যে ইচ্ছাকৃত ক্ষতি স্বীকার করেছিল এ ধরনের পরিস্থিতি তা বেশ ভালভাবে পুষিয়ে দেবে।
কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেপথ্যে শাসকদের যে দীর্ঘমেয়াদি প্রত্যশা ছিল তা বাস্তবায়িত হয়নি। নতুন-পুরানো কোন স্থানীয় জমিদারই কখনও ব্রিটেনের জমিদারদের মতো উন্নতিমুখী জমিদার হয়ে উঠেনি। গ্রামবাংলার দৃশ্যপট বদলানোর ক্ষেত্রে জমিদারদের ব্যর্থতা সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই। তবে জমিদারগণ কেন এরকম আচরণ করলেন সে বিষয়ে তাদের মধ্যে দারুণ মতপার্থক্য রয়েছে। পুঁজি সংগঠনমূলক উপকরণের সাহায্যে জমির উন্নতিবিধান না করে তারা বরং মহাজনি বিনিয়োগ, খাদ্যশস্যের ব্যবসায়, নতুন তালুক ক্রয়, বন্ড, উপ-কর, শহরের বিষয়-সম্পত্তি, রায়তদের খাজনা বৃদ্ধি ও তাদের ওপর আবওয়াব বা অবৈধ উপ-কর আরোপ ইত্যাদিতে নিয়োজিত হন। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জমিদারদের এ ধরনের আচরণ যুক্তিসঙ্গত ছিল এই কারণে যে, পুঁজিবাদী বিনিয়োগের চেয়ে সামন্তবাদী শোষণ ছিল অধিকতর লাভজনক। জমিতে বিনিয়োগ কম মুনাফাজনক ও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে জমিদারদের তাদের পুঁজি জমিতে বিনিয়োগ করার কোন অর্থনৈতিক যুক্তি ছিল না। পক্ষান্তরে, ইংল্যান্ডে সে সময় কৃষিকে উৎসাহিত করার জন্য একটা শক্তিশালী শিল্পখাত গড়ে উঠেছিল। আর সেই সাথে ঐ দেশের সরকার দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা ও জমিমালিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাংলার ঔপনিবেশিক পরিস্থিতিতে, জমিদারগণ সে ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। কৃষি খাতে উন্নতি বা প্রবৃদ্ধির জন্য শিল্পায়নের প্রয়োজন অপরিহার্য। বাংলার কৃষি অর্থনীতি কোম্পানি শাসনে এ সুবিধা হারায়, কেননা এ দেশের শিল্পের ক্ষেত্রে যে বিরাট ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল তাদের আমলে তা ধ্বংস হয়। ব্রিটিশ শাসনের আওতায় বারংবার দুর্ভিক্ষ, আকাল, দ্রব্যমূল্যের উঠানামা, স্থানীয় শিল্পের বিলুপ্তি, বিত্ত অপচয়মূলক বৈরি কারণ ইত্যাদি থেকে বাংলার কৃষি খাত কখনও মুক্ত থাকতে পারে নি। এ ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতি পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে অপচয়কারী ভোগবাদী সামন্ত মানসিকতা গড়ে উঠারই অনুকূল ছিল। বাংলার জমিদারশ্রেণী সে মানসিকতার বাস্তব প্রমাণও দিয়েছে।
সামন্ত মূল্যবোধের সবচেয়ে রেখাপাতযোগ্য যে বৈশিষ্ট্যটি জমিদারগণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরপরই অচিরে অর্জন করেন তা হলো তাদের অনুপার্জিত আয়ে জীবন নির্বাহ করা। একটা বার্ষিক নির্ধারিত অঙ্কের অর্থপ্রাপ্তির বিনিময়ে তারা তাদের জমিদারির ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ পাকাপাকিভাবে আরেক মধ্যস্বত্বাধিকারী শ্রেণীর হাতে ছেড়ে দেন। অর্থাৎ জমির নিরঙ্কুশ একচ্ছত্র স্বত্বাধিকারী হিসেবে জমিদাররাও আরেকটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করলেন মধ্যস্বত্বাধিকারীর সঙ্গে। জমিতে কোন মূলধন বিনিয়োগের দাবির ভিত্তিতে নয় বরং ঐ জমিতে চিরস্থায়ী স্বত্বাধিকারের বলেই জমিদাররা চিরস্থায়ী মধ্যস্বত্ব সৃষ্টি করে। স্থায়ী অধিকার লাভের ফলে এই নতুন মধ্যস্বত্বাধিকারীরাও আবার উপবন্দোবস্ত দিতে থাকে। আর এভাবে ভূ-স্বত্বে একের নিচে আরেক পর্যায়ক্রমিক স্তর তৈরি হতে থাকে, কোন কোন ক্ষেত্রে তা কয়েক স্তরে পৌঁছায়। বাকেরগঞ্জে এরকম পনেরটি স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়।
এভাবে ভূমি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সোপানক্রমিক মধ্যস্থ শ্রেণীর আবির্ভাবের সুগভীর আর্থসামাজিক তাৎপর্য ছিল। রাজস্ব জরিপ (আনু. ১৮৬০-১৮৭০) এবং জরিপ ও বন্দোবস্ত কার্যক্রমের (আনু. ১৮৮৬) রেকর্ডপত্র থেকে দেখা যায়, যেসব জমিদার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে তাদের পরবর্তী মধ্যস্বত্বশ্রেণী ভূমি ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছিল তাদের প্রায় সকলেই পুরানো জমিদার। মধ্যস্বত্ব মানে প্রজার ওপর খাজনার অতিরিক্ত চাপ। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, জমিদার ও মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্তধারীর অধিকারের স্থিতি এবং খাজনার চড়াহার ও মধ্যস্বত্ব পরস্পর-সম্পর্কিত। মধ্যস্বত্ব বন্দোবস্তের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এটি হলো, এ যাবৎকালের বনজঙ্গলময় এলাকায় আবাদি জমির সম্প্রসারণের প্রয়াসে এ ধরনের বন্দোবস্তধারীদের ইতিবাচক ভূমিকা।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলগুলিতে বিস্তীর্ণ এলাকার জলাজঙ্গলাকীর্ণ জমি আবাদ করে ফসল ফলানোর কাজটি ছিল প্রধানত এই মধ্যস্থ শ্রেণীর বন্দোবস্তধারীর কৃতিত্ব। এরাই তাদের পুঁজি সংগঠন ও জনশক্তি খাটিয়ে এই জমির আবাদ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেয়। তবে মধ্যস্বত্বভোগীর উৎপাদনশীল ভূমিকা বিশ শতকের শুরুতে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, তখন আর পরিষ্পার ও পুনরুদ্ধারের জন্য আর কোন খালি জমি অবশিষ্ট ছিল না। তাই এর সাথে সাথে রায়তদের ঠিক উপরের স্তরটি ছাড়া সকল শ্রেণীর মধ্যস্থ বন্দোবস্তধারীর ভূমি ব্যবস্থাপনায় আর কোন ভূমিকা ছিল না। ফলে এরা নিতান্তই চাষির ফসল ও অন্যান্য উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল এক পরজীবীতে পরিণত হয়।
[সম্পাদনা]চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবক্ষয়
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলবৎ করার অব্যবহিত পরেই জমিদারের শক্তি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দেয়। এর পরে একটা সময়ের জন্য এ ব্যবস্থায় স্থিতি বিরাজ করে। এমনকি, জমিদার শ্রেণীর একটা তুলনামূলক সমৃদ্ধিও দেখা দেয়। কয়েক দফা আইনে (১৭৯৫-এর ৩৫ নং প্রবিধান, ১৭৯৯-এর ৭ নং প্রবিধান, ১৮১২ সনের ৫ নং প্রবিধান এবং ১৮১৯-এর ৮ নং প্রবিধান) প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ক্ষমতাবলে জমিদারগণ তাদের খাজনা বৃদ্ধি ও দ্রুত আদায়ের অধিকার লাভ করেন। রাজস্ব বকেয়া থাকার কারণে জমিদারি তালুকের প্রকাশ্য বিক্রয় ১৮২০ সনের পর থেকে বিরল ঘটনা হয়ে ওঠে। ১৮১৩ সনে বাংলা অবাধ বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর এখান থেকে প্রাথমিক পণ্যাদি আরও বেশি পরিমাণে রপ্তানি হতে থাকে ও জমিদারি আয়ের ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সেই কারণে কৃষি সম্প্রসারণ, বাণিজ্যিক জাতের ফসলের আবাদ ও মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী গতি এ সবই জমিদারি অর্থনীতিতে অনুকূল প্রভাব ফেলে।
তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জমিদার শ্রেণীর সমৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকদের জীবনে অনুরূপ সমৃদ্ধি আসে নি। চাষির উদ্বৃত্ত সম্পদ জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও নানা ধরনের চাঁদা যেমন, আবওয়াব, তুহুরি, দস্তরি, ভেট, নজরানা, বেগার , সালামি ইত্যাদি রূপে পরিকল্পিতভাবে শোষণ করে। ফলে চাষিরা শুধু খাজনা পরিশোধ ও জীবন ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন সেই পরিমাণ উৎপাদন করে যেতে থাকে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্ব পর্যায়ের পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাথে বাংলা সম্পর্কিত হবার পর, পল্লী জনপদের জীবনধারণ ও অর্থনীতি আরও প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে। বাংলার প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে, পূর্ববঙ্গে ১৮৫০-এর দশকের শেষভাগ থেকে কয়েক দফা কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এ ছিল জমিদার ও রায়তদের মধ্যে ক্ষুণ্ণ সম্পর্কের সবচেয়ে প্রত্যক্ষ বহিঃপ্রকাশ। প্রথমে সাঁওতাল পরগনায় কৃষক গোলযোগ (১৮৫৫) দিয়ে এই সঙ্কটের সূচনা ঘটে। এরপর নীল চাষ হয় এমন সব জেলায় দেখা দেয় নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬১)। ১৮৫৮ সন থেকে ১৮৬০ সন পর্যন্ত নীল প্রতিরোধ আন্দোলন চলে। ১৮৭০-এর দশক ও ১৮৮০-র দশকের প্রথমভাগে কৃষক প্রতিরোধ উদ্বেগজনক মোড় নেয়। এই সময় বাংলার কোন কোন এলাকায় চাষিরা জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ও জমিদারদের উদ্বৃত্ত শোষণ নূ্যনতম করার লক্ষ্যে একত্রে জোট নাঁধে। এই আমলে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য কৃষক আন্দোলনগুলি হলো তুষখালি (বাকেরগঞ্জ) কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫), পাবনা কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৩), ময়মনসিংহ উপজাতীয় কৃষক আন্দোলন (১৮৭৪-১৮৮২), মুন্সীগঞ্জ (ঢাকা) কৃষক আন্দোলন (১৮৮০-৮১) ও মেহেন্দীগঞ্জ (বাকেরগঞ্জ) কৃষক বিদ্রোহ (১৮৮০-৮১)। ফরায়েযীরা (মুসলিম সংস্কারবাদী একটি সম্প্রদায়) কৃষক স্বার্থের পক্ষে ভূমিকা গ্রহণ করে এবং গোটা দেশজুড়ে, বিশেষ করে, দক্ষিণ বাংলায় জমিদারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ব্যাপক গোলযোগ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধ আন্দোলনরত চাষি জোটগুলির অভিন্ন দাবি ছিল জমিতে রায়তের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
এসব বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ আন্দোলনের কারণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার অবক্ষয় শুরু হয়। স্বত্বাধিকারী তথা জমির মালিক শ্রেণীগুলি রায়ত বা প্রজাদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। রায়তগণ জমিতে তাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়। জমিদারগণ বিদ্রোহী রায়তদের সামাল দিতে না পেরে তাদের শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে সরকারের সাহায্য, এমনকি, প্রয়োজনে বিদ্রোহ শান্ত করার জন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্য চায়। উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য রক্ষার কারণে এর প্রয়োজন দেখা দেয়। কৃষকদের প্রতিবাদ-আন্দোলন সম্পর্কিত প্রায় সকল সরকারি প্রতিবেদনে জমিদার শ্রেণীর দুর্বল অবস্থার কথা, বিশেষ করে, এর দারিদ্রাবস্থার উল্লেখ করা হয়। উত্তরাধিকার আইনের কারণে তালুকগুলির বিভক্তি ও পুনর্বিভাজন ঘটে। এছাড়াও পারিবারিক কলহ, বিবাদ-বিসম্বাদ, জমিদারিতে অনুপস্থিতির প্রবণতা, মধ্যস্থ বন্দোবস্ত সৃষ্টি, স্বত্বাধিকারীর অকাল মৃত্যু, ব্যয়বাহুল্য ও সম্পর্কিত আরও নানাবিধ কারণে জমিদার শ্রেণী কাঠামোটি অবক্ষয়ের কবলে পড়ে। উনিশ শতকের প্রথম ২৫ বছরে মধ্যস্বত্ব বা মধ্যস্থ বন্দোবস্তধারী ব্যক্তিদের অবয়বে এক অবস্থাপন্ন ও প্রত্যয়ী আবাদি মধ্যবিত্ত শ্রেণী, জোতদার, হাওলাদার ও অন্যান্য বিত্তবান কৃষকের একনাগাড়ে আবির্ভাব ঘটতে থাকে।
[সম্পাদনা]খাজনা আইন ১৮৫৯
- মূল নিবন্ধ: খাজনা আইন ১৮৫৯
খাজনা আইন ১৮৫৯ পরিস্থিতি এগিয়ে চলার মুখে কৃষক সমাজকে, বিশেষ করে, স্বত্বাধিকারী ধনী চাষিদের আর উপেক্ষা করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হলো না। সিপাহি বিপ্লব ও তার কাছাকাছি সময়ে অনুষ্ঠিত নীলচাষিদের বিদ্রোহজনিত গোলযোগের কারণে পল্লী জনপদের স্বার্থ আরও উপেক্ষিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে সরকার সজাগ হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যিক প্রয়োজনে অনুগত জমিদারদের রক্ষার তাগিদ ছিল জরুরি। যুগপৎ প্রতিবাদী কৃষককুলকে রক্ষাও হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। এই উপলব্ধির স্থির প্রকাশ ঘটে ১৮৫৯ সনে খাজনা আইন পাশ হওয়ার মধ্যে। এই আইনে অন্তত কোন কোন শ্রেণীর রায়তের অধিকারের স্বীকৃতি দানের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। রায়তদেরকে ঐতিহ্যগত ধারায় খুদকশ্তস্ত ও পাইকাশতা নামে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো। এখন এসবের পরিবর্তে চাষিসমাজকে আইনগতভাবে ও খাজনা আইনের আওতায় তিনটি বর্গে বা গ্রুপে বিভক্ত করা হয়। এগুলি হলো:
- পাইকাশতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ৩নং ধারা অনুযায়ী নির্ধারিত হারের খাজনায় জমিরক্ষক রায়ত;
- ভূমি দখলে রাখার রায়ত অর্থাৎ ১২ বছরেরও বেশি সময় জমিতে দখলদার রায়ত (৬ নং ধারা), এবং
- জমিতে দখলাধিকার নেই এমন রায়ত।
এই রায়তদের নিয়ন্ত্রণের জন্য খাজনা পাট্টা পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। এখন থেকে খাজনা পরিশোধের বিষয়টি পাট্টার শর্তাবলি দ্বারা নির্ধারিত হতে থাকে। এতে বার্ষিক খাজনার পরিমাণ (নগদ বা বস্তুতে) নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় যার অতিরিক্ত কোন আবওয়াব আরোপের অধিকার জমিদারদের রইল না। এ ধরনের আবওয়াব আরোপ এখন থেকে দণ্ডযোগ্য অপরাধ (২নং ধারা) বলে গণ্য হয়। হফতম আইনে (১৭৯৯-এর ৭নং প্রবিধান) জমিদারগণ প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী যেকোন শ্রেণীর রায়তকে কাচারিতে হাজির হতে বাধ্য করতে ও খাজনা খেলাপি হবার জন্য তাদেরকে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করতে পারতেন (১১ নং ধারা)। জমিদারগণ তাদের এই ক্ষমতা থেকেও বঞ্চিত হয়। খাজনা আইনের আওতায় জমিদার কর্তৃক প্রথম শ্রেণীর (কায়েমি) রায়তদের যাদের খাজনা চিরস্থায়িভাবে নির্দিষ্ট তাদের খাজনা বৃদ্ধি নিষিদ্ধ করা হয়। জমিদারি বিনিয়োগ, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণ প্রদর্শন না করে দখলদার রায়তের খাজনা বৃদ্ধির ক্ষমতাও জমিদাররা হারান। অ-দখলদার রায়তের জমির ঘন ঘন খাজনাও বৃদ্ধি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ঐ সময় নাগাদ সরকারি সমর্থনের ওপর অতি নির্ভরশীল জমিদারদের এই খাজনা আইনের বিরোধিতা করার মতো সাহস ছিল না। তবে তারা এই আইন উপেক্ষা করার চেষ্টা করে। তারা ভাল করেই জানতো যে আইন মানেই তা সর্বদা বলবৎ-যোগ্য নয়। তারা আগের মতোই জমির খাজনা বাড়িয়ে যেতে থাকে। এরপরও খেলাপি রায়তদের আগের মতোই কাচারিতে ডেকে নিয়ে বকেয়া আদায়ের জন্য তাদের ওপর নির্যাতন চলতে থাকে। দখলিস্বত্বও সচরাচর অস্বীকার করা হয়। ফলে জমিদার ও প্রজার সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটে, যার ব্যাপ্তি বোঝা যায় ১৮৭০ এবং ১৮৮০ দশকের ব্যাপক কৃষক অসন্তোষ থেকে।
[সম্পাদনা]বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫
- মূল নিবন্ধ: বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫
বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন ১৮৮৫ ১৮৭০-এর দশকের ক্রমবর্ধমান কৃষক অসন্তোষ সরকারের জন্য আর্থরাজনৈতিক কারণে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। ১৮৭৯ সনে জমিদার-প্রজার (রায়ত/চাষি) মধ্যকার উত্তেজনাকর সম্পর্কের বিষয়ে তদন্ত করে ও সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রতিকারমূলক সুপারিশমালা পেশ করার জন্য একটি খাজনা কমিশন গঠিত হয়। এই খাজনা কমিশনের প্রতিবেদন সূত্রেই ১৮৮৫ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের উদ্ভব ঘটে। এই আইনে প্রথমবারের মতো জমির সর্বোচ্চ স্বত্বাধিকারী থেকে শুরু করে সর্বনিম্নস্তরে জমিচাষি অর্থাৎ জমিতে স্বার্থধারী বিভিন্ন পক্ষের অধিকারগুলি সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস নেওয়া হয়। বাস্তবিকপক্ষে, এই আইন জমিদারের ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট ছঁাটাই করে দেয়।
বঙ্গীয় খাজনা আইন নিঃসন্দেহে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল কাঠামোতে যথেষ্ট পরিবর্তন আনয়ন করে। এখন থেকে জমিদার জমিতে অন্যতম স্বার্থগোষ্ঠী হয়ে ওঠেন মাত্র, যদিও তিনি সব স্বার্থধারীর চেয়ে তুলনামূলকভাবে উন্নততর স্বার্থধারী হিসেবেই থেকে যান। তবে এবার আইন বাস্তবায়ন তথা বলবৎ করার বিষয়ে সরকার আন্তরিকতা প্রদর্শন করেন। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের বাস্তবায়ন নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করা হয় ও দেখা যায় যে, এই আইন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে দেশের পল্লী অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে।
১৯২০-এর দশকে আবার কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। ১৯১৯ সনের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রার্থীদের গণসংযোগের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক ছিল। এই প্রয়োজনের তাগিদে সকল বড় রাজনৈতিক দল তাদের নিজ নিজ দলীয় সংগঠনের কৃষক শাখা প্রতিষ্ঠা করে। কৃষক শাখাসংগঠনগুলি কৃষি খাতে যেসব সমস্যা চাষিদের বিপর্যস্ত করছে সেগুলি সম্পর্কে তাদেরকে সজাগ ও সচেতন করে তুলতে চেষ্টা করে। এভাবে রায়ত বা প্রজারা বামপন্থী সংগ্রামী-কর্মীদের দ্বারা সক্রিয় ও অধিকারসচেতন হয়ে ওঠে। তারা বুঝতে পারে যে, এখনও তারা জমির গাছ কাটা, একটা নির্ধারিত মেয়াদের বেশি সময়ের জন্য জমি বন্ধক রাখা, জমি স্বত্বাধিকারীর অনুমতি ছাড়া জমি হস্তান্তর, কোন পাকা কাঠামো নির্মাণ, পুকুর খনন ইত্যাদির ব্যাপারে বঞ্চিত রয়ে গেছে। এ সমস্ত কাজের জন্য জমিদারের অনুমোদন প্রয়োজন হতো আর বলাবাহুল্য, সালামি পরিশোধ ছাড়া এতে জমিদারের অনুমোদন পাওয়া যেত না। ১৯২৮ সনে সংশোধনী এনে এসব ক্ষেত্রে প্রায় সকল বিধিনিষেধ দূর করা হয়। সংশোধিত আইনের আওতায় রায়তগণ জমিদারের অনুমতি ছাড়াই তাদের জমি হস্তান্তরের অধিকার লাভ করে, তবে হস্তান্তরের জন্য জমিদারকে সালামি প্রদানের বিধান বহাল থেকে যায়। জমিদারের ঐ জমি কেনার অগ্রাধিকারও বহাল থাকে। চাষিরা জমিদারের অনুমতি ছাড়াই তাদের জমিতে গাছ ও পুকুর কাটা এবং পাকা কাঠামো নির্মাণের অধিকার লাভ করে।
- মূল নিবন্ধ: ভারত শাসন আইন ১৯৩৫
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান ১৯৩৫ সনের ভারত শাসন আইন পাশ ও এ আইনের বাস্তবায়ন পর্যায়ে কৃষক রাজনীতি নতুন করে উদ্দীপিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল চাষিদের সমস্যাগুলিকে শানিত করে তোলে। কৃষক প্রজা পার্টি নামে এক নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। এই দলের দৃঢ অঙ্গীকার ছিল প্রধানত প্রজা শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা। এ দলের নেতা এ.কে ফজলুল হক অঙ্গীকার করেন, তিনি কখনও ক্ষমতায় গেলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা পুরোপুরি বিলুপ্ত করবেন। ১৯৩৭ সনে তিনি বাংলার সরকার গঠন করেন। অচিরেই হক মন্ত্রিসভা ভূমি রাজস্ব কমিশন নামে একটি কমিটি (সাধারণভাবে, ফ্লাউড কমিশন নামে পরিচিত) গঠন করেন। এ কমিশনের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার অবসান ঘটানো। অবশ্য এই কমিশনের কাছ থেকে সুপারিশ পাওয়ার অপেক্ষায় না থেকে হক মন্ত্রিসভা তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর নূ্যনতম সন্তুষ্টির জন্য ১৯৩৮ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে আরেকটি সংশোধনী (৬নং আইন) আনয়ন করে। এর আওতায় সালামি ব্যবস্থা ও রায়তি জমি হস্তান্তরের বেলায় জমিদারের ক্রয়াগ্রাধিকার বিলুপ্ত করা হয় এবং বর্গাদার বা ভাগচাষিদের কোন কোন অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৩৮ সনের ৬নং আইনবলে প্রজারা তাদের জমির কার্যত স্বত্বাধিকারী হয়ে ওঠেন।
[সম্পাদনা]ফ্লাউড কমিশন ১৯৪০
- মূল নিবন্ধ: ফ্লাউড কমিশন ১৯৪০
ফ্লাউড কমিশন ১৯৪০ সনে তার প্রতিবেদন পেশ করে। কমিশন লক্ষ্য করে যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে জমিদারি ব্যবস্থা আর বহাল রাখা যায় না। তারা এই জমিদারি ও সেইসাথে জমিতে খাজনা আদায়কারী সকল মধ্যস্থ স্বার্থধারী পক্ষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার সুপারিশ করে। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রজাস্বার্থের প্রবক্তা ফজলুল হক রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় এই সাহসিক কাজটি সম্পূর্ণ করতে পারেন নি। ফলে ফ্লাউড কমিশন রিপোর্ট অবাস্তবায়িত থেকে যায়।
উত্তরবঙ্গের তেভাগা আন্দোলন এর (১৯৪৬-৪৭) ঘটনাপ্রবাহ সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাতীয়তাবাদী বা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মহলের চেয়ে নিপীড়িত কৃষককুলই অনেক বেশি ভূমি সংস্কারের পক্ষপাতী ছিল। ব্যাপক তেভাগা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলা সরকারের তৎকালীন প্রধান হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী আইন হিসেবে অনুমোদন করানোর জন্য ১৯৪৭ সনের গোড়ার দিকে দুটি বিল আইনসভায় আনয়ন করেন। বিলদুটি হলো জমিদারি (তালুক) অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব বিল এবং বঙ্গীয় বর্গাদার (বিধান) বিল। এর উদ্দেশ্য ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলুপ্তি ও বর্গাদারদের অবস্থানগত মর্যাদার উন্নতি বিধান করা। দেশ বিভাগের রাজনীতির কারণে বিল দুটি শেষ পর্যন্ত আইনে পরিণত করা যায় নি। অবশ্য দেশবিভাগের পর এই বিলগুলিই এক নতুন বিল আকারে পেশ করা হয়। বাংলাদেশে এই বিলের নাম দেওয়া হয় পূর্ববঙ্গীয় জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব বিল, ১৯৪৮। ঐ বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিলটি ১৯৫০ সনের পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন এ পরিণত হয়। এই আইনের আওতায় শেষ পর্যন্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার অবসান ঘটে। এখন থেকে রায়ত বা প্রজাগণ জমির মালিক বা স্বত্বাধিকারী হিসেবে অভিহিত হয়। আর সরকারের প্রজা হিসেবে সরকারকেই তারা সরাসরি খাজনা প্রদান করতে থাকে।
[সম্পাদনা]আরও পাঠ্য
- The History of India, vol 2, T.G.Percival Spear, Penguin (1990) ISBN 0-14-013836-6
- India: A History, John Keay, Grove/Atlantic (2001) ISBN 0-8021-3797-0
- A rule of property for Bengal: an essay on the idea of permanent settlement, Ranajit Guha, Durham, Duke U Press (1996)ISBN 0-8223-1771-0
[সম্পাদনা]তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ
খণ্ডিত দেশ, বিভক্ত জাতি ও অবলুপ্ত বিবেকইকতেদার আহমেদ | |||||||||||||||||||
বাংলা ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত একটি অঞ্চল। বাংলায় মূলত বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে বাংলা পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সৌম্ম, বজ্র, তাম্রলিপ্তি, সমতট, বঙ্গ প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত ছিল। এ জনপদগুলোর প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র ও পৃথক ছিল। শশাঙ্ক ও লক্ষণ সেন এ জনপদগুলোকে একীভূত করার চেষ্টা করলেও তারা কেউ সফলতা পাননি। মুঘল শাসন-পূর্ববর্তী বাংলা কখনও এককভাবে একজনের শাসনাধীন ছিল না। মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা সমন্বয়ে সুবা বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আলীবর্দি খাঁকে শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। আলীবর্দি খাঁর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র সিরাজ-উদ-দৌলা সুবা বাংলার শাসনভার লাভ করেন। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাভূত করার মাধ্যমে ইংরেজরা এ উপমহাদেশে তাদের ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়াপত্তন করেন, যা পরে ১০০ বছরের ব্যবধানে দিল্লি দখলের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা পায়। ইংরেজ আমলে বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সমন্বয়ে গঠিত বাংলা পূর্ণতা পায়, যদিও এটি মুঘল প্রবর্তিত সুবা বাংলার খর্বকৃত রূপ। বাংলায় বিগত এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠী পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের মাধ্যমে বসবাস করে আসছিল। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ কর্তৃক প্রথমত বাংলা ও পরবর্তী সময়ে সমগ্র ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা দখল-পূর্ববর্তী ভারতে কখনও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায় না। মূলত ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশরা তাদের চিরাচরিত নিয়ম বিভাজন ও শাসনের (উরারফব ধহফ জঁষব) মাধ্যমে ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভাগ-পূর্ববর্তী বাংলায়ও এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হিংস রূপ পরিলক্ষিত হয়। ইংরেজরা মুসলিম শাসককে পরাভূত করে বাংলার শাসনক্ষমতা লাভ করায় এ অঞ্চলে তাদের আগমনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে বাংলায় বসবাসকারী অপর ধর্র্মীয় সম্প্রদায় হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্রিটিশদের আনুকূল্য পেতে থাকে। এতে করে পূর্ব থেকে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ মুসলমানরা এ অঞ্চলে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে। এর ফলশ্র"তিতে দেখা যায় কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলায় শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হাতে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন ইংরেজ শাসকরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় যে, একই জাতিভুক্ত মুসলিম সম্প্রদায় হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে তুলনামূলকভাবে সব ক্ষেত্রে অনগ্রসর তখন তারা অনেকটা মুসলমানদের দাবির মুখে অনগ্রসর, মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের হিন্দুদের সমকক্ষ বা কাছাকাছি নিয়ে আসার মানসে বাংলাকে বিভাজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলার এ বিভাজন ১৯০৫ সালে কার্যকর হয় এবং এ বিভাজনের ফল হিসেবে পূর্ব বাংলা ও আসাম সমন্বয়ে একটি পৃথক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে একজন ল্যাফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়োগ দেয়া হয়। এ বিভাজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এ বিভাজন মেনে নিতে পারেননি। তাই বিভাজন-পরবর্তী এ বিভাজনকে রদ করার জন্য তারা চূড়ান্ত আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। বঙ্গভঙ্গ দ্বারা তৎকালীন বাংলার সাহিত্যাঙ্গনের পুরোধা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতই ব্যথিত হয়েছিলেন যে, ক্ষোভ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হƒদয়ে বাংলার প্রতি ভালোবাসার অভিব্যক্তিতে বঙ্গভঙ্গের বছরই আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গানটি রচনা করেন। আমার সোনার বাংলা গানটি বাংলার অখণ্ডতা অক্ষুণœ রাখার নিমিত্তে রচিত। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস এ গানটি খণ্ডিত বাংলার অর্থাৎ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। বাংলাদেশের মানুষের এ উদারতা কি এক জাতিসত্তার ভিত্তিতে একক দেশ বিনির্মাণে রবীন্দ্রনাথের আকাক্সিক্ষত আগের অখণ্ডতা ফিরিয়ে দিতে পারবে? পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একই ভাষাভাষী এবং একই জাতিগোষ্ঠী কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্মীয় ভিত্তিতে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত। ভারতবর্ষভুক্ত বাংলা ও পাঞ্জাব ভারতবর্ষ বিভাজনের সময় ধর্মীয় ভিত্তিতে বিভাজিত হয়। এরপর দেখা যায় ভারতভুক্ত পাঞ্জাব পুনঃহিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীদের প্রাধান্য বিশিষ্ট অঞ্চল নিয়ে পুনঃবিভাজিত হয়। পৃথিবীর যেসব রাষ্ট্র রাজনৈতিক কারণে বিভাজিত হয়েছিল তš§ধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জার্মানি, ভিয়েতনাম ও কোরিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী মিত্রশক্তির বিজয়ের পর পরাভূত জার্মানিকে বিভাজিত করে এর এক অংশ পশ্চিম জার্মানি নাম ধারণ করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয় আর অপর অংশ পূর্ব জার্মানি নাম ধারণ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন অনুসারী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রভুক্ত হয়। জার্মানির এ রাজনৈতিক বিভাজন দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে উভয় জার্মানি একীভূত হয়ে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জার্মানির মতো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রভাবে ষাটের দশকে ভিয়েতনাম উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম এ দুটি নামে বিভক্ত হয়ে দুটি পৃথক রাষ্ট্ররূপে আÍপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু সে বিভাজনও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। মার্কিন মদদপুষ্ট পুঁজিবাদের সমর্থক উত্তর ভিয়েতনাম কমিউনিস্টপন্থী দক্ষিণ ভিয়েতনামের কাছে পরাভূত হলে উভয় ভিয়েতনাম একীভূত হয় এবং বর্তমানে একীভূত ভিয়েতনাম এশিয়ার সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। পঞ্চাশ দশকে রাজনৈতিক মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে কোরিয়া দ্বিধাবিভক্তি হলেও আজ অবধি সে দ্বিধাবিভক্তি অক্ষুণœ থাকায় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া নামক রাষ্ট্র দুটি যথাক্রমে কমিউনিস্ট ও পুঁজিতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অনুসরণ করে চলছে। বঙ্গভঙ্গ রদ-পরবর্তী তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের রদের ক্ষতিগ্রস্তের সান্ত্বনাস্বরূপ ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। কিন্তু এ ঘোষণা-পরবর্তী সময়ে দেখা গেল পশ্চিম বাংলার হিন্দু কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিকদের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথও বিভিন্ন সভা-সমাবেশে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকেন। ব্রিটিশরা তাদের পূর্ব প্রতিশ্র"তি অনুযায়ী যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যান এবং এর ফলশ্র"তিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। আমাদের আজকের বাংলাদেশের ভিত রচিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে এবং সে ধর্মীয় জাতিসত্তার অনুসরণে ভারত বিভক্তির সময় পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তান নাম ধারণ করে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও রাজনৈতিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক এবং পৃথক জাতিসত্তার কারণে পরবর্তী সময় এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ নামে অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ ভারত থেকে যেভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিল, পরবর্তীকালে দেখা গেল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে ভারত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সেভাবে এগিয়ে আসেনি। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অল্পস্থান ব্যতীত বাংলাদেশ তার পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম সীমান্ত স্থলে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা ও আসাম রাজ্যে বিপুল সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষীর বাস। বাংলাদেশের স্থলসীমানার অপর অংশের অধিকাংশ মানুষ একই জাতিসত্তাভুক্ত হওয়ার কারণে, প্রাচীনকাল থেকেই উভয় অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও পারস্পরিক লেনদেন অব্যাহত ছিল। এর ধারাবাহিকতায় উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য অব্যাহত থাকে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের যে সম্ভাবনা রয়েছে তা শতভাগ কার্যকর করা গেলে উভয় দেশের অর্থনীতি যে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পরিতাপের বিষয় যে, বাংলাদেশের সামগ্রিক বৈদেশিক বাণিজ্যের একটি ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশের প্রতিকূলে ভারসাম্যহীনভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে সমতার পর্যায়ে আনা গেলে বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক দিক থেকে একটি সম্ভাবনার দেশে পরিণত হবে সে বিষয়টি অনুধাবন করলে দেখা যায় বাণিজ্য বৈষম্য দূরীকরণে ভারতের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেখা গেছে যখনই বাংলাদেশের কোন পণ্য গুণ ও মানে উৎকর্ষ এবং প্রতিযোগী মূল্যের কারণে ভারতের বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করছে ঠিক তখনই অশুল্ক বাধা আরোপের মাধ্যমে পণ্যের দাম এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে একদিকে ভারতের আমদানিকারক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমদানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, অপরদিকে পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে যায়। দেশের সচেতন জনগোষ্ঠীর প্রশ্ন, আমাদের একশ্রেণীর রাজনীতিকের দাবি অনুযায়ী ভারত আমাদের সৎ প্রতিবেশী হয়ে থাকলে কেন দীর্ঘদিন ধরে স্থল ও সমুদ্র সীমানা বিরোধ পারস্পরিক মতৈক্যের ভিত্তিতে নিরসন হচ্ছে না, কেন অসম বাণিজ্য বৈষম্য দূরীকরণে ভারতের পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না, কেন কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অবমাননাকরভাবে আমাদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে? কেন আমাদের স্থলসীমান্তের চতুর্পাশে ১৩২টি মাদক পর্যায়ভুক্ত ফেনসিডিল কারখানা স্থাপন করে মাদকের চালান প্রবেশে উৎসাহিত করা হচ্ছে, কেন অভিন্ন নদীসমূহের সুষম পানির হিস্যা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, কেন অযৌক্তিকভাবে শুল্ক ব্যতিরেকে আমাদের কাছ থেকে স্থল ট্রানজিট দাবি করছে এবং কেন নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে সম্পাদিত আমাদের স্থল ট্রানজিট চুক্তি কার্যকর হতে দিচ্ছে না? ভারত বরাবরই দাবি করে আসছে আমাদের এ দেশ থেকে অহরহ তাদের দেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটছে এবং পাচারকারীরা তাদের দেশ থেকে অবৈধভাবে গরুসহ অন্যান্য পণ্য নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। এ যুক্তিতে প্রায়শই ভারতের সীমান্ত রক্ষী গুলি ছুড়ে বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করছে। ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা যে পণ্যটি আমাদের অর্থনীতি ও যুবসমাজের ব্যাপক ক্ষতি করছে সেটি হচ্ছে মাদক পর্যায়ভুক্ত ফেনসিডিল। কিন্তু বিগত ৪০ বছরে ভারত কি একটি উদাহরণ দেখাতে পারবে ভারত থেকে বাংলাদেশ ফেনসিডিল পাচার করতে গিয়ে সীমান্ত রক্ষীদের গুলিতে নিহতের ঘটনা ঘটেছে? ভারত বিভাগের সময় পূর্ব বাংলায় কোন কলকারখানা না থাকায় এ অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত যে অঞ্চল নিয়ে পূর্ব বাংলা গঠিত তার এককভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ছিল না। যে কারণে অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আসাম ব্যতীত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের জনগণের কঠোর পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ শিল্প-কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি সাহিত্য, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, উপন্যাস, কবিতা, গান প্রভৃতিতে এক কথায় বলতে গেলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উন্নতি অগ্রবর্তী সাধন করেছে। আমাদের এ অগ্রগতিতে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের উল্লসিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি সে ধরনের কোন উল্লাস দেখছি, না বিপরীতধর্মী কিছু দেখছি তা দু-চারটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমাদের দেশে ভারতের ৪০টিরও বেশি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার অব্যাহত আছে। কিন্তু আমাদের নিজেদের দু'ডজনেরও অধিক টিভি চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও আজ অবধি আমাদের একটি চ্যানেলকেও সে দেশে সম্প্রচারের অনুমতি দেয়া হয়নি। ভারতের এ মনোভাব ইঙ্গিত দেয় তারা তাদের আকাশ সংস্কৃতি দিয়ে আমাদের যুবসমাজকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে সক্রিয়। ভারতের সাধারণ মানুষ আমাদের চ্যানেল সম্প্রচারের পক্ষে। কিন্তু বাদ সাধছে সেখানকার রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীরা। বাংলাদেশের বাঙালি ইউনূস নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার পর পশ্চিম বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে তেমনটা উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়নি যেমনটা আমরা বাংলাদেশে দেখেছি সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘিষ্ঠ ভেদে এ দেশের সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপর বাঙালি অমর্ত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে। কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুতে গোটা বাংলাদেশের মানুষ যখন শোকে মুহ্যমান তখন একই ভাষাভাষী পশ্চিম বাংলার প্রচার মাধ্যমসহ শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের নিরুদ্বেগ আচরণ আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। আমাদের এ ভূ-ভাগসহ বর্তমানে পৃথিবীতে ধর্মের প্রভাব রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে এত প্রকট যে ধর্মকে বাদ দিয়ে কোন জাতির পৃথক অস্তিত্ব কল্পনায় আনার অবকাশ নেই। এ ধর্মীয় অনুভূতি থেকেই এ দেশ খণ্ডিত হয়েছে এবং এ জাতি বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে, পারস্পরিক আস্থা ও শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে অবলুপ্ত বিবেকের ইতি টেনে আমরা উভয়ের জন্য সমৃদ্ধির সোপান রচনা করতে পারি। ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিমকোর্ট iktederahmed@yahoo.com | |||||||||||||||||||
http://www.sonarbangladesh.com/writer/IktederAhmed | |||||||||||||||||||
| |||||||||||||||||||
| |||||||||||||||||||
|
No comments:
Post a Comment