Wednesday, February 6, 2013

বন্দিমুক্তি না কানামাছি খেলা

বন্দিমুক্তি না কানামাছি খেলা
http://eisamay.indiatimes.com/post-editorial-1/articleshow/18379964.cms


0
বন্দিমুক্তি না কানামাছি খেলা
কানাই হাঁসদা, শম্ভু সোরেন, ছত্রধর মাহাত, আজম শেখ, ইদ্রিস শেখ, গৌর চক্রবর্তী, সীমা সরকার এবং অজস্র মানুষের এক সুদীর্ঘ তালিকা৷ তালিকাভুক্ত চেনা-অচেনা এই মানুষগুলি বন্দি হয়ে আছেন রাজ্যের বিভিন্ন জেলে বা সংশোধনাগারে৷ রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধে৷ বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন জাতিবর্ণের এবং বিভিন্ন পেশার এই মানুষগুলির একটাই পরিচয়- 'রাজনৈতিক বন্দি' বা 'রাজবন্দি'৷ 

বন্দিমুক্তি কমিটির 'সংবাদ বুলেটিন'-এর জানুয়ারি, ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, এই মুহূর্তে সারা রাজ্যে ১৭৬ জন মানুষ রাজনৈতিক কারণে বন্দি হয়ে আছেন৷ মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে সবচেয়ে বেশি ৬৫ জন৷ এরপর আলিপুর সংশোধনাগার আর আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার মিলিয়ে ৫৩ জন৷ প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে ২০ জন৷ এ ছাড়াও, বহরমপুর, কৃষ্ণনগর আর দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে মোট ৩৫ জন৷ বন্দিমুক্তি কমিটির দাবি, রাজবন্দিদের এই খতিয়ান অসম্পূর্ণ৷ এই তালিকার বাইরেও বহু বন্দি রয়েছেন৷ 

সিপিআই (মাওবাদী), এমইউসিআই (সি), পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটি, আদিবাসী-মূলবাসী জনগণের কমিটি ইত্যাদি রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের সদস্য-সমর্থক হিসাবে পরিচিত এই মানুষগুলির সিংহভাগই বিদায়ী বামফ্রন্ট সরকারের আমলে বন্দি হয়েছেন৷ বর্তমান তৃণমূল জমানায়ও 'মাওবাদী' অভিযোগে বেশ কিছু মানুষকে বন্দি করা হয়েছে কিংবা হচ্ছে৷ কিন্ত্ত প্রশাসনিক স্তরে কঠোর গোপনীয়তার কারণে এই বন্দিদের সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি বলে বন্দিমুক্তি কমিটির সংবাদ বুলেটিন-এ উল্লেখ করা হয়েছে৷ 

বিপুল সংখ্যক এই রাজনৈতিক বন্দিদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১, ১২১-এ, ১২২, ১২৩ এবং ১২৪-এ ধারায় মামলা আনা হয়েছে৷ এই সব ধারার সারমর্ম, 'রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা', 'বিদেশি শক্তির মদতে রাষ্ট্র উত্খাতের চক্রান্ত', 'রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সশস্ত্র প্রস্ত্ততি' ইত্যাদি৷ এ ছাড়াও গৌর চক্রবর্তী, হিমাদ্রি সেনরায়, সুদীপ চোংদার-সহ বাছাই করা ৯০জনকে বন্দি করে রাখা হয়েছে 'ইউএপিএ' আইনে৷ 'ইউএপিএ' পুরো কথা আনলফুল অ্যাক্টিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট৷ বে-আইনি কার্যকলাপ দমন আইন৷ এই আইনে ৬ মাস পর্যন্ত বিনা বিচারে অভিযুক্তকে বন্দি করে রাখা যায়৷ বিচার হয় গোপন আদালতে৷ কেন্দ্রের আনা এই আইনে বিদায়ী বামফ্রন্ট সরকার যথেচ্ছ গ্রেন্তার চালিয়েছে৷ 

বন্দিমুক্তির দাবির পরম্পরা 

১৯৭৭-এ তীব্র জনমতের চাপে এবং সে সময়ের কেন্দ্রে জনতা সরকারের সমর্থনে বামফ্রন্ট প্রশাসন রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির প্রতিশ্রীতি পালন করলেও, তাদের শাসন যত দীর্ঘায়িত হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই জনবিরোধী কার্যকলাপ বেড়েছে৷ এবং প্রতিবাদে একের পর এক গণআন্দোলন গড়ে উঠেছে৷ আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ধাপে ধাপে তীব্র হয়েছে৷ নতুন করে গ্রেন্তার শুরু হওয়ায় দিনে দিনে বেড়েছে রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যা৷ ফলে ১৯৭৭ পূর্ববর্তী রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির দাবিও ফের উঠতে শুরু করে৷ এমনই এক প্রেক্ষাপটে ২০০৬ থেকে ২০১১-র এপ্রিলের মধ্যে ঘটে যায় সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড় কাণ্ড৷ রাজ্যব্যাপী গণ-আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকে৷ তাতে সামিল হন নাগরিক সমাজের এক বিরাট অংশ৷ বামফ্রন্ট জমানায় ক্রমব্যান্ত দলীয় সন্ত্রাসের অবসানের প্রশ্নটিও জোরালো হয়ে ওঠে৷ সামনে চলে আসে 'পরিবর্তন'-এর শ্লোগান৷ সেই শ্লোগান-এর সঙ্গেই মিশে থাকে ঐতিহ্যবাহী শ্লোগান৷ 'সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির নিঃশর্ত মুক্তি চাই'৷ 

সেই উত্তাল সময়ে রাজ্যের অবিসংবাদিত বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্ত্ত রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির দাবিকে জোরালো ভাষায় সমর্থন জানিয়েছিলেন৷ ২০১১-র মার্চে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন ঘোষণার পরে প্রতিটি নির্বাচনী সভায় বিরোধী নেত্রী রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রীতি দিয়েছিলেন৷ মনে আছে, লালগড়ে এক সভায় তিনি ছত্রধর মাহাতোর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন৷ স্বভাবতই রাজ্যের মানুষের মনে প্রত্যাশা জেগেছিল৷ কিন্ত্ত তৃণমূল কংগ্রেস-এর নির্বাচনী ইস্তেহার শুরুতেই সেই প্রত্যাশায় সংশয় জাগিয়ে তোলে৷ কারণ, ওই ইস্তেহারে রাজবন্দিদের মুক্তির প্রশ্নটি রাখা হলেও নাগরিক সমাজের 'নিঃশর্ত মুক্তি'র দাবি স্থান পেল না৷ বলা হল, 'গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং মানবাধিকারকে যথাযথ গুরুত্ব এবং প্রাধান্য দেওয়া হবে৷ রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে 'রিভিউ কমিটি' গঠন করে দেখা হবে সত্যিই তারা শাস্তি পাওয়ার মতো অপরাধ করেছেন, না কি প্রতিহিংসাপরায়ণতার জন্য উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে৷ কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে' (ইস্তেহার পৃষ্ঠা ৩৯)৷ অন্যদিকে ইস্তেহারের 'প্রশাসন' কলমে লেখা হল: 'বিনা বিচারে রাজনৈতিক বন্দিদের দ্রুত মুক্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে'৷ অর্থাত্‍ সাজাপ্রাপ্ত কিংবা বিচারাধীন বন্দিদের মুক্তি নিয়ে কোনও প্রতিশ্রীতি ছিল না৷ স্বভাবতই রাজ্যে বন্দিমুক্তি আন্দোলনের ঐতিহ্য ও চেতনা জাগরুক রয়ে গেল৷ 

রিভিউ কমিটি 

২০১১-র ভোটে বামফ্রন্ট কার্যত ধুয়ে মুছে গেল৷ বিপুল ভাবে জয়ী হয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হল৷ ২০ মে (২০১১) নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি সংক্রান্ত 'রিভিউ কমিটি' গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হল৷ ৪ জুন প্রকাশ করা হল 'গেজেট নোটিফিকেশন'৷ রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র দন্তর প্রকাশিত ওই বিজ্ঞন্তির '... হোয়েরঅ্যাজ ইট হ্যাজ বিন মেড টু অ্যাপিয়ার টু দ্য গভর্নর দ্যাট সার্টেন আন্ডার-ট্রায়াল পলিটিকাল প্রিজনারস আর কনফাইন্ড ইন দ্য কাস্টডি ফর লং পিরিয়ড ডিউ টু নন-কমপ্লিশন অফ ট্রায়াল ... ইট হ্যাস ফারদার বিন মেড টু অ্যাপিয়ার টু দ্য গভর্নর দ্যাট ইট ইজ নেসেসারি টু রিভিউ দ্য কেসেস ... ইট হ্যাজ অলসো বিন কনসিডার্ড নেসেসারি দ্যাট দ্য কেসেস অফ পার্সনস হু হ্যাভ বিন কনভিকটেড ফর দ্য অফেন্সেস পার্টেনিং টু পলিটিকাল মুভমেন্ট শ্যাল বি রিকোয়ার্ড টু বি রিভিউড ... ইট হ্যাজ অলসো বিন মেড টু অ্যাপিয়ার টু দ্য গভর্নর দ্যাট ইট ইজ নেসেসারি টু রিভিউ কেসেস লজড অন দ্য বেসিস অফ কনসিডারেশন অফ দ্য পলিটিক্যালি মোটিভেটেড অ্যান্ড/অর কনককটেড এফআইআর ... ইন পারসুয়েন্স অফ দ্য ডিসিশন টেকেন বাই দ্য ক্যাবিনেট ইন ইটস মিটিং হেল্ড অন টোয়েন্টিয়েথ ডে অফ মে, ২০১১, দ্য গভর্নর ইজ প্লিজ হিয়ারবাই টু কনস্টিটিউট আ স্টেট লেভেল রিভিউ কমিটি ...'৷ 

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মলয় সেনগুন্তকে চেয়ারম্যান করে ওই রিভিউ কমিটিতে স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের বিশেষ কমিশনার, সংশোধনাগারের ইন্সপেক্টর জেনারেল-সহ মোট ১১ জন সদস্য রাখা হল৷ অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সুজাত ভদ্র, দেবাশিস ভট্টাচার্য, রাজদীপ মজুমদার, সুব্রত হাতি, আনসার মণ্ডল৷ কমিটি কী কী কাজ করবে সেটাও বলে দেওয়া হল- (১) টু একজামিন দ্য কনডাক্ট অফ প্রিজনারস ইন দ্য কারেকশনাল হোমস (২) টু একজামিন দ্য প্রোব্যাবিলিটি অফ ইন্সটিগেটিং আদারস টু কমিট দ্য অফেন্সেস, (৩) টু অ্যাসসার্টেন দ্য প্রোব্যাবিলিটি অফ দেয়ার রেভারটিং ব্যাক টু দ্য কমিশন অফ অফেন্সেস৷ 

জেলের মধ্যে বন্দিদের আচরণ এবং মুক্তি পেলে বাইরে গিয়ে অশান্তি বা অপরাধ করবে কি না কিংবা অন্যদের অপরাধ করতে ইন্ধন জোগাবে কি না, এ জাতীয় শর্তাবলী রাজনৈতিক বন্দিদের ক্ষেত্রে প্রশ্নাতীত ভাবে আপত্তিকর৷ কিন্ত্ত শর্তাবলীর সঙ্গে বন্দির প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই৷ বিজ্ঞন্তি অনুযায়ী রিভিউ কমিটি কাগজে কলমে বন্দিদের আচরণ দেখবে৷ সুতরাং, মানবাধিকার কর্মীদের একাংশ 'বন্দিকে মুচলেকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে' বলে যে অভিযোগ তুলেছেন, তা ভিত্তিহীন৷ 

শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়াল 

তৃণমূল সরকারের বহু ডংকা-নিনাদিত রিভিউ কমিটি গঠনের পরে ২০ মাস অতিক্রান্ত৷ এই সময়ের মধ্যে কমিটি গুটি কয়েক বৈঠক করে ৭৪ জন বন্দির মুক্তি সুপারিশ করে৷ সরকার পত্রপাঠ সেই তালিকা খারিজ করে ৫২-য় নামিয়ে আনে৷ এর মধ্যে আবার ২ জনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার আপত্তি জানায়৷ বাকি ৫০ জন (যাদের বেশির ভাগই গ্রেটার কোচবিহার, কামতাপুরি আন্দোলনের কর্মী) জামিনে মুক্তি পেয়েছেন৷ ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির তিন সদস্য রিভিউ কমিটির সুপারিশ মেনে নন্দীগ্রাম আন্দোলনে যুক্ত যথাক্রমে প্রকাশ ভুঁইয়া, রাধেশ্যাম গিরি এবং অন্য একজনকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে৷ 

পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ ২০০৭-এ ওই তিন জনকে মাওবাদী হিসাবে গ্রেন্তার করেছিল৷ এ ছাড়াও গত ৩০ ডিসেম্বর নিঃশর্তে মুক্তি পেয়েছেন প্রবীণ রাজনৈতিক কর্মী সুশীল রায়৷ মাওবাদী কার্যকলাপের অভিযোগ থেকেও তাঁকে রেহাই দেওয়া হয়েছে৷ তা হলে মমতা সরকারের রিভিউ কমিটি 'ব্যর্থ' বলে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের একাংশ যে আওয়াজ তুলেছেন তা অংশত সত্য৷ রাষ্ট্রশক্তিকে যথাযথ ভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি ওই কমিটি৷ তাই মাওবাদী, এস ইউ সি আই (্সি)-র বহু কর্মীর মুক্তি আজও কার্যত গভীর অনিশ্চয়তা ডুবে আছে৷ রিভিউ কমিটির মেয়াদও শেষ৷ এখন নাগরিক সমাজের নিরন্তর দাবি এবং জনমত গঠনের প্রক্রিয়াই জেলবন্দি গৌর চক্রবর্তী, রাজা সরখেল, কানাই হাঁসদাদের মুক্তি বাস্তব করে তুলতে পারে৷ 

লেখক মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত 

No comments:

Post a Comment

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

Census 2010

Welcome

Website counter

Followers

Blog Archive

Contributors